রাখাইনে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ঘরে ফেরার পথ তৈরি করতে সমঝোতা স্মারকে সই করেছে দুই দেশ।বৃহস্পতিবার মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে বাংলাদেশের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী এবং মিয়ানমারের পক্ষে দেশটির স্টেট কাউন্সিলর ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী কিয়া তিন্ত সোয়ে এই চুক্তিতে সই করেন।

আশা করা হচ্ছে, যার মাধ্যমে নতুন করে আসা ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা নিজ মাতৃভূমিতে ফিরে যাবে। পরে মাহমুদ আলী বলেন, এ প্রথম পদক্ষেপ, দুই দেশকে এখন পরের স্টেপে যেতে হবে।এখন কাজটা শুরু করতে হবে। সব ডিটেইল এর (সমঝোতা স্মারক) মধ্যে আছে। আমরা ঢাকায় ফিরে বিস্তারিত জানাব।তবে কবে নাগাদ প্রত্যাবাসন শুরু হবে, সে বিষয়ে সময়সীমা থাকছে না বলেই ইংগিত মিলিছে মন্ত্রীর কথায়। তিনি বলেন, তিন মাসের মধ্যে ফেরত না তো, এখন যেটা হচ্ছে এই কাজটা শুরু করতে হবে। ওখানে বাড়িঘরগুলোতো জ্বালিয়ে দিয়েছেৃ সমান করে দিয়েছে। এগুলো, বাড়িঘরতো তৈরি করতে হবে।অন্যদিকে মিয়ানমারের শ্রম, অভিবাসন ও জনসংখ্যা বিষয় দপ্তরের পার্মানেন্ট সেক্রেটারি মিন্ট চিং বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে বলেন, বাংলাদেশে ফরম (রোহিঙ্গাদের ব্যক্তিগত তথ্যের নিবন্ধন ফরম) পূরণ করে আমাদের ফেরত পাঠালে যত দ্রুত সম্ভব আমরা তাদের (রোহিঙ্গা) ফিরিয়ে আনতে চাই।

১০ লাখের কাছাকাছি আসা রোহিঙ্গা ফেরাতে কতদিন লাগবে জানতে চাইল তিনি বলেন, কাজটা শুরু করাই বড় কথা। কতদিন লাগবে তা এখনই নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। কারণ রাখাইনে যেখান থেকে রোহিঙ্গারা পালিয়ে এসেছেন তাদের বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেওয়া; সেগুলো তৈরি করতে হবে।এর বেশি তিনি আর কথা বলেননি। কেবল বলেছেন, পরশুদিন ঢাকায় ব্রিফ করা হবে। পরশু দিন অর্থাৎ আগামী শনিবার (২৫ নভেম্বর) এ বিষয়ে ঢাকায় সাংবাদিকদের বিস্তারিত তুলে ধরা হবে মন্ত্রী।রোহিঙ্গাদের ফেরতের ইস্যু ছাড়াও নাফ নদীর সীমানা রেখা বিনিময় বিষয়ক আরও একটি স্মারক সই হয়েছে বলে জানিয়েছেন মাহমুদ আলী। এছাড়া তারা ১৯৯৮ সালের সীমান্ত নির্ধারণী চুক্তি নবায়নে স্বারক বিনিময় করেন। এর আগে সকালে প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠকে বসেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী।পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্র বলছে, খুব ভালো আলোচনা হয়েছে। বৈঠকে মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর সু চি ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদ আলী রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে খোলামেলা কথা বলেছেন। তার আগে বুধবার সমঝোতার খসড়া নিয়ে দিনভর বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে আলোচনা হয়। মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, সমঝোতার বিস্তারিত জানা না গেলেও বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করতে নির্দিষ্ট সময়সীমা এবং জাতিসংঘের সম্পৃক্ততার প্রস্তাব দিয়েছে। চুক্তির আওতায় দুই দেশের কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে একটি যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হবে। ওয়ার্কিং গ্রুপ মাঠ পর্যায়ে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া সম্পন্ন করবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলে পররাষ্ট্র সচিব শহীদুল হক ছাড়াও মিয়ানমারে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সুফিউর রহমান, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা রয়েছেন।

প্রত্যাবাসন নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এটি তৃতীয় উদ্যোগ। এর আগে ১৯৭৮ সালে দুই দেশ চুক্তি করে। যার অধীনে দুই লাখ ৪০ হাজার রোহিঙ্গা ছয় মাসের মধ্যে ফেরত যায়। পরে ১৯৯২ সালে দুই দেশের মধ্যে আরেকটি সমঝোতা হয়, যার অধীনে ২০০৫ সাল পর্যন্ত দুই লাখ ৩৬ হাজার রোহিঙ্গা মিয়ানমারে ফেরত যায়।চলতি বছরের ২৪ আগস্টের পর থেকে অব্যাহত অত্যাচারে এখন পর্যন্ত পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত লাখের বেশি বলে জাতিসংঘ জানাচ্ছে। বেসরকারি হিসেবে সংখ্যাটা আরও লাখ খানেক বেশি। এছাড়া আগে থেকেই চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা কক্সবাজারে থাকেন। এতে মোট রোহিঙ্গা সংখ্যা ১১ লাখ ছাড়িয়েছে। ঘটনার শুরু গত ২৪ আগস্ট। সে রাতে রাখাইনে পুলিশ ক্যাম্প ও সেনা আবাসে বিচ্ছিন্ন সন্ত্রাসী হামলার ঘটনা ঘটে। এর জেওে অভিযানের নামে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী নিরস্ত্র রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুদের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালাতে থাকে। ফলে লাখ লাখ মানুষ সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য চলে আসছেন। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতিগত দ্বন্দ্বের জেরে ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে নতুন করে দেশটির উত্তর-পূর্ব রাখাইন রাজ্যে বসবাসরত মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের ওপর সহিংসতা চালাচ্ছে দেশটির সেনাবাহিনী। গত বছরের অক্টোবরেও প্রায় ৮৭ হাজার রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেন।