আগামীকাল পহেলা আগস্ট। দীর্ঘ ৬৮ বছরের অমানবিক জীবনযাত্রার যাঁতাকলে পরাধীনের গ্লানি কেটে স্বাধীনতার দুবছরে পদার্পণ। ৫৫ হাজার জনমানুষের সভ্যতার আলোয় আলোকিত হওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। অর্থাৎ ২০১৫ খ্রিস্টাব্দের ১ আগস্টের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশ এবং ভারতের অভ্যন্তরে থাকা রাষ্ট্রীয় অধিকার বঞ্চিত ঐ মানুষ গুলো তাদের রাষ্ট্রী অধিকার ফিরে পেয়েছেন। যা সভ্য পৃথিবীর এক ঐতিহাসিক দলিল। তাই বলা চলে প্রতি পহেলা আগস্ট ছিটমহলবাসীর স্বাধীনতা দিবস।
মুজিব-ইন্দ্রিরা গান্ধী থেকে শুরু করে হাসিনা- নরেন্দ্র মোদি পর্যন্ত। বহু চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্থাপিত হয়েছে মানবতার মেইল বন্ধন। পরিমার্জিত হয়েছে সভ্যতার ইতিহাস। আমরা যাদের ছিটমহলবাসী হিসেবে জেনেছি, চিনেছি তাঁরাই আজ সভ্যতার মূলধারায়। তারা আজ স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক।
ভারতের অভ্যন্তরে থাকা বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহলের প্রায় ১৫ হাজার জন-মানুষ এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ভারতের ১১১টি ছিটমহলের ৩৮ হাজার ১শ ৮১ জন মানুষ এখন রাষ্ট্রীয় অধিকারের আওতায়।
সভ্যতা কাকে বলে, রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধার কি? স্বাধীন – পরাধীন কি তা তাঁরা বুঝতে পারছেন। নব্য-সভ্যতার আলো-আঁধার তারা অনুভব করছেন।
বেশিদিনের কথা নয়, মাত্র দু’বছর সভ্যতার আলো পাওয়া মানুষ জনদের আশা-আকাঙ্খা, চাওয়া-পাওয়া কতটুকুই বা বাস্তবায়িত হয়েছে?
নব্য বাংলাদেশের ১১১টি ছিটমহলের আদি-অন্ত দিক-দিগন্ত জানার চেষ্টা করেছি, জানা সম্ভব হয়নি। তবে চর্মচক্ষে অবলোকন করা সম্ভব হয়েছে।
ছিটমহল বিনীময়কালে ভারত-বাংলাদেশের কাছ থেকে মোট ৭ হাজার ১শত দশ দশমিক ২ একর জমি জমি পেয়েছে। বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী ওই জমির জনসংখ্যা ১৭ হাজার।
অপর দিকে ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশ পেয়েছে মোট ১৭ হাজার ১শত ৫৮ দশমিক ১৩ একর জমি। যে জমির অধিবাসী ৩৪ হাজার। উভয় ভূ-খন্ডের মোট প্রায় ৫৫ হাজার জনমানুষের মধ্যে বাংলাদেশের বর্তমান অংশ থেকে ভারতে পাড়ি জমিয়েছে এপাড়ের ৯শ ৯৪ জন মানুষ। অথচ ওপার থেকে এপারে কোন লোকজন আসে নাই। কে আসছে, কে আসেনি তা বড় কথা নয়। উভয় প্রান্তের নব্য সভ্যতার জনমানুষরা কি চেয়েছিল, কি পেয়েছে, কি পাচ্ছে, কি পাবে, সেটাই বড় কথা।
ছিটমহল বিনিময় হওয়ার প্রাক্কালে বাংলাদেশ সরকার নব্য বাংলাদেশীদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ২শ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দেন। অপরদিকে ভারত সরকার নব্য ভারতীয়দের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের জন্য ১ হাজার ৩শ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকা ১১১টি ছিটমহলের নব্যবাংলাদেশীরা ২ বছরের ব্যবধানে পেয়েছে পাঁকা রাস্তা, ব্রীজ-কালভাট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, মসজিদ-মন্দির, কমিউনিটি সেন্টার, কমিউনিটি ক্লিনিক, বিদ্যুৎ সংযোগ, ভোগ করছে বয়স্ক, বিধবা ও প্রতিবন্ধী ভাতা। আইনশৃংখলা রক্ষায় স্থাপিত হয়েছে পুলিশ ফাঁড়ি, যোগাযোগ তড়ান্বিত করায় বসানো হয়েছে পোস্ট অফিস, পর্যাপ্ত সুযোগ-সুবিধার সৃষ্টি করা হয়েছে ব্যাংক-বীমায়, জিও ও এনজিও সমান্তরাল উন্নয়ন কাজে সহযোগিতা দিচ্ছে। শুধু তাই নয়, উপজেলা ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানদের স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নব্যবাংলাদেশীদের সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করার। অপর দিকে বিনিময়ে স্থান পরিবর্তিত বাংলাদেশের অংশের ৯শ ৯৪ জন নব্য ভারতীদের ভাগ্যে ২ বছর মেয়াদী রেশন ব্যতিত কোন প্রকার রাষ্ট্রীয় সুযোগ সুবিধা মেলেনি।
তবে আরজ আলী মাতাব্বরে ন্যায় মাথা গোঁজার ঠাই হিসেবে ২কক্ষ বিশিষ্ট টিনসেড তারা পেয়েছেন। যে ঘরে স্বামী-স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে মিলে অবর্ণনীয় কষ্টে দিনাতিপাত করছে। ছিটমহলে থাকাকালে যাঁদেরকে কেন্দ্র করে আন্দোলনের নামে অনেক অখ্যাত ব্যক্তিরা বিখ্যাত হয়েছে, আজ তারা তাদের দুর্দিনে ধারের কাছেও নেই। তথা কথিত এক ব্যক্তি, যিনি “কাঁটা তারে অবরুদ্ধ ছিটমহল” নামক বইয়ের লেখক তিনি এখন ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তি হিসেবে ইতিহাস সৃষ্টির স্নায়ুযুদ্ধে নেমেছে। ভারত-বাংলাদেশ চষে বেড়াচ্ছে। অপর দিকে ছিটমহল বিনিময় আন্দোলনের অগ্রনায়ক দীপ্তিমান সেনগুপ্ত নব্যভারতীয়দের নিয়ে রাজনীতি করতে গিয়ে ধরাসায়ি।
স্বাধীন ছিটমহলের দু’বছর পুর্তির এই দিনে আমার মত অনেকই চায়, নব্যভারতীয় ৫১টি ছিটমহলের অধিবাসীরা সত্যিকার অর্থেই ভারত সরকারের সু-দৃষ্টিতে পড়–ক। তাদের নিয়ে নোংরা রাজনীতি বন্ধ হোক। প্রতিষ্ঠাপাক মানবতা, গড়ে উঠুক সভ্যতা। পরিপূর্ণ হোক ইতিহাস।