ষোড়শ সংশোধনীর ৭৯৯ পৃষ্ঠার রায় শুরু হয়েছে একটি উদ্ধৃতি দিয়ে। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা ভারতের বিচারপতি ভিভান বোসের ১৯৫৪ সালের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে তাঁর রায় শুরু করেছেন। যেখানে বিচারপতি বোস সুপ্রিম কোর্টের ক্ষমতাকে ‘ফ্লেমিং সোর্ড’ বা অগ্নি তলোয়ারের সঙ্গে তুলনা করেছেন। মাননীয় প্রধান বিচারপতি এর পরপরই আমাদের সংবিধানের ১০৪ অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করেছেন এবং বলেছেন সংবিধান সুরক্ষায় আপিল বিভাগের দায়িত্ব ও ক্ষমতার কথা।

প্রধান বিচারপতির এই কাব্যিক এবং প্রাঞ্জল লেখার পরই আপনার চোখের সামনে ভেসে উঠবে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্টের দালানটি। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের মূল স্তম্ভের একটি। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার দায়িত্ব এই ভবনের। সংবিধান সুরক্ষার জন্য অতন্দ্র প্রহরীর মতো ‘ফ্লেমিং সোর্ড’ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা এই বিচারালয়ের। সুপ্রিম কোর্ট আমাদের সংবিধানের রক্ষক। আর প্রধান বিচারপতি হলেন, এই প্রতিষ্ঠানের অভিভাবক।

কিন্তু ইতিহাসের নির্মাতা হলো আমাদের প্রধান বিচারপতিদের অনেকেই সংবিধানের রক্ষক হতে পারেননি। দুঃসময়ে তাঁদের অগ্নি তরবারি ঝিলিক দেখা যায়নি। বাংলাদেশের প্রথম প্রধান বিচারপতি ছিলেন বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টে যখন একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপ্রধানকে হত্যা করা হলো তখন তাঁর তরবারি কোথায় ছিল? যখন খন্দকার মোশতাক মৌলিক মানবাধিকার সংক্রান্ত সংবিধানের ধারা স্থগিত করলেন, তখন কোথায় ছিলো সুপ্রিম কোর্টের নিঃসঙ্কোচিত্তের বিচারপতিরা? জাতির পিতাকে স্বপরিবারে হত্যার পর খুনী জিয়া-মোশতাক জারী করলো ঘৃন্য কালো আইন ‘ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ’। তখন আমাদের সুপ্রীম কোর্ট কেন নির্বিকার ছিলো? কেউ কি বলেছিলেন, এই ক্ষমতা গ্রহণ অবৈধ, সংবিধানের মৌলিক চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক? আমরা দেখলাম ৭ নভেম্বর বিচারপতি সায়েম লাফ দিয়ে বঙ্গভবন চলে গেলেন। শপথ নিলেন অবৈধ ও অসংবিধানিক সরকারের রাষ্ট্রপতি হিসেবে। তখন কোথায় ছিল আমাদের পবিত্র সংবিধান? ১৯৭৭ সালের এপ্রিলে খুনী জিয়া বঙ্গভবনে ঢুকলেন অস্ত্র নিয়ে, রীতিমতো ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিলেন বিচারপতি সায়েমকে। সেনা প্রধান থাকা অবস্থায় নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন। এই স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতিকে কি ধমক দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট? সুপ্রিম কোর্ট কি বলেছিল, এটা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক? না বলেনি, বরং তার শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন একজন প্রধান বিচারপতি।

বিচারপতি সায়েমের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় বিচারপতি হিসেবে ১৮ নভেম্বর ১৯৭৫ সালে শপথ নেন সৈয়দ এ বি এম মাহমুদ হাসান। তাঁর নেতৃত্বে বিচার বিভাগ হজম করে একের পর এক সাংবিধান কাঁটা ছেড়া। জিয়া বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে রক্তাক্ত করেন সংবিধানকে। উঠিয়ে দেন ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র। কিন্তু জাতি তখন কোনো ‘অগ্নি তলোয়ার’ দেখল না । বিচারপতি কামাল উদ্দিন আহমদ দেশের তৃতীয় প্রধান বিচারপতি হিসেবে শপথ নেন ১ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৮ সালে। তিনি শপথ নেন উর্দি পরা একনায়ক জেনারেল জিয়ার কাছ থেকে। ওই শপথ কি বৈধ ছিল? বিচারপতি কামাল উদ্দিন প্রধান বিচারপতি থাকা অবস্থায় দেশে আবার সামরিক শাসন জারি হয়। সিংহাসনে বসেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তখন কোথায় ছিলেন সংবিধানের রক্ষা কর্তা? আহা তখন যদি তিনি বিচারপতি বোসের অমর বাণী স্মরণ করতেন। এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলের পর তার ‘অবৈধ রাস্ট্রপতি’ পদ অলংকৃত করেন একজন বিচারপতি পতি, তাঁর নাম বিচারপতি আহ্সান উদ্দিন চৌধুরী। এরশাদ রাষ্ট্রপতি হয়ে দুজনকে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ দেন ১ ডিসেম্বর ১৯৮৯ সালে। মাত্র ৩১ দিনের জন্য প্রধান বিচারপতি হন বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী। ১৪ জানুয়ারি ১৯৯০ এ প্রধান বিচারপতি হন সাহাবুদ্দিন আহমদ। সাহাবুদ্দিন আহমদ ডিসেম্বরে এই শর্তে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হন যে, তাঁকে আবার স্বপদে অর্থাৎ প্রধান বিচারপতি পদে ফিরিয়ে আনা হবে। হায়রে ‘জনগণ’, ব্যক্তির স্বার্থে সংবিধানের বলিদান, অগ্নি তলোয়ার চুপটি করে দেখে। সংবিধান একাদশ সংশোধনী কী সংবিধান চেতনার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।

তাই আমি জানতে চাই, সুপ্রীম কোর্ট কি সংবিধানের রক্ষক নাকি সব অবৈধ ক্ষমতাদখলকে বৈধতা দেয়ার প্রতিষ্ঠান? তাই ষোড়শ সংশোধনীর রায় নিয়ে আমার প্রশ্ন, কাকে খুশী করতে এই রায়?