ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটি শুক্রবার শেষ হলেও তার দেশে ফেরার বিষয়ে কোনো তথ্য জানাতে পারেনি সুপ্রিম কোর্ট।আইনমন্ত্রী আনিসুল হকও বলেছেন, প্রধান বিচারপতির দেশে ফেরা বা ছুটির মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য তার কাছে নেই।

বিচারপতি সিনহার ছুটি কাটিয়ে দেশে ফেরা বা না ফেরা নিয়ে নানা জল্পনা কল্পনা চলছে। তবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বরাবরই বলে আসছেন, আপিল বিভাগের অন্য বিচারকরা যেখানে ‘চান না’, সেখানে প্রধান বিচারপতির দায়িত্বে ফেরার খুব বেশি সম্ভাবনা তিনি দেখছেন না।বিচারপতি সিনহা শেষ অফিস করেন সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট। ৩ অক্টোবর আদালত খোলার আগের দিন সরকারের তরফ থেকে তার ছুটিতে যাওয়ার কথা জানানো হয়। এরপর ১৩ অক্টোবর অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশে দেশ ছাড়েন তিনি।তার আগে আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা এক প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি ‘দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত’ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করবেন।২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত। সংবিধান অনুযায়ী পদত্যাগ না করলে বা অপসারণ না করা হলে ওই সময় পর্যন্ত তিনিই বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি থাকবেন।

৩৯ দিনের দীর্ঘ ছুটি শেষে বিচারপতি সিনহা কবে দায়িত্বে ফিরছেন জানতে যোগাযোগ করা হলে সুপ্রিম কোর্টের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার জেনারেল জাকির হোসেন বৃহস্পতিবার সাংবাদিকদের বলেন, এ বিষয়ে তাদের কাছে কোনো তথ্য নেই।আর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে উনার (প্রধান বিচারপতি) ছুটির বিষয়ে নতুন কোনো তথ্য নেই। তিনি যদি ছুটি বাড়িয়ে না নেন বা কিছু না জানান, তাহলে চলতি ছুটির পর তা অনুপস্থিতি হিসেবে গণ্য হবে।এক্ষেত্রে সাংবিধানিক কোনো জটিলতা ঘটবে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, একেবারেই না, এক্ষেত্রে সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি ব্যবস্থা নিবেন। সেখানে অনুপস্থিতির বিষয়টি বলা আছে।সংবিধানের ৯৭ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী প্রধান বিচারপতির অনুপস্থিতিতে আপিল বিভাগের জেষ্ঠ্য বিচারপতিকে প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব দিয়ে থাকেন রাষ্ট্রপতি।সংবিধানে ৯৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, প্রধান বিচারপতির পদ শূন্য হইলে কিংবা অনুপস্থিতি, অসুস্থতা বা অন্য কোনো কারণে প্রধান বিচারপতি তাহার দায়িত্বপালনে অসমর্থ বলিয়া রাষ্ট্রপতির নিকট সন্তোষজনকভাবে প্রতীয়মান হইলে ক্ষেত্রমত অন্য কোনো ব্যক্তি অনুরূপ পদে যোগদান না করা পর্যন্ত কিংবা প্রধান বিচারপতি স্বীয় কার্যভার পুনরায় গ্রহণ না করা পর্যন্ত আপিল বিভাগের অন্যান্য বিচারকের মধ্যে যিনি কর্মে প্রবীণতম, তিনি অনুরূপ কার্যভার পালন করিবেন।আর রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তা মাহবুবে আলম বলেন, এ সম্পর্কে আমি কিছু বলতে পরব না। আমি শুধু এতটুকু জানি যে, উনার পক্ষে আদালতে ফিরে এসে এজলাসে বসে কাজ করা সুদূর পরাহত।বিচারপতি সিনহা বাদে আপিল বিভাগের বিচারপতির সংখ্যা বর্তমানে ৫ জন। নৈতিক স্খলন ও দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে প্রধান বিচারপতির ‘গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা’ না পাওয়ায় তার সঙ্গে এজলাসে বসতে অপর বিচারকরা অস্বীকৃতি জানিয়েছেন বলে সুপ্রিম কোর্টের এক বিবৃতিতে জানানো হয়েছে।

অগাস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট।সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।তুমুল আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতি গত ৩ অক্টোবর থেকে ছুটিতে যান। তিনি দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞাকে প্রধান বিচারপতির কার্যভার দেওয়া হয়।প্রধান বিচারপতিকে ‘জোর করে’ ছুটিতে পাঠানো হয়েছে- বিএনপির এমন অভিযোগের মধ্যেই ১৩ অক্টোবর রাতে অস্ট্রেলিয়ার উদ্দেশ্যে দেশ ছাড়েন বিচারপতি সিনহা।যাওয়ার আগে তিনি বলেন যান, তিনি ‘অসুস্থ নন’, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় ‘বিব্রত’। তার বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল রায় নিয়ে ‘ভুল ব্যাখ্যা’ দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী তার ওপর ‘অভিমান’ করেছেন।প্রধান বিচারপতি দেশ ছাড়ার পরদিনই সুপ্রিম কোর্টের বিরল এক বিবৃতিতে বলা হয়, বিচারপতির সিনহার বিরুদ্ধে দুর্নীতি, আর্থিক অনিয়ম, অর্থ পাচার ও নৈতিক স্খলনসহ ১১টি সুনির্দিষ্ট গুরুতর অভিযোগ জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি।সহকর্মীরা এর ব্যাখ্যা চাইলে গ্রহণযোগ্য কোনো ব্যাখ্যা বিচারপতি সিনহা দিতে পারেননি। এ কারণে তারা অভিযোগের সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত একই বেঞ্চে বসতে রাজি নন বলে জানানো হয় বিবৃতিতে।এরপর ১৮ অক্টোবর এক সংবাদ সম্মেলনে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে যেসব দুর্নীতির অভিযোগ এসেছে, তার অনুসন্ধান হবে এবং তা দুদকের মাধ্যমে করা হতে পারে।সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছিল, অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে বিচারপতি সিনহা ছুটিতে গেছেন। কিন্তু বিদেশে যাওয়ার সময় তা নাকচ করে তিনি বলেছেন, অসুস্থ নন, ক্ষমতাসীনদের সমালোচনায় তিনি ‘বিব্রত’।আমার দৃঢ় বিশ্বাস, সরকারের একটি মহল আমার রায়কে ভুল ব্যাখ্যা প্রদান করে পরিবেশন করায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমার প্রতি অভিমান করেছেন, যা অচিরেই দূরীভূত হবে বলে আমার বিশ্বাস।চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানোর যে অভিযোগ বিএনপি করছিল, তাও নাকচ করেছেন বিচারপতি সিনহা। বলেছেন, বিচার বিভাগ যাতে ‘কলুষিত না হয়’, সেজন্য তিনি নিজেই ‘সাময়িকভাবে’ যাচ্ছেন।সাড়ে তিন মাস চাকরির মেয়াদ থাকা প্রধান বিচারপতি উচ্চ আদালতে সরকারের হস্তক্ষেপের আশঙ্কার কথাও বলেছেন। রাষ্ট্রের জন্য তা ‘কল্যাণ বয়ে আনবে না’ বলে তিনি সরকারকে সতর্ক করেছেন।বিদেশ যাওয়ার বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করে বিচারপতি সিনহার দেওয়া চিঠির বরাতে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, প্রধান বিচারপতি চারটি দেশে যেতে চান। অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকা এবং ইউনাইটেড কিংডম- এই চারটি দেশে যেতে চান। আগামীকাল ১৩ অক্টোবর দেশ ত্যাগ করতে চান এবং ১০ নভেম্বর দেশে ফিরে আসবেন বলে চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে।প্রথমে প্রধান বিচারপতির জন্য ৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০ দিনের ছুটি মঞ্জুর করেছিলেন রাষ্ট্রপতি। কিন্তু বিচারপতি সিনহা যেহেতু আরও বেশি দিন বিদেশে থাকবেন, সেহেতু রাষ্ট্রপতি বৃহস্পতিবার নতুন আদেশ দেন।

আইন মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা ওই প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, বর্ধিত ছুটিতে প্রধান বিচারপতির বিদেশে অবস্থানের সময়ে, অর্থাৎ ২ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর পর্যন্ত, অথবা তিনি ‘দায়িত্বে না ফেরা পর্যন্ত’ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা প্রধান বিচারপতির কার্যভার সম্পাদন করেন।অগাস্টের শুরুতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে ছিলেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।সংবিধানের ওই সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল। কিন্তু রায়ে তা বাতিল করে জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে প্রতিষ্ঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনে সুপ্রিম কোর্ট।

সাত বিচারপতির ঐকমত্যের ভিত্তিতে দেওয়া ৭৯৯ পৃষ্ঠার ওই রায়ে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা নিজের পর্যবেক্ষণের অংশে দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে সমালোচনা করেন।ওই রায় এবং পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নেতা, এমনকি খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বঙ্গবন্ধুকে ‘খাটো করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে বিচারপতি সিনহার পদত্যাগের দাবি তোলেন ক্ষমতাসীন দলের অনেক নেতা।অন্যদিকে সংসদের বাইরে থাকা বিএনপির নেতারা ওই রায়কে স্বাগত জানিয়ে আসছেন। তাদের অভিযোগ, ওই রায়ের কারণেই চাপ দিয়ে প্রধান বিচারপতিকে ছুটিতে পাঠানো হয়েছে।ওই অভিযোগ অস্বীকার করে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বিচারপতি সিনহার স্বাক্ষরে রাষ্ট্রপতিকে পাঠানো ছুটির চিঠি গত ৪ অক্টোবর সাংবাদিকদের দেখান।ওই চিঠির বক্তব্য ছিল, প্রধান বিচারপতি ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে এর আগে দীর্ঘদিন চিকিৎসাধীন ছিলেন এবং গত বেশ কিছুদিন ধরেও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন। এ কারণে বিশ্রামের জন্য তিনি ছুটিতে যেতে চান।সরকার ও বিএনপি নেতাদের এই কথার লড়াইয়ের মধ্যে বিদেশযাত্রার সময় লিখিত বিবৃতিতে নিজের বক্তব্য জানিয়ে গেছেন বিচারপতি সিনহা। সেখানে তিনি লিখেছেন- আমি সম্পূর্ণ সুস্থ আছি, কিন্তু ইদানিং একটা রায় নিয়ে রাজনৈতিক মহল, আইনজীবী ও বিশেষভাবে সরকারের মাননীয় কয়েকজন মন্ত্রী ও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাকে ব্যক্তিগতভাবে যেভাবে সমালোচনা করেছেন, এতে আমি সত্যিই বিব্রত।২০১৫ সালের ১৭ জানুয়ারি প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব পাওয়া বিচারপতি সিনহার চাকরির মেয়াদ রয়েছে আগামী ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত।সুপ্রিম কোর্টের অবকাশ শুরুর আগে গত ২৪ অগাস্ট তিনি শেষ অফিস করেন এবং অবকাশ শেষে ৩ অক্টোবর আদালত খোলার দিন থেকে ছুটিতে আছেন।প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান বিচারপতি কিংবা সরকারের হস্তক্ষেপ করার কোনো রেওয়াজ নেই। তিনি শুধুমাত্র রুটিন মাফিক দৈনন্দিন কাজ করবেন। এটাই হয়ে আসছে।প্রধান বিচারপতির প্রশাসনে হস্তক্ষেপ করলে এটি সহজেই অনুমেয় যে, সরকার উচ্চ আদালতে হস্তক্ষেপ করছে এবং এর দ্বারা বিচার বিভাগ ও সরকারের মধ্যে সম্পর্কের আরও অবনতি হবে। সেক্ষেত্রে তা রাষ্ট্রের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না’ বলে সতর্ক করেন তিনি।