কক্সবাজারের টেকনাফ উপজেলার সাবরাং ইউনিয়নের শাহপরীর মাযেরপাড়া সাগরসৈকতে ভেসে এসেছে আরও এক রোহিঙ্গা নারীর লাশ। আজ শনিবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে লাশটি উদ্ধার করা হয়।ওই নারীর নাম জানা যায়নি। তাঁর আনুমানিক বয়স ২২ বছর।গত ২৯ আগস্ট থেকে ১৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে ২৩টি নৌকাডুবির ঘটনায় আজ সকাল সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ১১২ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৫৭টি, নারী ৩২ জন, পুরুষ ২৩ জন। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাইনুদ্দিন খান বলেন, সকালে সাবরাং ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ইউপির সদস্য নুরু আমিনের নেতৃত্বে সৈকত এলাকা থেকে ওই নারীর লাশ উদ্ধার করা হয়। লাশটিতে পচন ধরায় তিনি দাফন করার নির্দেশ দিয়েছেন।ওসি মাইনুদ্দিন আরও বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল ১০টা ও বেলা ১টার দিকে শাহপরীর দ্বীপের পশ্চিমপাড়া সৈকতে সাগরে দুটি নৌকাডুবি হয়। ধারণা করা হচ্ছে, দুই নৌকাডুবির যেকোনো একটিতে ওই নারীর মৃত্যু হতে পারে। পোশাক দেখে ওই রোহিঙ্গা নারীকে চিহ্নিত করা গেছে বলে জানান তিনি।অন্যদিকে, শাহপরীর দ্বীপের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে নৌকায় করে মিয়ানমার থেকে প্রচুর রোহিঙ্গা ঢুকছে। টেকনাফ ২ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম বলেন, ‘কয়েকজন অসাধু মাঝি টাকার বিনিময়ে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ করাচ্ছে। আমরা চেষ্টা করছি তাদের নিয়ন্ত্রণ করার জন্য। যারা নদী ও সাগর পার হয়ে ঢুকে পড়েছে, তাদের একত্র করে স্থায়ীভাবে টেকনাফের হোয়াইকং পুটিবুনিয়া অস্থায়ী ক্যাম্পে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তত্ত্বাবধানে নেওয়া হয়েছে।মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের কক্সবাজার থেকে ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পুলিশ চট্টগ্রাম অঞ্চলে ২৭টি চেক পোস্ট বসিয়েছে।দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা মিয়ানমারের এই নাগরিকদের বিভিন্ন জেলায় ছড়িয়ে পড়ার কয়েকটি ঘটনা প্রকাশ পাওয়ার প্রেক্ষাপটে শনিবার চট্টগ্রাম নগরীতে নগরীতে এক মতবিনিময় সভায় এই তথ্য জানান পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি এস এম মনির-উজ-জামান।
তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গারা যাতে কোনো অবস্থাতেই মূল ভূ-খন্ডে ছড়িয়ে পড়তে না পারে, সে বিষয়ে পুলিশসহ প্রশাসন সর্বোচ্চ তৎপর রয়েছে। তাদের কক্সবাজারে সীমিত রাখার কাজ চলছে।ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও চট্টগ্রামে পুলিশের মোট ২৭টি চেক পোস্ট বসানো হয়েছে।মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে নির্যাতনের মুখে তিন সপ্তাহে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এসেছে। আগে থেকে বাংলাদেশে রয়েছে চার লাখের বেশি রোহিঙ্গা।নতুন আসা রোহিঙ্গাদের রাখতে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে অস্থায়ী আশ্রয় কেন্দ্রে করেছে সরকার। অন্য কোথাও রোহিঙ্গাদের পেলে তাদের সেখানে পাঠানো হচ্ছে।ইতিমধ্যে চট্টগ্রামের পতেঙ্গা, চান্দগাঁও, বাকলিয়া, হাটহাজারী, সীতাকু- এলাকায় রোহিঙ্গাদের আটক করে কক্সবাজারে ফেরত পাঠায় পুলিশ।চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি বলেন, এবার এক সঙ্গে অনেক রোহিঙ্গা এলেও চট্টগ্রাম অঞ্চলের সব জেলায় তারা ছড়িয়ে পড়েছে বলে মনে করেন না তিনি।শারদীয় দুর্গোৎসব উপলক্ষে চট্টগ্রাম রেঞ্জের ১১ জেলার পূজা উদযাপন পরিষদ এবং পুলিশ সুপারদের নিয়ে এ মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়।দুর্গাপূজায় নিরাপত্তার পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের চাপ উৎসবের আনন্দকে ম্লান করতে পারবে না বলেও মনে করেন ডিআইজি।সভায় চট্টগ্রাম রেঞ্জের এডিশনাল ডিআইজি কুসুম দেওয়ান উপস্থিত ছিলেন। এদিকে,ওপারে রেখে এসেছেন ঘর-বাড়ি; সাজানো সংসার ফেলে আসতে হয়েছে মিয়ানমারে সৈন্যদের নির্যাতন-নিপীড়নে; প্রাণ নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা এখন বেঁচে থাকার সংগ্রামে।তিন সপ্তাহ আগে মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতা শুরুর পর বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রেহিঙ্গার সংখ্যা ইতোমধ্যে ৪ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের রাখা হয়েছে কক্সবাজারের উখিয়ায়।পালিয়ে আসা যারা অস্থায়ী শরণার্থী শিবিরে প্লাস্টিক-ত্রিপলের নিচে মাথা গোঁজার ঠাঁই পেয়েছেন, তারা নিজেদের কিছুটা ভাগ্যবানই ভাবছেন। কিছু ত্রাণ পেলেও বেশির ভাগ রোহিঙ্গাদের ভাগ্যে তা জুটছে না।সরকারি, বেসরকারি আর ব্যক্তি উদ্যোগে বিভিন্ন এলাকায় গড়ে উঠা ক্যাম্পগুলো ঘুরে দেখা গেছে, গাদাগাদি করে সেখানে থাকছেন রোহিঙ্গারা। যে প্লাস্টিক-ত্রিপলে ঘরের উপরের ছাউনি, তার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকার উপায় নেই।
আশ্রয় কেন্দ্রে ঠাঁই নেওয়া মিয়ানমারের ফকিরা বাজার লেমসি পাড়া বাসিন্দা আবদুল মালেক জানালেন, শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত তার ঘরে হাড়ি উঠেনি। খেতে পায়নি তিন শিশুসহ ১০ সদস্যের পরিবারের সদস্যরা।তিন সন্তান আনিস, শোয়াইব, ফারজানা বেগমের কষ্টে বাসা থেকে বের হয়ে ছোটাছুটি করতে থাকেন বাবা মালেক। এক পর্যায়ে রিলিফের টোকেন যখন তিনি সংগ্রহ করেন, ততক্ষণে সূর্য পশ্চিমাকাশে হেলে পড়েছে।তবে সেখান থেকে যে ত্রাণ পেয়েছেন, তা দিয়ে এক বেলা চলবে বলে জানান দিন মজুরি করে জীবিকা নির্বাহ করা মিয়ানমারের এই নাগরিক।মালেক জানান, তিন সন্তানের মধ্যে ছোট ফারজানার জ্বর হয়েছে, সেই সঙ্গে পাতলা পায়খানাও। ঢাকা থেকে এক চিকিৎসক এসেছে শুনে তিনি গিয়েছিলেন মেয়েকে নিয়ে, কিন্তু টোকেন না থাকায় দেখাতে পারেননি।কুতুপালং নতুন ক্যাম্পের এই বাসিন্দা বলেন, প্রধান সমস্যা পানির। পাহাড়ের পাশে একটা ছোট খাল আছে, কিন্তু সেখানে টয়লেটের বর্জ্যও গিয়ে পড়ে। খাবার পানির জন্য অবস্থাও ভালো না।বালুখালী ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে বিভিন্ন জায়গায় কিছু চাপকল বসানো হয়েছে, স্থাপন করা হয়েছে কিছু টয়লেটও। তবে দিনের বেলায়ও এ সব টয়লেটের সামনে দীর্ঘ লাইন।
ছোট বাচ্চাকে চিকিৎসক দেখাতে আসা রওশন আরা নামে বালুখালী ক্যাম্পের এক নারী জানান, সবাই ত্রাণ পেলেও তার ভাগ্যে তা জোটেনি। চিকিৎসক আসার খবর শুনে অসুস্থ মেয়েকে নিয়ে এসেছেন, কিন্তু ওষুধ পাননি।নতুন এই ক্যাম্প এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই এলাকায় স্বাস্থ্য সেবা দিতে সকাল থেকে কয়েক ঘণ্টা বেশ কিছু মোবাইল টিম কাজ করে। তবে দুপুর গড়াতেই এ সব টিমের অধিকাংশ কাজ গুটিয়ে ফেলে।রওশন আরার সঙ্গে কথা বলার সময়ও খোলা ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের একটি সেবাকেন্দ্র। তবে নিয়ে আসা সব ওষুধ শেষ হয়ে যাওয়ায় সেখানেও চলছিল সব গুটানোর কাজ। তাই বাচ্চার চিকিৎসা পাচ্ছিলেন না তিনি। মিয়ানমারের সাব বাজারের উত্তরে ইয়াদ্দিনা পাড়ার বাসিন্দা রোকেয়া বেগম স্বামী আলী আহমদের সঙ্গে সন্তানদের নিয়ে এসেছেন।ঘর-দোর ছাই হওয়ার পর দীর্ঘ যাত্রা শেষে বাংলাদেশে এসে পৌঁছতে পারার আনন্দও বিষাদে পরিণত হয়েছে। সন্তানকে চিকিৎসক দেখানো নিয়ে ঝগড়ার পর স্বামী তাকে তাড়িয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছে।মগের দেশে অশান্তি বলে এখানে এসেছি, এখানে অশান্তি হলে কোথায় যাব, হতাশ কণ্ঠে বলেন রোকেয়া।স্বাস্থ্য সেবা নিয়ে ক্যাম্পে ক্যাম্পে কাজ করা ডা. রঘুনাথ কর্মকার বলেন, এরা বিশুদ্ধ পানি পাচ্ছে না। যথাযথ স্যানিটেশন নেই। খোলা আকাশের নিচে আছে। এই কারণে জ্বর-কাশি-নিউমোনিয়া-ডায়রিয়া এ সব রোগ বেশি হচ্ছে। কেউ কেউ অনেক দিন না খেয়ে থাকায় ‘হাইপোপ্লাইসেমিয়াতে’ ভুগছে বলেও জানান তিনি।৪ সেপ্টেম্বর থেকে কাজ শুরুর পর ১৫ হাজার মানুষকে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার দাবি করে ডা. রঘুনাথ বলেন, এখনকার মূল চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, ডায়রিয়া বা কলেরায় যাতে আক্রান্ত না হয়।শরণার্থী শিবিরের বাইরে যারা রয়েছেন, সেসব রোহিঙ্গাদের জীবন আরও কষ্টের।ক্ষুধা মেটাতে ত্রাণের আশায় রাস্তার পাশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকছেন অনেকে। ত্রাণ এলেও তা পাওয়া দুস্কর হচ্ছে দুর্বল ও বৃদ্ধদের জন্য।এদের আবার কেউ বিভিন্ন জায়গায় পাহাড়ের গাছ কেটে জায়গা করে মাথা গোঁজার ঠাঁই করছেন।সবাইকে বালুখালী নিতে সরকারি উদ্যোগের কথা এদের অধিকাংশই জানে না।এত মানুষের ঠাঁই বালুখালীতে হবে কি না, তা নিয়েও সন্দিহান তারা।ত্রাণের আশায় ঠাঁয় দাঁড়ানো অনেককে দেখা গেছে হারিয়ে যাওয়া স্বজন কিংবা পরিচিতজনদের খুঁজতে। এমনই একজন সেতারা বেগম, যার স্বামীকে মিয়ানমারের সৈন্যরা হত্যা করে বলে জানান তিনি।স্বামীর লাশটি দেখার জন্য পেছনে না তাকিয়ে তিন সন্তানকে নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসেন সেতারা। আসার সময় সঙ্গী ছিল প্রতিবেশী দুই তরুণী। এক পর্যায়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ওই প্রতিবেশীদের খুঁজছিলেন সেতারা।
সামাজিক বাস্তবতার কারণে পুরুষ আত্মীয় না থাকায় নিরাপত্তাহীনতায় ভোগার কথা জানিয়েছেন এই নারী; তাই শরণার্থী শিবিরের না থেকে বাইরে থাকছেন, ফলে অনাহারে-অর্ধাহারে কাটছে জীবন।ক্যাম্পের বাইরে যে সব জায়গায় মানুষ আবাস গড়ছে, সে সব এলাকায় স্যানিটেশনের কোনো ব্যবস্থাও নেই। দিন যত যাচ্ছে, এসব এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠছে, বাড়ছে দুর্গন্ধ।গত কয়েকদিন ধরে ওই এলাকায় থাকা সাবেক সাংবাদিক এবং বর্তমানে এনজিও কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, এখন এখানকার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ খাদ্য-পানি-স্যানিটেশনের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করতে হবে।

এদিকে, রোহিঙ্গা সঙ্কটের মধ্যে কক্সবাজারে গ্রেপ্তার মিয়ানমারের দুই আলোকচিত্র সাংবাদিককে কারাগারে পাঠিয়েছে আদালত।পরিচয় গোপন ও মিথ্যা তথ্য দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ বুধবার উখিয়া সীমান্ত এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করে।মিনজাইয়ার উ ও হকুন লাট নামে মিয়ানমারের দুই নাগরিক জার্মানির হামবুর্গভিত্তিক ‘জিও’ সাময়িকীতে কাজ করেন বলে জানিয়েছেন।কক্সবাজারের এএসপি আফরুজুল হক টুটুল বলেন, “গ্রেপ্তারের পরদিন (বৃহস্পতিবার) তাদের কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম রাজীব কুমার দেবের আদালতে হাজির করা হয়। আদালত আসামিদের করা জামিন আবেদন নাকচ করে জেল হাজতে পাঠানোর আদেশ দেন। তিনি বলেন, উখিয়া সীমান্ত এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করার সময় ওই দুজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।তারা সাংবাদিক পরিচয় গোপন রেখে ট্যুরিস্ট ভিসায় বাংলাদেশে এসে কক্সবাজারের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা থেকে ছবি তুলছিলেন এবং সরকারি কর্মকর্তাদের মিথ্যা তথ্য দিয়ে তথ্য সংগ্রহ করছিলেন। গ্রেপ্তার দুই মিয়ানমারের নাগরিক জিও ম্যাগাজিনে কাজ করার দাবি করেছেন বলে এএসপি আফজারুল জানান।এদিকে জার্মানির জিও সাময়িকী কর্তৃপক্ষ মিনজাইয়ারি ও হকুনকে কারাগারে পাঠানোর খবর শুনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বলে মিয়ানমারার গণমাধ্যমে খবর এসেছে।মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশে সহিংসতার কারণে লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে ঢুকেছে। সীমান্তে এই বিপর্যয়কর পরিস্থিতির ছবি সংগ্রহ করতে মিনজাইয়ারি ও হকুনকে এসেছিলেন বলে মিয়ানমারের গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়।আদালতে এই দুই বিদেশির পক্ষের আইনজীবী জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, আগামী মঙ্গলবার কক্সবাজার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালতে আবার জামিন আবেদন করা হবে। এতেও জামিন পাওয়া না গেলে উচ্চ আদালতে যাবেন তারা।