দেশের বিভিন্ন জায়গায় শুক্রবার বন্যা পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। তবে সিলেটে পানি কমলেও দুর্ভোগ বেড়েছে বন্যা কবলিতদের। চলমান বন্যায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন দেশের মানুষ। দু-একটি জায়গায় পানি নেমে যেতে শুরু করলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না বানবাসী মানুষদের।

জামালপুর:জামালপুরে বন্যার পানি বেড়েই চলেছে।যমুনা নদীর পানি বেড়ে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিরাজগঞ্জে বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ভেঙে তলিয়ে গেছে ২০টি গ্রাম। অপরিবর্তিত রয়েছে কুড়িগ্রাম ও মৌলভীবাজারের বন্যা পরিস্থিতি। লালমনিরহাটে বাড়িঘরের পানি নেমে যাচ্ছে। ঘরে ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ। দুর্গত এলাকায় রয়েছে অপ্রতুল ত্রাণের অভিযোগ।চলমান বন্যায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছেন দেশের ১৩টি জেলার মানুষ। দু-একটি জায়গায় পানি নেমে যেতে শুরু করলেও দুর্ভোগ পিছু ছাড়ছে না বানবাসী মানুষদের।জামালপুরে যমুনা নদীর পানি বেড়েই চলেছে। বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে বিপদসীমার ৮৭ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে যমুনা নদীর পানি। পানিবন্দি ৪৪ ইউনিয়নের দেড় লাখেরও বেশি মানুষের দুর্ভোগ দিন দিন বেড়েই চলেছে। দুর্গত এলাকায় কাজ করছে ৭৯টি মেডিকেল টিম।জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ১৮০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ তিন লাখ ১০ হাজার টাকা এবং তিন হাজার দুইশো ব্যাগ শুকনো খাবার বিতরণ করা হয়েছে। তবে প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই অপ্রতুল বলে অভিযোগ বানভাসী মানুষের।

সিরাজগঞ্জ:সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার রতনকান্দি ইউনিয়নের বাহুকা এলাকায় নির্মাণাধীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধে ভাঙন দেখা দেয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন আশপাশের এলাকার মানুষ। যমুনার পানির প্রবল চাপের কারণে বৃহস্পতিবার রাতে বাঁধে আকস্মিক ভাঙন দেখা দেয়। পানি ঢুকে পড়েছে সদর উপজেলার ৩ টি ইউনিয়নের অন্তত ২০টি গ্রামে।পানি উন্নয়ন বোর্ড জানিয়েছে, শুক্রবার রাতেই জরুরি ভিত্তিতে বাঁধ মেরামতের কাজ শুরু করা হবে।কুড়িগ্রাম: নতুন করে পানি না বাড়ায় কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির অপরিবর্তিত রয়েছে। তবে এখনো বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে ব্রহ্মপুত্র ও ধরলার পানি। সাত উপজেলার দুই লাখেরও বেশি মানুষ আটদিন ধরে পানিবন্দি থাকায় চরম দুর্ভোগে দিন কাটছে তাদের। অনেকে ঘরের ভেতর উঁচু মাচা করে দিনযাপন করছেন। এরউপর খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির সংকট এবং পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব এই দুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছে।লালমনিরহাট:বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দোয়ানী ও কুলাঘাট পয়েন্টে তিস্তার পানি বিপদসীমার নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত এলাকাগুলো থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। ঘরে ফিরতে শুরু করেছে মানুষ। তবে বন্যায় জমির ফসলের পাশাপাশি ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা। পানি কমতে থাকায় এসব এলাকায় দেখা দিয়েছে পানিবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাব।এদিকে, সিলেটে প্লাবিত বিভিন্ন এলাকা থেকে পানি নেমে যাচ্ছে। তবে নিচু এলাকার রাস্তাঘাট ও ঘরবাড়ি এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। মৌলভীবাজারে কুশিয়ারা নদীর পানি সামান্য কমলেও এখনো বিপদসীমার ৬ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ায় মানুষের দুর্ভোগ বেড়েই চলেছে। খাদ্য সংকট দেখা দেয়ায় আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে যাচ্ছে মানুষ

ফরিদপুর:ফরিদপুরে পদ্মা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। গত ১২ ঘণ্টায় পদ্মার পানি গোয়ালন্দ পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার বেড়ে এখন তা বিপদসীমার ৪ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। পানি বৃদ্ধির ফলে ফরিদপুর জেলার পদ্মা তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।বাড়ছে পদ্মার পানি, তীব্র ¯্রােতে ভেঙে গেছে নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের গোলডাংগী সেতুপানি বাড়ার ফলে সদর উপজেলার নর্থ চ্যানেল, ডিক্রিরচর এবং চরভদ্রাসন উপজেলার গাজীরটেক, চরহরিরামপুর, ঝাউকান্দা ইউনিয়নের বেশির ভাগ নিম্নাঞ্চল তলিয়ে গেছে।নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোস্তাকুজ্জামান মোস্তাক জানান, দ্রুত গতিতে পানি বাড়ার কারণে নিম্নাঞ্চল তলিয়ে যাচ্ছে। যেভাবে পানি বাড়ছে তাতে করে কয়েক দিনের মধ্যে নর্থ চ্যানেল ইউনিয়নের অধিকাংশ বাড়িতে পানি ঢুকে পড়বে।ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী জহিরুল ইসলাম জানান, গত কয়েক দিন ধরে পদ্মার পানি অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রতিদিনই ১০/১৫ সেন্টিমিটার করে পানি বাড়ছে। জেলার সদর, চরভদ্রাসন, সদরপুর ও আলফাডাঙ্গা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চলে পানি প্রবেশ করতে শুরু করেছ, বলেও জানান তিনি

গাইবান্ধা: গত ১০ বছরে ঘর সরিয়েছেন চার বার। শেষ বার আবারও নদীর তীরে কোনও রকমে ঘর তুলে এক বছর ধরে বসবাস করছিলেন আমেনা বেগম। কিন্তু এবারের ভাঙনে সব চলে গেছে তার। গাইবান্ধার নিঃস্ব আমেনা বেগম এসব তথ্য জানাতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতে থাকেন ‘বছর বছর ঘর সরিয়েও রেহায় নাই। এখন ছেলে-মেয়ে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবো? নদী ভাঙনে জোহরা বেগমের অবস্থাও একই রকম। অসহায় জোহরা চোখের পানি আঁচলে মুছে বলতে থাকেন তার কষ্টের কথা। বলেন, ভাঙনে ভাঙনে নদীতে সব হারিয়ে আজ নিঃস্ব। স্বামী অসুস্থ থাকায় ঘরে পড়ে আছেন। যে ঘরে ছেলে-মেয়ে আর স্বামীকে নিয়ে কোনও রকমে খেয়ে না দিন পার করেছি। সেই ঘরও আজ নদীতে চলে গেল। এখন পথে পথে ঘোরা ছাড়া উপায় নাই।এই হতাশা আর কান্না শুধু আমেনা বেগম কিংবা জোহরা বেগমেরই নয়, তিস্তার ভয়াবহ ভাঙনে হাজারো মানুষ হারিয়েছেন ঘর-গেরস্তি। এবারও বন্যায় প্রতিদিনই নিঃস্ব হচ্ছেন গাইবান্ধা সদর উপজেলার কামারজানি ইউনিয়নের গো-ঘাট গ্রামের মানুষ। বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকায় তিস্তা নদীর ভাঙন ভয়াবহ রূপ ধারন করেছে।এছাড়া নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে এলাকার একমাত্র কলমু এফএনসি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বিলীন হয়েছে মসজিদ, মন্দির, কবরস্থানসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা। এছাড়া হুমকির মুখে রয়েছে আরও শতশত বাড়িঘর, আবাদি জমি, গাছপালা, ইউনিয়ন উপ-স্বাস্থ্য কেন্দ্র ও বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের স্লুইচ গেট।

বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা ঢলে গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি, সাঘাটা ও সুন্দরগঞ্জ উপজেলার ৩০ ইউনিয়নের চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গত কয়েক দিন ধরে পানিবন্দি লাখো মানুষ খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকটে ভুগছেন। ছড়িয়ে পড়ছে পানিবাহিত রোগ। বন্ধ করা হয়েছে ১৪৫টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষা কার্যক্রম। পানিবন্দি অনেকে শেষ সম্বল নিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন উচু বাঁধ, রেলের জায়গা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পানিবন্দি এসব মানুষ চরম দুর্ভোগে মানবেতর জীবনযাপন করছেন।গত পাঁচ দিন ধরে জেলার ব্রহ্মপুত্র-যমুনা, ঘাঘট নদীর পানি বেড়ে বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। পানি বৃদ্ধি ও পানির প্রবল চাপে কামারজানির গো-ঘাট গ্রামে নদী ভাঙন ভয়াবহ রুপ নেয়। গত চার বছর ধরে বন্যার আগে ও পরে ভাঙনে বসতভিটে হারিয়ে নিঃস্ব হয়েছে হাজার হাজার মানুষ। অনেকে গো-ঘাট গ্রাম ছেড়ে বিভিন্ন এলাকায় বসবাস শুরু করেছেন। গত দেড় মাস আগে থেকে গো-ঘাট এলাকায় তিস্তা নদীর তীব্র ভাঙন দেখা দেয়। ভাঙনের ফলে বসতবাড়ি, কবরস্থান, মসজিদ নদী গর্ভে বিলীন হয়ে যায়।দুপুর থেকে গো-ঘাট এলাকায় তিস্তা নদী ফুঁসে ওঠে। দুপুর থেকে তিস্তার ভাঙনের তীব্রতা আরও বেড়ে যায়। বিকাল না গড়াতেই সাবেক ইউপি চেয়ারম্যানের বাড়িসহ অন্তত ৫০টি পরিবারের কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি নদী গর্ভে বিলীন হতে থাকে। এ সময় এলাকার মানুষ আতঙ্কে ছোটাছুটি করতে থাকে। ঘরের মালামাল, ছোট-বড় অসংখ্য গাছপালা চোখের সামনে কেড়ে নেয় ভয়াল তিস্তা নদী।মাহাবুবুর রহমান বলেন,‘বসতবাড়ি ছাড়া ভাঙনে মসজিদ, মন্দির, স্কুল বিলীন হয়েছে। নদী পাড়ের মানুষরা তাদের বসতি আগলে রাখতে দীর্ঘদিন ধরে ভাঙন ঠেকাতে সঠিক পরিকল্পনার দাবি জানিয়ে আসলেও তা কার্যকর হয়নি।পানি উন্নয়ন বোর্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে তিনি আরও বলেন, ‘বর্ষা ও বন্যা মৌসুম আসলে ভাঙন ঠেকানোর নামে পানি উন্নয়ন বোর্ড দায়সারাভাবে বালুর বস্তা ফেলা শুরু করে। কিন্তু ভাঙন ঠেকাতে কোনও কাজে আসে না এইসব বস্তা।সদর উপজেলার রহিম মিয়া বলেন, ‘সরকারের কোনও নজর নেই ভাঙন ঠেকানোর জন্য। বালুর বস্তা ফেলানোর জন্য যে টাকা বরাদ্দ হয় তা নদীর পেটে, ঠিকাদার আর নেতাদের পকেটে চলে যায়।এদিকে, এলাকাবাসির অভিযোগ, ভাঙন রোধে পানি উন্নয়ন বোর্ড সঠিক সময়ে কার্যকরি ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে একের পর এক বসতবাড়ি, আবাদি জমিসহ গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদী গর্ভে বিলীন হচ্ছে।এ বিষয়ে গাইবান্ধা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মাহাবুবুর রহমান বলেন, গো-ঘাট এলাকায় তিস্তার ভাঙন ভয়াবহ রুপ নিয়েছে। ভাঙনের শুরু থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড বালুর বস্তা ফেলার কাজ করছে। কিন্তু কোনোভাবেই ঠেকানো যাচ্ছে না ভাঙন। তবে ভাঙন ঠেকাতে স্থায়ী পরিকল্পনা নেওয়া হবে।’এছাড়া, গাইবান্ধার নদ-নদীর পানি কমলেও এখনও বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানিতে ডুবে গত দুই দিনে গাইবান্ধা সদর ও ফুলছড়িতে দুই শিশুর মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া সাপের কামড়ে ফুলছড়িতে আরও এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।