প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে এক মাসের ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর আপিলের রায়ের জের ধরে তাঁকে (সুরেন্দ্র কুমার সিনহা) ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। এটি দেশের বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে একটি নোংরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।বুধবার সকালে রাজধানীর নয়াপল্টনে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এই অভিযোগ করেন। সংবাদ সম্মেলনে সুরেন্দ্র কুমার সিনহার ছুটির বিষয়ে দলের আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানো হয়।

মির্জা ফখরুল বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সর্বসম্মত রায় দেওয়ার পর থেকে সর্বোচ্চ আদালত এবং তাঁর সম্মানিত বিচারপতিগণকে সরকারপ্রধান থেকে সরকারের মন্ত্রী, সরকারি দল ও জোটের নেতা-কর্মীরা অসাংবিধানিক, অযৌক্তিক ও কুৎসিত ভাষায় সমালোচনা করে চলেছেন। এমনকি জাতীয় সংসদে যে ভাষায় সর্বোচ্চ আদালত ও তাঁর বিচারপতিগণের সমালোচনা করা হয়েছে, তা শুধু অভূতপূর্ব নয়, অস্বাভাবিকও।প্রধান বিচারপতিকে জোর করে ছুটিতে পাঠানোর দাবির ভিত্তি কী? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর থেকে প্রধান বিচারপতির ওপর ব্যক্তিগতভাবে এবং তাঁর ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে কুৎসিত ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে। তাঁকে তাঁর পরিণতির কথা বলা হয়েছে। ছুটি নিয়ে চলে যেতে বলা হয়েছে। এমনকি পদত্যাগ করতে বলা হয়েছে। এ থেকে সমগ্র জাতির কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট, যেহেতু ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করার ব্যাপারে তারা (সরকার) একমত হননি, তীব্র ভাষায় তাঁর সমালোচনা করেছেন, সুতরাং তাঁকে জোর করে ছুটি নিতে বাধ্য করা হয়েছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।বিএনপির মহাসচিব বলেন, প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ে থেকে এখন পর্যন্ত কোনো কমেন্টস পাইনি। তিনি ছুটি নিয়েছেন বা কী অবস্থায় আছেন, অসুখ হয়েছে কি নাÑএ সব বিষয়ে তাঁর কার্যালয় থেকে কোনো তথ্য পাইনি।

মির্জা ফখরুল বলেন, গতকাল আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন যে, তিনি (প্রধান বিচারপতি) নাকি ক্যানসারে আক্রান্ত হয়ে ছুটি নিয়েছেন। কিন্তু গত পরশু সন্ধ্যায় তাঁর বাসভবনে সাক্ষাৎপ্রার্থী সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে তাঁর পক্ষ থেকে জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন যে, প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমি সুস্থ আছি কিন্তু কথা বলতে পারব না।
সম্মেলনে ফখরুল বলেন, গত পরশু (সোমবার) সন্ধ্যায় তার (প্রধান বিচারপতি) বাসভবনে সাক্ষাৎপ্রার্থী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে উপস্থিত সাংবাদিকদের সামনেই জনৈক পুলিশ কর্মকর্তা জানিয়েছেন, মাননীয় প্রধান বিচারপতি বলেছেন, আমি সুস্থ আছি, কিন্তু কথা বলতে পারব না। এ থেকে প্রমাণিত হয়, মাননীয় প্রধান বিচারপতি অসুস্থ নন। তাকে জোর করে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে।সর্বোচ্চ আদালতের সর্বোচ্চ বিচারপতির সাথে এমন আচরণ করা থেকে প্রমাণিত হয় যে, এই সরকার অস্তিত্ব সংকটের ভীতিতে বেসামাল হয়ে পড়েছে। আমরা সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে সরকারের এহেন আক্রোশমূলক ঘৃণ্য আচরণের তীব্র নিন্দা জানাই।বিএনপি মহাসচিব বলেন, প্রধান বিচারপতির অফিস থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো কমেন্টস পাইনি এবং তিনি এক মাসের ছুটি নিয়েছেন বা কি করেছেন, কি অবস্থায় আছেন, তার অসুখ হয়েছে, না হয়েছে- তার কার্যালয় থেকে আমরা এখন পর্যন্ত কোনো রকমের ইনফরমেশন পাইনি।আমরা অবশ্যই প্রধান বিচারপতির কার্যালয়ের কাছে জানতে চাই, দেশ ও জাতি জানতে চায় যে, এখন প্রধান বিচারপতির অবস্থানটা কী?

অগাস্টে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর থেকেই ক্ষমতাসীনদের সমালোচনার মুখে থাকা প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার ছুটিতে যাওয়ার খবর গত সোমবার প্রকাশের পর থেকেই বিভিন্ন মহলে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।প্রধান বিচারপতিকে ‘প্রচন্ড চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে’ ছুটিতে যেতে বাধ্য করা হয়েছে বলে এর আগে অভিযোগ তুলেছেন বিএনপিপন্থি আইনজীবীরাও।এমন প্রেক্ষাপটে মঙ্গলবার রাতে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসেন বিএনপির নেতারা। বৈঠকের পরই বুধবার দলের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানানোর কথা বলা হয়।এদিকে নানা সমালোচনার মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে দেওয়া প্রধান বিচারপতির ছুটির আবেদনটি বুধবার গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক, যেখানে ছুটির জন্য অসুস্থার কারণ দেখানো হয়েছে।

প্রধান বিচারপতিকে জোরপূর্বক দায়িত্ব থেকে বিরত রাখা হয়েছে- এমন অভিযোগের ভিত্তি জানতে চাইলে মির্জা ফখরুল বলেন, আপনাদের নিশ্চয় মনে আছে, ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ার পর থেকে প্রধান বিচারপতির ওপর ব্যক্তিগতভাবে, তার ব্যক্তিগত বিষয়গুলো নিয়ে অথবা সামগ্রিকভাবে তাকে যে ভাষায় আক্রমণ করা হয়েছে অথবা তাকে যে পরিণতির করা বলা হয়েছে, তাকে ছুটি নিয়ে চলে যাওয়ার কথা বলা হয়েছে। এমনকি তাকে পদত্যাগ করে চলে যাওয়ারও কথা বলা হয়েছে।এ থেকে আজকে সমগ্র জাতির কাছে এটা স্পষ্ট, যেহেতু ষোড়শ সংশোধনী রায় বাতিল করার ব্যাপারে তারা (সরকার) একমত হয়নি, অত্যন্ত আপত্তি জানিয়েছে এবং তীব্র ভাষায় প্রধান বিচারপতির সমালোচনা করেছে। সুতরাং তারা তাকে জোর করে ছুটি নিতে বাধ্য করছে বলে আমরা আশঙ্কা করছি।প্রধান বিচারপতির এভাবে হঠাৎ ছুটিতে যাওয়ার বিষয়টিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, আজ সারাদেশে একটা ফ্যাসিবাদ চলছে। ভীতি-ত্রাস চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়েছে। ক্ষমতাসীনরা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে অনুগত বিরোধীদল সাজিয়ে প্রকৃতপক্ষে এক দলীয় সরকার কায়েম করছে। প্রশাসন ও নিম্ন আদালতকে কুক্ষিগত করেছে।শক্তি প্রয়োগের দ্বারা বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণের মাধ্যমে বিচার বিভাগকে অনুগত করার সরকারি অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে সোচ্চার হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহবান জানাচ্ছি।বিএনপির মহাসচিব বলেন, এসব কিছু থেকে প্রমাণিত হয় যে প্রধান বিচারপতি অসুস্থ নন। তাঁকে জোর করে দায়িত্ব পালন থেকে বিরত রাখা হয়েছে।মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সর্বোচ্চ আদালতের রায় পছন্দ না হলে তা রিভিউ করার সাংবিধানিক প্রক্রিয়ায় না গিয়ে সরকার দেশের প্রবীণ বিচারপতিকে নজিরবিহীনভাবে ছুটি নিতে বাধ্য করার যে নোংরা দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে, তার বিরুদ্ধে দেশের আইনজীবী সমাজের পাশাপাশি সচেতন জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছেন।

বিএনপির মহাসচিব বলেন, প্রধান বিচারপতি মাত্র কয়েক দিন আগে জাপান ও কানাডা সফর করে এসেছেন। এসব দেশে উন্নত চিকিৎসা থাকা সত্ত্বেও তিনি সেখানে কোনো চিকিৎসা গ্রহণ করেছেন বলে দেশবাসী জানে না। এমনকি গত পরশু তিনি সুপ্রিম কোর্টে তাঁর কার্যালয়ে বসে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, ফাইল সই করেছেন।ষড়যন্ত্র নস্যাৎ হয়ে গেছে, তাই বিএনপি কান্নাকাটি করছে’, আইনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যের বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব বলেন, এটা নতুন কিছু নয়। আইনমন্ত্রী বলেন, অন্য মন্ত্রীরা বলেন, সারাক্ষণ তো আঙুলটা বিএনপির দিকে। এর কারণটা হচ্ছে বিএনপি সব সময় সত্য-বাস্তব কথা তুলে ধরে।সর্বোচ্চ আদালতের বিরুদ্ধে সরকার আক্রোশমূলক ও ঘৃণ্য আচরণ করছে বলে অভিযোগ করেন বিএনপির মহাসচিব।সংবাদ সম্মেলনে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, নজরুল ইসলাম খান, ভাইস চেয়ারম্যান বরকতউল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালাম, নাজমুল হক নান্নু, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী, কেন্দ্রীয় নেতা মীর সরফত আলী সপু, এবিএম মোশাররফ হোসেন, আবদুস সালাম আজাদ, আবদুল আউয়াল খান, শরীফুল আলম, হাসান জাফির তুহিন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।