প্রায় তিন দশক আগে শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর খুনি খন্দকার আবদুর রশীদসহ ফ্রিডম পার্টির ১১ নেতাকর্মীকে বিশ বছরের কারাদ- দিয়েছে আদালত। ২৮ বছর আগে রাজধানীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাড়িতে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা মামলায় ১১ জনকে ২০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছেন আদালত।ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির রোববার এই রায় ঘোষণা করেন।কারাদন্ড পাওয়া আসামিরা হলেন গোলাম সারোয়ার ওরফে মামুন, জজ মিয়া, ফ্রিডম সোহেল, সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ ওরফে মুরাদ, গাজী ইমাম হোসেন, খন্দকার আমিরুল ইসলাম ওরফে কাজল, মিজানুর রহমান, হুমায়ুন কবির, মো. শাজাহান, কর্নেল আবদুর রশীদ, জাফর আহমেদ ওরফে মানিক। তাঁদের মধ্যে কর্নেল রশীদ, জাফর আহমেদ ও হুমায়ুন কবির পলাতক।

অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় হুমায়ুন কবির নামের আরেক আসামিকে বেকসুর খালাস দিয়েছেন আদালত।একই ঘটনায় বিস্ফোরকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে করা মামলার রায় আজ বেলা দুইটার দিকে ঘোষণা করার কথা রয়েছে।দন্ডিত আসামিদের মধ্যে রশীদ, জাফর ও হুমায়ুন কবির ওরফে হুমায়ুন পলাতক। আর জামিনে থাকা শাজাহান বালুর জন্য বেশ কিছু সময় অপেক্ষার পরও তিনি না আসায় বিচারক তার অনুপস্থিতিতেই রায় ঘোষণা করেন। জামিনে থাকা মিজান, ইমাম হোসেন, কাজল রায়ের জন্য আদালতে উপস্থিত ছিলেন। কারাগারে থাকা মামুন, সোহেল, মুরাদ ও জর্জ মিয়াকেও হাজির করা হয়েছিল। রায়ের পর তাদের সবাইকে কারাগারে পাঠানো হয়।মামলার নথি থেকে জানা যায়, শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট মধ্যরাতে ফ্রিডম পার্টির কয়েকজন ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবনে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করেন। শেখ হাসিনা ঘটনার সময় ওই বাড়িতে ছিলেন। বাড়ির নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম ওই ঘটনায় মামলা করেন।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল ৩২ নম্বর বাড়িতে অতর্কিতে গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে। ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্র“য়ারি এই মামলায় ১২ আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়।১৯৮৯ সালে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বাড়িতে গুলি ও বোমা ছোড়ার ঘটনায় এই মামলা দায়ের করা হয়।ওই ঘটনায় বিস্ফোরক আইনে দায়ের করা আরেক মামলার রায় ঘোষণা হবে বিকালে। হত্যাচেষ্টা মামলার ১২ আসামির মধ্যে ১১ জনকে দুটি ধারায় দশ বছর করে কারাদন্ড দেন বিচারক। দুটি সাজা পর্যায়ক্রমে খাটতে হবে বলে আসামিদের জেলে থাকতে হবে ২০ বছর করে। সেই সঙ্গে ২০ হাজার টাকা করে জরিমানা করা হয়েছে তাদের, যা না দিতে পারলে আরও ছয় মাস তাদের কারাগারে থাকতে হবে। সাজার মেয়াদ থেকে হাজতবাসকালীন সময় বাদ যাবে।বিচারক ১১ আসামিকে ওই সাজা দিয়েছেন অপরাধজনক ষড়যন্ত্র, প্ররোচণা, অপরাধমূলক কাজে সহযোগিতা এবং হতাচেষ্টার দায়ে।রায়ের পর্যবেক্ষণে তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুকে শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার ঘটনা আর তার শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়’।একই আসামিদের, একই ষড়যন্ত্রকারীদের পৃষ্ঠপোষকতায় শেখ হাসিনাকেও হত্যার চেষ্টা করা হয়েছিল।

বিচারক বলেন, হামলার ঘটনায় প্রথমে সাধারণ ডায়েরি করা হলেও পরে তা মামলায় রূপান্তর করা হয়। ওই এজাহার ছিল দুর্বল। কিন্তু মামলার তিন আসামি পরে আদালতের কাছে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়।মামলার সাক্ষ্য প্রমাণে এসেছে, তারা বিভিন্ন সময়ে অপরাধমূলক ষড়যন্ত্র করেছে এবং সেই ষড়যন্ত্র থেকেই তারা শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে।রায়ের পর আসামিপক্ষের মূল আইনজীবী আবদুল্লাহ মাহমুদ হাসান বলেন, তারা উচ্চ আদালতে আপিল করবেন।আর খালাস পাওয়া হুমায়ুন কবির ওরফে কবিরের আইনজীবী এ এস এম গোলাম ফাত্তাহ এই রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেন।১৯৮৯ সালের ১০ অগাস্ট মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর বাড়িতে যখন ওই হামলা হয়, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা তখন বাড়িতেই ছিলেন।বঙ্গবন্ধুর খুনিদের নেতৃত্বে গঠিত দল ফ্রিডম পার্টির নেতা-কর্মীরাই শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে ওই হামলা চালিয়েছিল বলে পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।ওই ঘটনায় বঙ্গবন্ধু ভবনের (বর্তমানে জাদুঘর) নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম একটি জিডি করেন, পরে তা মামলায় রূপান্তর হয়।এজাহারে বলা হয়, ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০-১২ জনের একটি দল অতর্কিত গুলিবর্ষণ ও বোমা হামলা করে এবং হামলাকারীরা কর্নেল ফারুক-রশিদ জিন্দাবাদ’ বলে স্লোগান দিতে দিতে পালিয়ে যায়।এইচ এম এরশাদের আমলে ওই মামলা হওয়ার পর ১৯৮৯ সালের ৮ ডিসেম্বর পুলিশ চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়ে বলে, অভিযোগের প্রমাণ তারা তদন্তে পায়নি।

১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় যাওয়ার পর ওই বছর ২ সেপ্টেম্বর মামলাটি পুনরুজ্জীবিত হয় বলে জানান মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পিপি সাইফুল ইসলাম হেলাল।তদন্ত শেষে ১৯৯৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি সিআইডির তৎকালীন সহকারী পুলিশ সুপার মো. খালেক উজ্জামান আদালতে হত্যা চেষ্টা ও বিস্ফোরক আইনে দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করেন।ফ্রিডম পার্টির নেতা ও বঙ্গবন্ধুর খুনি সৈয়দ ফারুক রহমান, আবদুর রশীদ ও বজলুল হুদাসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয় সেখানে।২০০১ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারালে মামলটি আবার নিশ্চল হয়ে পড়ে। শেখ হাসিনার দল পুনরায় ক্ষমতায় যাওয়ার পর ২০০৯ সালের ৫ জুলাই আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরু হয়। সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয় ২৭ অগাস্ট।দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য মামলাটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হলেও সাক্ষীদের হাজির করতে বিলম্ব এবং আসামিদের জবানবন্দি গ্রহণকারী ম্যাজিস্ট্রেটকে না পাওয়ায় বিচার থাকে ঝুলে।দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারের সময়সীমা পেরিয়ে গেলে মামলার নথি ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। তিনজন বিচারকের হাত ঘুরে ঢাকার চতুর্থ অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ মো. জাহিদুল কবির গত ১৬ অক্টোবর দুই মামলার যুক্তিতর্ক শুনে রায়ের তারিখ ঠিক করে দেন।সকালে নাজিমউদ্দিন রোডের বিশেষ এজলাসে বসে হত্যা চেষ্টা মামলার রায় দেন বিচারক। আর বিকালে জনসন রোডে মহানগর দায়রা জজ আদালত ভবনের দ্বিতীয় তলার এজলাস থেকে আসবে বিস্ফোরক মামলার রায়।মামলার অভিযোগপত্রে সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ ফারুক রহমান ও মেজর বজলুল হুদার নাম থাকলেও বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার রায়ে ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি তাদের ফাঁসি কার্যকর হওয়ায় এ দুই মামলা থেকে তাদের বাদ দেওয়া হয়। আর রেজাউল ইসলাম খান ফারুক ও লিয়াকত হোসেন কালা নামের দুই আসামির মৃত্যু হওয়ায় তাদের নামও বাদ দেওয়া হয়।দন্ডিত আসামিদের মধ্যে সৈয়দ নাজমুল মাকসুদ মুরাদ যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গিয়ে ফ্রিডম পার্টির কর্মী হিসাবে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছিলেন। পরে ইন্টারপোলের মাধ্যমে ২০১৪ সালের ২০ মার্চ আটলান্টা থেকে তাকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের মুখোমুখি করা হয়। এ মামলায় বিচার কাজ চলে মোট ৬৬ কার্যদিবস। রাষ্ট্রপক্ষে মোট ১২ জনের সাক্ষ্য শোনে আদালত। আসামিপক্ষে কেউ সাক্ষ্য দেননি।

পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যাকান্ডের পর শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন সময় মোট ১৯ বার চেষ্টা চালানো হয়েছিল বলে আওয়ামী লীগের নেতাদের ভাষ্য।গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় বোমা পুঁতে হামলার মামলাটিতে এই বছরই রায় হয়। গত অগাস্টে দেওয়া এই রায়ে ১০ আসামির মৃত্যুদন্ড হয়।২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট গ্রেনেড হামলার আলোচিত মামলাটির বিচারও শেষ পর্যায়ে রয়েছে।