বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় দুই আসামীর মৃত্যুদন্ড বহাল রেখে রায় ঘোষণা করেছে হাইকোর্ট। রোববার বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তী সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্টের একটি ডিভিশন বেঞ্চ এ রায় দেয়। মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদার (পলাতক)।মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথরেফারেন্স ও আপিলের শুনানি শেষে গত ১৭ জলাই রোববার রায় ঘোষণার দিন ধার্য করে দেয় হাইকোর্ট।
বিচারিক আদালতের রায়ে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্তরা হলেন-রফিকুল ইসলাম শাকিল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, সাইফুল ইসলাম, কাইয়ুম মিঞা টিপু, রাজন তালুকদার ও মীর মো. নূরে আলম লিমন। এদের মধ্যে আজ রায়ে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের মৃত্যুদন্ড বহাল, মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ, জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন, ও মীর মো. নূরে আলম লিমনের (পলাতক) মৃত্যুদন্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদন্ড এবং বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিয়া টিপুকে হাইকোর্ট খালাস দিয়েছে। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন সাজা পাওয়া আসামী গোলাম মোস্তফা ও এএইচএম কিবরিয়াকেও আজ রায়ে খালাস দেয়া হয়েছে।বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দুজন আপিল করেছিলেন, তারা হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন।পলাতক থাকা বাকি ১১ জনের বিষয়ে হাই কোর্টের রায়ে কোনো মন্তব্য করা হয়নি। ফলে তাদের ক্ষেত্রে আগের সাজাই বহাল থাকছে।এ মামলার ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যৃদ- অনুমোদন) ও আসামিদের আপিলের রায়ের শুনানি করে বিচারপতি মো. রুহুল কুদ্দুস ও বিচারপতি ভীষ্মদেব চক্রবর্তীর হাই কোর্ট বেঞ্চ রোববার এ রায় দেয়।রায়ে বলা হয়েছে, এটা পূর্ব পরিকল্পিত হত্যাকান্ড না হলেও আসামিদের সম্মিলিত হামলার ফলেই বিশ্বজিতের মৃত্যু হয়েছে।কিন্তু সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে গাফিলতির কারণে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা হাই কোর্টে এসে কমে গেছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে আঘাতের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আসামিদের জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বর্ণনার মিল পায়নি আদালত।ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুজ্জামান জানান বলেন, বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কি না- তা তদন্ত করে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত।
আর ময়নতদন্ত করার ক্ষেত্রে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডা. মাহফুজুর রহমানের কোনো গাফিলতি ছিল কি না- তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হা কোর্ট।এই আদেশ ঠিকমত বাস্তবায়িত হচ্ছে কি না- সে বিষয়ে মানবাধিকার বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনজীবী মনজিল মোরসেদকে সময়ে সময়ে আদালতে জানাতে বলা হয়েছে।এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে সিদ্ধান্ত তারা পূর্ণাঙ্গ রায় দেখার পর নেবেন।এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পলাতক যে ১১ আসামির বিষয়ে হাই কোর্ট রায়ে কোনো মন্তব্য করেনি, গ্রেপ্তার হলে বা আত্মসমর্পণ করলে তাদের বিষয়ে পরবর্তী বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হবে।
রায়ে ২১ আসামীর মধ্যে বিচারিক আদালতে মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত আসামিদের ডেথরেফারেন্স ও আসামীদের দায়ের করা আপিলের শুনানি শেষে ২ জনের মৃতুদন্ড বহাল, ৪ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড, ৪ জনকে খালাস দেয়া হয়েছে। আপিল না করা পলাতক ১১ আসামীর বিষয়ে কোন কিছু বলেনি আদালত। এ বিষয়ে আইনজীবীরা জানায়, পলাতকদের বিচারিক আদালতের দেয়া যাবজ্জীবন সাজা রায়ই বহাল থাকল। বিচারিক আদালতে যাবজ্জীবন কারাদন্ড সাজা পাওয়া পলাতক ১১ আসামী হচ্ছেন- ইউনুস আলী, তারিক বিন জোহর তমাল, আলাউদ্দিন, ওবায়দুর কাদের তাহসিন, ইমরান হোসেন, আজিজুর রহমান, আল-আমিন, রফিকুল ইসলাম, মনিরুল হক পাভেল, মোশাররফ হোসেন ও কামরুল হাসান।
শুনানিকালে আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে যুক্তিতর্ক উপস্থাপন করেন ডেপুটি এটর্নি জেনারেল নজিবুর রহমান। আসামিদের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী ও আইনজীবী শাহ আলম।আজ হাইকোর্ট আসামীদের বিষয়ে রায় ঘোষণা ছাড়াও হত্যার শিকার বিশ্বজিতের মরদেহের সুরতহাল ও ময়না তদন্তের সঙ্গে জড়িত পুলিশ কর্মকর্তা এবং সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে তাদের কর্তৃপক্ষের প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন। আদালত সূত্র জানায়, পেশাগত অসদাচরণ বিষয় প্রতীয়মান হওয়ায় এ আদেশ দেয়া হয়।
বহুল আলোচিত বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর ৮ জনকে মৃত্যুদন্ড ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয় বিচারিক আদালত। এছাড়া তাদের প্রত্যেককে ২০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ডও দেয়া হয় অনাদায়ে ১ বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেয়া হয়।ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক এবিএম নিজামুল হক এ রায় ঘোষণা করেন। রায়ের এক সপ্তাহের মধ্যে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ডেথরেফারেন্স হাইকোর্টে আসে। পাশাপাশি বিচারিক আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও আপিল করেন আটক আসামিরা।বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় ২০১৩ সালের ৫ মার্চ ২১ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেয় মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এ ২১ আসামির মধ্যে ৮ জন কারাগারে এবং বাকিরা পলাতক। ২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোটের অবরোধ কর্মসূচি চলাকালে রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি)ছাত্রলীগের কর্মী পরিচয়দানকারী উল্লেখিত আসাীরা নির্মমভাবে খুন করে বিশ্বজিৎ দাসকে। শাখারীবাজারে বিশ্বজিতের একটি টেইলার্স ছিল। তিনি থাকতেন লক্ষ্মীবাজার। গ্রামের বাড়ি শরীয়তপুর।এ হত্যার ঘটনায় রাজধানীর সূত্রাপুর থানায় মামলা করা হয়। এ হত্যার ঘটনা গণমাধ্যমে প্রকাশ ও প্রচার হলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়। সে আলোকে দায়ীদের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নেয় সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।