মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের বরইতলী ভাল্লুকিয়া জিরো লাইনে অবস্থান নেওয়া রোহিঙ্গা পরিবারের দেড় শতাধিক শিশু প্রচ- শীতের কষ্টে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে। পরনে শীতবস্ত্র নেই।

রাতে শীত নিবারণে নেই কম্বল। খালি গায়ে-খালি পায়ে পলিথিনের ঘরে ওদের দিন কাটে। দিনের শুরুতে রোদের ভাপে কিছুটা আরাম পেলেও পড়ন্ত বিকেলে পাহাড়ি উপত্যকার হু হু শৈত্যপ্রবাহ ওদের জীবনকে দুর্বিষহ করে তোলে।অনুসন্ধানে জানা যায়, ওপারে সেনা নির্যাতনে টিকতে না পেরে ২৫ আগস্ট ভোরে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের ৪৯নং পিলারের কাছাকাছি এই এলাকায় এসে আশ্রয় নেয় ৭৮টি রোহিঙ্গা পরিবার।সরকারি হিসাবে এই অস্থায়ী শিবিরের মোট জনসংখ্যা ৩৬২। ২৮ অক্টোবর দুই কন্যাশিশু ও এক ছেলেশিশু জন্ম নেয়। আর মারা গেছে এক ছেলেশিশু। এতে জনসংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৬৪ জনে। হিসাব অনুযায়ী এর মধ্যে পুরুষ ৯৩ জন, নারীর সংখ্যা ১০০।কন্যাশিশু ৭৭ এবং ছেলেশিশু ৯৪।

শিবিরের বাসিন্দারা জানান, যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা, সমন্বয়ের অভাব এবং অনিবন্ধিত শিবির হবার কারণে বাংলাদেশ রেডক্রিসেন্ট সোসাইটি ছাড়া অন্য কারো সাহায্য পৌঁছে না এখানে। একসময় ইমামতি করতেন সামশুল আলম। এখন তিনি এই শিবিরের বাসিন্দা।সামশুল আলম জানান, রেডক্রিসেন্টের পক্ষ থেকে শিবিরের বাসিন্দাদের চাল, ডাল, ভোজ্য তেল দেওয়া হয়। কিন্তু এগুলো খেতে যে তরিতরকারি লাগে, তার কথা তো কেউ ভাবে না। তিনি বলেন, আমাদের কাছে বার্মিজ টাকা আছে। কিন্তু এই টাকা বাংলাদেশে চলে না। তাই চাহিদা অনুযায়ী কিছুই কিনতে পারি না। এমন পরিস্থিতিতে এক সীমাহীন কষ্টের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গাদের দিন কাটানোর কথা বলেন তিনি। ওই শিবির পরিদর্শনে গিয়ে দেখা গেছে, অসংখ্য শিশু ঘুরে বেড়াচ্ছে এখানে-ওখানে। উদোম গা-খালি পা। আগন্তক দেখলেই এসে জড়ো হচ্ছে কিছু পাবার আশায়।

তাদের সাথে কথা বলে জানা গেল, ওপারেও ছিল না লেখাপড়ার কোনো অধিকার। এপারে এসেও শিক্ষার ছোঁয়া নেই ওদের জীবনে। সুযোগ নেই খেলাধুলা কিংবা লাফিয়ে-দাপিয়ে বেড়ানোর। খাড়া পাহাড়ের ঢালের নিচে পলিথিন-মাথার উপর পলিথিন, চারপাশে পলিথিনে ঘেরা ১২ বাই ১৭ ফুটের ঘরে এক অনিশ্চিত ভবিষ্যতের শঙ্কা মাথায় নিয়ে কাটছে এই ১৭১ শিশু-কিশোরের দিন-রাত।পানি ও স্যানিটেশনের প্রকট সংকট বরইতলী ক্যাম্পে। রেডক্রিসেন্টের বসানো একটি মাত্র নলকূপেও পানি ওঠে না। তাই পাহাড়ি ছড়ার মুখে মাটির বাঁধ দিয়ে তৈরি করা জলাধারই ওদের একমাত্র সম্বল। বৃষ্টি না থাকায় এটিও শুকিয়ে যাবে খুব সহসাই।কিছুক্ষণ অপেক্ষা করেই বুঝা গেল, আদর নেই, যতœ-আত্তি নেই-এমন এক পরিবেশে বেড়ে উঠছে এখানে আশ্রয় নেয়া শিশু-কিশোররা।

দুবেলা ভাত খাবার সময়েই কেবল ঘরে ডাক পড়ে। বাকিটা সময় কাটে পরিচর্যাবিহীন। খাবার গ্রহণের আগে হাতধোয়া কিংবা মলত্যাগের পর সাবান দিয়ে জীবাণু তাড়ানোর ম্যাসেজ ওদের কাছে পৌঁছেনি।নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলা সদর থেকে লেম্বুছড়ি-দোছড়ি হয়ে যেতে হয় বরইতলী। রাস্তাটি দুর্গম হওয়ার কারণে এখানে বেসরকারি সাহায্য পৌঁছে না বললেই চলে।দোছড়ি ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মোহাম্মদ হাবিবুল¬াহ তুলে ধরেন দুরবস্থার প্রকৃত চিত্র।তিনি জানান, পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে বিদেশি নাগরিক, দাতা সংস্থা বা মিশনারিদের প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ায় দাতা সংস্থাগুলো বরইতলী শিবির পর্যন্ত পৌঁছুতে পারে না। যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্গম সড়ক ব্যবস্থা হওয়ায় দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অপছন্দের তালিকায় এই ক্যাম্প। হাবিবুল্লাহ জানান, কয়েক মাস আগে এইচবিবি বিশিষ্ট নাইক্ষ্যংছড়ি-দোছড়ি সড়কের ইট তুলে খোয়া/কংকর দিয়ে সাব-বেজ নির্মাণের কাজ চলমান থাকায় এই সড়কে ছোট ছোট গাড়ি এবং মোটরসাইকেল চালানোও কষ্টকর। সম্প্রতি ঠিকাদার চম্পট দেওয়ায় সে কাজও বন্ধ। কবে শেষ হবে কেউ জানে না। এই অবস্থায় স্থানীয় মানুষরাও বরইতলী শিবিরে গিয়ে সাধ্য অনুযায়ী সাহায্য দেওয়ার আগ্রহ হারাচ্ছেন।টেকনাফের নাফ নদীতে রোহিঙ্গা বোঝাই ১০টি ভেলা ভাসছে। শুক্রবার সকাল ৮টা থেকে এ ১০টি ভেলা ভাসতে দেখা যায়। প্রতিটি ভেলায় নারী-পুরুষ শিশুসহ ৪০ থেকে ৬০ রোহিঙ্গা থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এ তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করেছেন টেকনাফ-২ বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) এর অধিনায়ক লেফট্যান্টেট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম।

আরিফুল ইসলাম বলেন, শুক্রবার সকাল থেকে রোহিঙ্গাদের ১০টি ভেলা টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপের জারিয়াপাড়ার উল্টোপাশে মিয়ানমারের জলসীমানায় অবস্থান করছে। এপার থেকে ভেলাগুলোর চারপাশে সে দেশের আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার দুটি স্পিডবোড টহল দিতে দেখা যাচ্ছে। রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা নৌকা সংকটের কারণে প্লাস্টিকের জারিকেন, কাঠের তক্তা, বাঁশ ও দড়ি দিয়ে ৩০ থেকে ৪০ ফুট দৈর্ঘ্যরে ভেলা দিয়ে বাংলাদেশে আসছে। গত বুধবার একটি ভেলায় ৫২ জন, গতকাল বৃহস্পতিবার তিনটি ভেলায় ১৮০ জনসহ ভেলায় করে ২৩২ জন বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছেন।

আরিফুল ইসলাম বলেন,জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রোহিঙ্গারা এভাবে আসায় যেকোনো সময় ভেলা উল্টে দুর্ঘটনার শিকার হতে পারে। একই সঙ্গে তারা মিয়ানমারের জলসীমা অতিক্রম করে বাংলাদেশে চলে এলেই মানবিক সহায়তার কথা চিন্তা করে বিজিবি তাদের উদ্ধার করে একটি স্থানে জড়ো করে। খাদ্য ও মানবিক সহায়তা দিয়ে তাদের রোহিঙ্গাদের জন্য ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে এখন ইয়াবা, অস্ত্রসহ, মাদক পাচার হয়ে আসায় তাদের তল্লাশি করে তাদের জন্য স্থাপিত ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে।শাহ পরীর দ্বীপের বাসিন্দা ও ছাবরাং ইউনিয়নের ৯ নম্বর ইউপি সদস্য ফজল হক বলেন, রোহিঙ্গারা নৌকা সংকটের পর এখন প্রতিদিন ভেলায় করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসায় সাধারণ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। কারণ গত কয়েক দিনে মিয়ানমারে কোনো ঘটনা ঘটেনি। বাংলাদেশে স্থাপিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে বিভিন্ন ত্রাণ সামগ্রী দেওয়ার খবরটি ওই পারে পৌঁছানোর পর রোহিঙ্গারা আবারও দলে দলে অনুপ্রবেশ করছে। টেকনাফ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মাঈন উদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, ২৯ আগস্টের পর থেকে গতকাল পর্যন্ত টেকনাফ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা থেকে রোহিঙ্গা পারাপারের নৌকা, নৌকার মালিক, মাঝি ও দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ৪৫২ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছে। এরপর নৌকা সংকট দেখা দিলে রোহিঙ্গারা ভেলা করে আসতে শুরু করেছেন। আবার কিছু কিছু নৌকা রাতের আঁধারে রোহিঙ্গা নিয়ে আসছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে অভিযান অব্যাহত রেখেছি।

এদিকে, মিয়ানমার থেকে নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মধ্যে জরীপ চালিয়ে এই পর্যন্ত ৩৬ হাজার ৩৭৩ জন এতিম শিশু শনাক্ত করা হয়েছে।এর মধ্যে গত বুধ ও বৃহস্পতিবার দুইদিনেই সনাক্ত হয়েছে ১ হাজার ৮১৫ জন।সমাজ কল্যাণ অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ধারণা করছেন এখনও যেভাবে এতিম শিশু সনাক্ত হচ্ছে- তাতে এ সংখ্যা কয়েকদিনের মধ্যে ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে। সমাজসেবা অধিদপ্তরের উদ্যোগে ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল অরফান চাইল্ড’ কার্যক্রমের আওতায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে। এদিকে এখনও রোহিঙ্গারা আসছে। গত ৮-১০ দিন ধরে গড়ে এক হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করছে।শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনের (আরআরআরসি) রিপোর্ট অনুযায়ী ২৫ আগস্টের পর থেকে এই পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের সংখ্যা ৬ লাখ ২৬ হাজার।সমাজসেবা অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক (কার্যক্রম) ও ‘মিয়ানমার ন্যাশনাল অরফান চাইল্ড’ প্রকল্পের সমন্বয়কারী সৈয়দা ফেরদাউস আখতার আজ বাসসকে বলেন, ‘আমরা ভাবছি এ মাসের মধ্যে এতিম রোহিঙ্গাদের সনাক্ত করার কাজ শেষ করতে পারবো।

তবে রোহিঙ্গারা এখনও আসছে এই ¯্রােতে আরও বাড়লে প্রকল্পের কাজ কিছুটা দীর্ঘায়িত হতে পারে। এতিমদের সংখ্যাও ৪০ হাজার ছাড়িয়ে যেতে পারে- জানালেন ফেরদৌস আক্তার। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ৮০ জন কর্মী ক্যাম্পগুলোতে গিয়ে খুঁজে খুঁজে অনাথ শিশু সনাক্তকরণের দায়িত্ব পালন করছেন।তারা বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে শিশুর অভিভাবক ও মাঝিদের মাধ্যমে সঠিক তথ্য-উপাত্ত নিয়ে সনাক্তকরণের কাজটি করছেন। যারা বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছে, যারা শুধু বাবা হারিয়েছে, যারা প্রতিবন্ধী, আর যারা মা-বাবার খোঁজ পাচ্ছে না- এমন চারটি শ্রেণীতে এদের ভাগ করা হচ্ছে। শিশু আইন অনুযায়ী ১৮ বছর পর্যন্ত বয়সীদের শিশু হিসেবে গণনা করে তালিকাভুক্ত করা হচ্ছে। ইতোমধ্যে টেকনাফের ৫টি ক্যাম্পে সনাক্তকরণের কাজ শেষ হয়েছে। এখন চলছে বড় দুইটি ক্যাম্প- কুতুপালং এবং বালুখালীতে। সনাক্ত হওয়া সকল এতিম শিশুকে সমাজকল্যাণ অধিদপ্তরে পক্ষ থেকে স্মার্ট কার্ড দেয়া হবে। জানালেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের কক্সবাজার জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক প্রীতম কুমার চৌধুরী।তিনি বলেন, এতিম রোহিঙ্গা শিশুদের সনাক্ত হওয়ার হার কিছুটা কমলেও এখনও প্রতিদিন ৮-৯শ এতিম শিশুর খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে। এ সংখ্যা ৪০ হাজার ক্রস করতে পারে। এদিকে এতিম রোহিঙ্গা শিশুদেরের সুরক্ষার জন্য আবাসস্থল শিশুপল¬ী’ নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রাথমিকভাবে উখিয়ার নিবন্ধিত কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের মধুছড়া এলাকায় ২শ একর জমিও নির্ধারণ করা হয়েছে। অনাথ রোহিঙ্গা শিশুদের সনাক্ত করার কার্যক্রম শেষ হলে আগামী মাসে শিশুপল্লীর কার্যক্রম শুরু করার পরিকল্পনা রয়েছে। উলে¬খ্য, ২৫ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের রাখাইনে সহিংসতায় খুন হয়েছে অসংখ্য রোহিঙ্গা দম্পতি। তাদের বেঁচে যাওয়া সন্তানরা আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীদের সঙ্গে পালিয়ে আশ্রয় নেয় বাংলাদেশে। এসব পিতৃ-মাতৃহীন শিশুদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে একটি বিশেষ সুরক্ষা অঞ্চল করার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ওই বিশেষ অঞ্চলে বিশেষ যতেœ দেখভাল করা হবে এসব শিশুদের।