ব্যাংকিং খাতে ঝুঁকিপূর্ণ ঋণের বিপরীতে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা সঞ্চিতি (প্রভিশন) সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়েছে ছয়টি ব্যাংক।এ তালিকায় রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি খাতের তিনটি করে ব্যাংক রয়েছে।চলতি বছরের জুন শেষে এসব ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৮ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি হয়েছে ৭ হাজার ৩৬৩ কোটি টাকা; যার ৩ হাজার ৮০ কোটি টাকাই বেসিক ব্যাংকের। আগের প্রান্তিক মার্চ পর্যন্ত এ ছয় ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল প্রায় ৭ হাজার ৪৯৩ কোটি টাকা। ফলে তিন মাসের ব্যবধানে তাদের হাজার কোটি টাকারও বেশি প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে।এ সময়ে কয়েকটি ব্যাংকের উদ্বৃত্ত থাকায় সার্বিক ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৬ হাজার ১৯২ কোটি টাকা; যা আগের প্রান্তিক মার্চে ছিল ৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সংশ্লিষ্টরা জানান, প্রভিশন ঘাটতি থাকলে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারে না। এতে নিরুৎসাহিত হন বিনিয়োগকারীরা। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রয়োজনীয় প্রভিশন সংরক্ষণে ব্যর্থ হয়, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণেই প্রভিশন ঘাটতি বেড়েছে। আর ব্যাংকগুলোকে আয়ের খাত থেকে অর্থ এনে এ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়। এতে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা লভ্যাংশবঞ্চিত হন। এছাড়া যেসব ব্যাংক প্রভিশন ঘাটতিতে রয়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
জানা গেছে, ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের যে পরিমাণ ঋণ বিতরণ করে তার বেশিরভাগই আমানতকারীদের অর্থ। আমানতকারীদের অর্থ যেন কোনো ধরনের ঝুঁকির মুখে না পড়ে, সেজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নানা বিধি-নিষেধ আরোপ করা আছে। এর একটি হলো প্রভিশন সংরক্ষণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, ব্যাংকের অশ্রেণিকৃত বা নিয়মিত ঋণের বিপরীতে দশমিক ২৫ থেকে ৫ শতাংশ হারে প্রভিশন রাখতে হয়। নিম্নমান বা সাব-স্ট্যান্ডার্ড ঋণের বিপরীতে রাখতে হয় ২০ শতাংশ, সন্দেহজনক ঋণের বিপরীতে ৫০ শতাংশ এবং মন্দ বা কুঋণের বিপরীতে ১০০ শতাংশ প্রভিশন সংরক্ষণ করতে হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের জুন শেষে ব্যাংকিং খাতে প্রভিশন সংরক্ষণের প্রয়োজন ছিল ৪৩ হাজার ৬৪০ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এর বিপরীতে সংরক্ষণ করা হয়েছে ৩৭ হাজার ৪৪৯ কোটি টাকা। ফলে ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৬ হাজার ১৯১ কোটি ৬৯ লাখ টাকা। আগের প্রান্তিক মার্চ শেষে এ খাতে প্রভিশন ঘাটতি ছিল প্রায় ৫ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। আর ডিসেম্বর প্রান্তিকে ছিল প্রায় ৫ হাজার ৪৭০ কোটি টাকা। প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ সময়ে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে ৭ হাজার ৩৬৩ কোটি ২৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ৮০৯ কোটি ৩৪ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৭৩ কোটি ৮০ লাখ ও বেসিক ব্যাংকের ৩ হাজার ৮০ কোটি ১১ লাখ টাকা ঘাটতি রয়েছে। আগের প্রান্তিক মার্চে এ তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ৬ হাজার ৪৭৯ কোটি ৩৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে সোনালী ব্যাংকের ২ হাজার ১০৩ কোটি ৫১ লাখ, রূপালী ব্যাংকের ১ হাজার ৪৯৫ কোটি ৮৩ লাখ ও বেসিক ব্যাংকের ২ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা ঘাটতি ছিল।
এ সময়ে বেসরকারি খাতের তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে ১ হাজার ১৭০ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৭২৬ কোটি ৮৮ লাখ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৬৯ কোটি ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ১৭৪ কোটি ৯১ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি রয়েছে। আগের প্রান্তিক মার্চে এ তিন ব্যাংকের প্রভিশন ঘাটতি ছিল ১ হাজার ১৩ কোটি ৮৯ লাখ টাকা। এর মধ্যে ন্যাশনাল ব্যাংকের ৫১১ কোটি ২৬ লাখ, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংকের ২৮৯ কোটি ৯৩ লাখ ও প্রিমিয়ার ব্যাংকের ২১২ কোটি ৭০ লাখ টাকা প্রভিশন ঘাটতি ছিল।বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রাপ্ত তথ্যে আরও দেখা যায়, চলতি বছরের মার্চ প্রান্তিক শেষে সরকারি-বেসরকারি মিলে ৯ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ছিল। এর মধ্যে সরকারি খাতেরই সাতটি। এগুলো হলো সোনালী, জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক। সরকারি ব্যাংকগুলোর বাইরে মূলধন ঘাটতির তালিকায় ছিল দুইটি বেসরকারি ব্যাংকও। এগুলো হলো বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ও আইসিবি ইসলামী ব্যাংক। বর্তমানে ব্যাংকগুলোকে ৪০০ কোটি টাকা অথবা ঝুঁকিভিত্তিক সম্পদের ১০ শতাংশের মধ্যে যেটি বেশি সেই পরিমাণ অর্থ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করতে হয়।