ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আলোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে বৈঠকের একদিন পর বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।ক্ষমতাসীন দলের এই নেতা বলছেন, রায় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রকৃত অবস্থান জানাতেই তার এই সাক্ষাৎ। সোমবার বেলা ১২টা ২০ থেকে এক ঘণ্টা বঙ্গভবনে অবস্থান করেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী কাদের।বেরিয়ে এসে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীর অবজারভেশনের বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের পার্টির অবস্থানের কথা মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেছি। রায় নিয়ে আমাদের দলের প্রকৃত অবস্থান কী সেই বিষয়ে ব্যাখ্যা করেছি।যেহেতু রাষ্ট্রপতি রাষ্ট্রের অভিভাবক, প্রধান বিচারপতি তিনিই নিয়োগ দেন। তাকে আমি বিষয়টি জানিয়েছি। প্রধান বিচারপতির সঙ্গে যেসব কথাবার্তা হয়েছে সে বিষয়েও রাষ্ট্রপতিকে অবহিত করেছি।
সোমবার দুপুরের দিকে বঙ্গভবনে গিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ওবায়দুল কাদের। সাক্ষাতের বিষয়ে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের জ্যেষ্ঠ তথ্য কর্মকর্তা আবু নাসের প্রথম আলোকে বলেন, গত শনিবার রাতে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বাসভবনে যান মন্ত্রী। সেখানে দুজনের মধ্যে বৈঠক হয়। এই বৈঠকের বিষয়বস্তু আজ রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতে অবহিত করেছেন সেতুমন্ত্রী।আওয়ামী লীগ সূত্র জানায়, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে সাক্ষাতের আগে ওবায়দুল কাদের দলীয় প্রধান ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোনে বিষয়টি অবহিত করেন। সাক্ষাতের পর গতকাল রোববার সকালে গণভবনে গিয়ে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীকে বৈঠকের আলোচনা সম্পর্কে অবহিত করেন।ওবায়দুল কাদেরের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আরও বৈঠক হবে।সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় নিয়ে সরকার, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ বিভিন্ন মহলে চলমান আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে ওবায়দুল কাদেরের সাক্ষাৎ হয়।সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণার রায়ের পর্যবেক্ষণে আসা অনভিপ্রেত বিষয়গুলো বাদ দেওয়াই আওয়ামী লীগের মূল লক্ষ্য বলে সূত্র জানিয়েছে।সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর এ নিয়ে সরকার ও ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংক্ষুব্ধ হয়েছে। এই রায়, বিশেষ করে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ নিয়ে ক্ষোভ ও অসন্তোষ প্রকাশ করছেন মন্ত্রী, দলীয় নেতা ও সরকারপন্থী আইনজীবীরা।আওয়ামী লীগ মনে করছে, রায়ের পর্যবেক্ষণে রাজনীতি রয়েছে। এর পেছনে ষড়যন্ত্রও থাকতে পারে। এ জন্য এই রায়কে যতটা সম্ভব প্রশ্নবিদ্ধ করার কৌশল নেওয়া হয়েছে বলে আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে।রায়কে ঐতিহাসিক হিসেবে বর্ণনা করে অবিলম্বে সরকারের পদত্যাগ দাবি করে আসছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি।২ আগস্ট ষোড়শ সংশোধনী বাতিলসংক্রান্ত পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর প্রায় এক সপ্তাহ সরকার ও আওয়ামী লীগ প্রায় নীরব ছিল। মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় এই রায় নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করা হয়। এরপর থেকেই সরকারের মন্ত্রীরা প্রকাশ্যে রায় নিয়ে সমালোচনা করে বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন
রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ঘণ্টাখানেকের এই সাক্ষাতে কিশোরগঞ্জে তার এলাকার রাস্তা-ঘাটসহ বিভিন্ন বিষয়েও খোঁজখবর নিয়েছেন বলে সড়কমন্ত্রী জানান।মহামান্য রাষ্ট্রপতি সব সময় তার এলাকায় বাই রোডে যেতে পারেন না- সব সময় দুঃখ করে এ কথা বলেন। আমরা উনার এলাকার রাস্তা তৈরির যে কাজ করছি সে বিষয়ে কথা বলতে এসেছি।কথা প্রসঙ্গে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের পর্যবেক্ষণের বিষয়টি সামনে আসে বলে তিনি।কাদেরের সাক্ষাতের কিছুক্ষণ আগে জন্মাষ্টমী উপলক্ষ্যে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় শেষ করে করে বঙ্গভবন ছাড়েন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।তার সঙ্গে দেখা হয়েছে কি না জানতে চাইলে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বলেন, তার সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। এখানে যে অনুষ্ঠান আছে আমার জানা ছিল না।রায় পুনর্বিবেচনার আবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে সরকারের এই মন্ত্রী বলেন, প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে, শেষ হওয়ার আগে কোনো মন্তব্য করা যাবে না।প্রধান বিচারপতির বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতাদের ‘আক্রমণাত্মক’ বক্তব্যের মধ্যে শনিবার রাতে কাকরাইলে তার বাসভবনে সাক্ষাত করেন ওবায়দুল কাদের।উচ্চ আদালতের বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদের যে পরিবর্তন ষোড়শ সংশোধনীতে আনা হয়েছিল, তা অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায় গত ১ অগাস্ট প্রকাশ করে সুপ্রিম কোর্ট।
ওই রায়ের পর্যবেক্ষণে প্রধান বিচারপতি দেশের রাজনীতি, সামরিক শাসন, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি, সুশাসন ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে পর্যবেক্ষণ তুলে ধরেন।তাতে ‘বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কটাক্ষ ও অবমূল্যায়ন করা হয়েছে’ অভিযোগ তুলে রায়ে সংক্ষুব্ধ সরকারি দল কড়া সমালোচনা করছে। তবে বিএনপি রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ বলছে।আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ও অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম রায়ের পর্যবেক্ষণের আপত্তিকর’ মন্তব্য ‘এক্সপাঞ্জ’ (বাদ) দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়ার কথা বললেও কীভাবে তা করা হবে বিষয়টি স্পষ্ট করেননি। আওয়ামীপন্থি আইনজীবীরা আদালত স্বতপ্রণোদিত হয়ে এক্সপাঞ্জ করবে বলে দাবি করলেও জেষ্ঠ আইনজীবী ও অন্যতম সংবিধান প্রণেতা কামাল হোসেন বলছেন, রায়ে এক্সপাঞ্জ করার মতো কিছু নেই। স্বতপ্রণোদিত হয়ে এক্সপাঞ্জ করারও বিধান নেই । তার জন্য আবেদন করতে হবে।