টানা বৃষ্টিতে রাজধানীজুড়ে তীব্র জলাবদ্ধতার কারণে ঢাকা জুড়ে চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয় হাজারো মানুষকে।নগরবাসীর অভিযোগ,নগরীতে গণপরিবহনের সুষ্ঠু কোনও ব্যবস্থাপনা না থাকায়, বছরের পর বছরজুড়ে নগরবাসীকে এমন পরিস্থিতির শিকার হতে হচ্ছে। এ নিয়ে বিআরটিএসি ও সিটি করপোরেশনসহ সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কোনও উদ্যোগ নেই।কোনও কোনও এলাকায় গণপরিবহন ছিল কমদুপুরের দিকে নগরীর পূর্ব মাদারটেক,বনশ্রী, খিলগাঁও, ফকিরাপুল, মতিঝিল, প্রেসক্লাবসহ বিভিন্ন এলাকায় এমন চিত্র দেখা গেছে। এসব এলাকায় একদিকে যেমন যানবাহন সংকট, অন্যদিকে যানজটের কারণে চরম দুর্ভোগে পড়তে হয়েছে ঘরের বাইরে আসা মানুষদের। বর্ষার শুরু থেকে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে ঢিলে তালে চলছে উন্নয়ন কাজের খোঁড়াখুড়ি। বৃষ্টি হলেই শুরু হয় জলাবদ্ধতা। এ কারণে কোথাও দেখা দেয় গণপরিবহন সংকট, আবার কোথাও ঘন্টার পর ঘণ্টা যানজটে স্থবির হয়ে যায় নগরী। বুধবার সকাল থেকে পরিবহন সংকট আর যানজটের তীব্রতা ধারণ করে অসহনীয় পর্যায়ে। এ কারণে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছাতে বেগ পেতে হয়েছে কর্মব্যস্ত মানুষদের।
সকাল ১০ টা ৪০ মিনিটে গণভবনের সামনে এসে দাঁড়ায় মিলি রহমানের ব্যক্তিগত গাড়ি। সঙ্গে আট বছরের সন্তান সাহিল। বাইরে কখনও হালকা কখনও তীব্র বৃষ্টি। শুরুতে মা ছেলে গল্প করে, মোবাইলে গেম খেলে সময় কাটালেও ১৫ মিনিট পর দেখেন প্রায় সব গাড়ির স্টার্ট বন্ধ করে দিয়েছে। এভাবেই কেটে যায় একঘণ্টা। এই সময়ের মধ্যে গাড়ি গণভবনের সিগন্যালের ওপার থেকে এপার আসে। তার বাসা শ্যামলী, যাবেন সায়েন্সল্যাব। সেখান থেকে যে বাড়ি ফিরে যাবেন তেমন অবস্থাও নেই। বাইরে বৃষ্টি তাই নেমে হাঁটারও উপায় নেই। দেড় ঘণ্টা পর তিনি আসাদ গেটে পৌঁছান। পরে বাধ্য হয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে বাড়িরে দিকে রওনা দেন।কেবল মিলি না,যারাই আজ রাজধানীতে পথে বের হয়েছেন তাদের যানজটে নাকাল হতে হয়েছে। রাস্তার কোথাও কোথাও একেবারে যানবাহন শূন্য ছিল। আবার কোথাও গাড়িগুলো এমনভাবে আটকে আছে যে নড়ার উপায় নেই।মানিক মিয়া এভিনিউয়েও পানি থৈ থৈ করছে। ধানমন্ডি ১৬ নম্বর (পুরনো ২৭ নম্বর) এক কোমর পানি। ইঞ্জিনে পানি ঢুকে যাওয়ায় রাস্তায় বন্ধ পড়ে আছে সিএনজিচালিত অটোরিকশা,প্রাইভেট কার। বৃষ্টিতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে প্রায় হাঁটুসমান জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। এতে চরম দুর্ভোগে পড়েছেন সচিবালয়ের কর্মী ও দর্শনার্থীরা। বুধবার দুপুর ১২টার দিকে সচিবালয়ের প্রধান ফটকের সামনের রাস্তা থেকেই ব্যাপক জলাবদ্ধতা দেখা যায়। ফটকের সামনেও একই চিত্র। কোনোমতে ফটক পর্যন্ত এলেও এরপর চলাচলের পথটা পানিতে একদম ডুবে গেছে। সচিবালয়ের ভেতরের প্রাঙ্গণও ডুবে রয়েছে।কথা হয় সিএনজি চালক সোহরাব হোসেনের সঙ্গে। ১৬ নম্বরের মাথায় স্টার্টবন্ধ হয়ে গেছে তার সিএনজির। তিনি বলেন,‘দেড়ঘণ্টা জ্যাম ঠেলে ৩০ সেকেন্ডের পথ পাড়ি দিয়ে আসছি। এরপর স্টার্ট বন্ধ হয়ে গেল। আজ সারাদিনের ইনকাম বন্ধ।পানির কারণে এভাবেই রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিল গাড়ি মোহম্মদপুর বাবর রোড থেকে ওই সিএনজিতে উঠেছিলে বেসরকারি সংস্থায় কর্মরত সালেকিন। তিনি বলেন,‘অফিস মিস হয়েছে। এখন সিএনজি নষ্ট হওয়ায় বৃষ্টির মধ্যে কিভাবে কি করবো বিরক্ত লাগছে।
তিনদিনের বৃষ্টিতে নাকাল নগরবাসী বুধবার সকালে ভোগান্তিতে পড়ে। মঙ্গলবার রাতে বৃষ্টির পরিমাণ বেশি না থাকলেও বুধবার সকাল থেকে বৃষ্টির বেগ বেশি থাকায় রাস্তায় পানি জমতে শুরু করে। নগরীর প্রধান সড়কের মধ্যে মানিকমিয়া এভিনিউ, ধানমন্ডি ১৬ নম্বর থেকে শুরু করে শান্তিনগর, সেগুনবাগিচা, সচিবালয়, পুরান ঢাকার বেশিরভাগ এলাকা পানির নিচে। আর সকালে অফিসে, স্কুলে বের হওয়া মানুষ শুরুতে গাড়ি পেলেও ১০টার পর সেভাবে রাস্তায় গাড়ি ছিল না। কারণ যানজনে রাস্তায় আটকে ছিল গাড়ি।রাজধানীর ফার্মগেট থেকে কাওরান বাজার পর্যন্ত এলাকা পানি জমে থাকায় এই এলাকায় সকালের দিকে গাড়ি ধীরে ধীরে এগুতে পারলেও বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে থমকে যায়। সকাল ১০টা থেকে এখানে যাত্রবাড়ীগামী বাসে ঠায় বসে থাকা ষাটোর্ধ্ব রবিউল আলম বলেন, ‘অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বাসে উঠেছি। এখন বাসের মধ্যে বৃষ্টিতে ভিজে বসে আছি। অতো শক্তি নাই যে হেঁটে রওনা দিব।আর এই সুযোগ নিয়ে রিকশা ও অটোরিকশা ভাড়া দ্বিগুণ তিনগুণ বাড়িয়ে দেওয়ায় মানুষকে হয়রানিতেও পড়তে হচ্ছে। সিএনজি চালক মোবারক আসাদগেট এলাকায় বলেন, এটুকু আসছি দুই ঘণ্টায়। একেক ট্রিপে যদি চার ঘণ্টা লাগে জমার টাকা তুলবো কী, আর খাব কী? কেবল আমাদের হয়রানি কেউ দেখে না।এর দায় কেন যাত্রীর ওপর যাবে-এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন,‘কারণ আজকের মতো বৃষ্টি বাদলায় সবাই গাড়ি চালায় না। তাই রাস্তায় গাড়িঘোড়া কম থাকে।মিরপুর ১০ থেকে কাওরান বাজার এমনি সময়ে সিএনজি ভাড়া আড়াইশ টাকা হলেও আজ চারশ থেকে ৫০০ টাকা চাওয়া হচ্ছে। ফার্মগেটের এপারে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তা পার হতে ৫০ টাকা দিতে হচ্ছে। এছাড়া যেকোনও দূরত্বের রিকশা ভাড়া তিনগুণ বেশি দিয়ে চলাচল করতে হওয়ায় বুধবার সকাল হয়রানিতেই কেটেছে নগরবাসীর।এদিকে নগরীতে জনপ্রিয় হয়ে উঠা উবারের যাত্রীরা বলেন,আজ সকাল থেকেই উবারের কোনও রিকোয়েস্ট দিয়ে সার্ভিস অ্যাভেইলেভল পাওয়া যায়নি।’উবার চালক রবিউল বলেন,রাস্তায় পানি আর তীব্র যানজটের কারণে আজকে গাড়ি চালানো বন্ধ রেখেছেন অধিকাংশ ড্রাইভার।
মিরপুর সড়কের পুরো যানজটের কারণ যে ধানমন্ডি ১৬ নম্বর সড়কের মোড় সেটা কেন এই অবস্থায় ফেলে রাখা হচ্ছে-এ প্রশ্নের জবাবে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী আসাদুজ্জামান বলেন,এখানে পানি জমলে ঘণ্টা খানেক সময় লাগে পানি নামতে। এ এলাকা থেকে নিউমার্কেট পর্যন্ত পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য আমরা মডেল সড়কের পাইলট প্রকল্প নিয়েছি। ইতোমধ্যে পরিকল্পনাও জমা নেওয়া হয়েছে। অনুমোদন পেলেই এই এলাকার হয়রানি বন্ধ হবে। সকাল ১১টা। অফিসে পৌঁছার সময় শেষ হয়ে গেছে আরও একঘণ্টা আগে। তখনও সড়কের পাশের একটি দোকানের নিচে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছেন তিনি। বাস না পেয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটি সিএনজিতে ওঠেন খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মোরশেদা বেগম। কিন্তু তাকে ভাড়া গুনতে হয়েছে তিনগুণ। সড়কে বাসের দেখা মিললেও সিটিং সার্ভিসের নামে অধিকাংশ বাস দরজা বন্ধ করে চলাচল করছে। তারা গণপরিবহনে সিটিং সার্ভিসের লেবাস লাগিয়ে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। দেখা যায় ট্রাফিক পুলিশও ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করছে না।বুধবার দুপুরের দিকে বৃষ্টি থেমে গেলে বাসা বা অফিসে ফেরার তাড়া থাকায় যাত্রীচাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মান্ধাতার আমলের পরিবহনগুলো। লক্কড়-ঝক্কড় এসব গাড়িতে উঠতে নারীসহ যাত্রীদের হয়রানির শিকার হতে হয়েছে।দুপুর একটার দিকে শাহবাগে অপেক্ষমাণ যাত্রী গিয়াস উদ্দিন রাকিব বলেন, ‘মিরপুরে যাওয়ার উদ্দেশে বাসের জন্য এক ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করার পর একটি বাসে উঠেছি। বিকল্প অটো সার্ভিস নামের পরিবহনটি সিটিং সার্ভিসের নামে বিআরটিসি নির্ধারিত ভাড়ার তিনগুন বেশি নিয়েছে।
এদিকে পল্টন-শাহবাগ এলাকায় তীব্র যানজট দেখা দেওয়ায় হাইকোর্টের সামনে গাড়ি থেকে নেমে পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিয়েছেন বেসরকারি একটি কোম্পানির কর্মকর্তা সাইফুল ইসলাম।তিনি বলেন, ‘রাস্তায় যে পরিমাণ জট তাতে মনে হচ্ছে গাড়ির চেয়ে পায়ে হেঁটে আগে অফিসে পৌঁছাতে পারবো। সে কারণে ভাড়া পরিশোধ করেও হেঁটে রওয়ানা দিয়েছি।গাড়ি চালকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃষ্টির সময় অনেক মানুষ কর্মস্থলে পৌঁছাতে পারেনি। বৃষ্টি শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই একযোগে বের হয়ে পড়েছেন। এখন যাত্রী বেশি থাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়েছে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রেসক্লাবের সামনে দায়িত্বরত ট্রাফিক পুলিশের কর্মকর্তা নজরুল ইসলাম বলেন, বিষয়টি নতুন কিছু নয়। বৃষ্টি হলেই পুরো ঢাকাজুড়ে যানজট ও পরিবহন সংকট দেখা দেয়। আজও একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।