দেশের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। নদনদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় বৃহস্পতিবার বিভিন্ন জেলায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। এতে বাড়ছে পানিবন্দির সংখ্যা। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের জীবনযাত্রাও। জামালপুরসহ সিরাজগঞ্জ, বগুড়া, গাইবান্ধা, রংপুর, কুড়িগ্রাম ও দেশের উত্তরাঞ্চলের ৯ জেলার লাখ লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি অবস্থায়। আশ্রয় কেন্দ্রগুলোয় বন্যার্তদের ভিড় বাড়ছে। যারা বাসাবাড়িতে আছেন, তাদের অনেকেই ঢেউ ও ভাঙন আতঙ্কে ভুগছেন। বন্যাকবলিত অনেক স্থানে বিশুদ্ধ পানি ও জ্বালানির সংকট দেখা দিয়েছে। খাবার সংকটে অনেকে দিন কাটাচ্ছেন অনাহার-অর্ধাহারে। বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে হাজারো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ফলে স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। সিলেট ও মৌলভীবাজারে পানি কমলেও এখনও দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে বানভাসিদের।

এদিকে বন্যা প্লাবিত ১৩ জেলার ৪৫ উপজেলায় সাড়ে ৬ লাখ লোক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া। গত বুধবার সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এ তথ্য জানান। ভারি বৃষ্টির কারণে কয়েক দিনে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে বলেও জানান মন্ত্রী। মায়া বলেন, সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ জেলা বন্যাকবলিত হয়েছে। উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে। তিনি বলেন, প্রতিদিন প্রতি জেলার ক্ষয়ক্ষতি, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম, আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রিত মানুষের পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছি। ১১ জুলাই পর্যন্ত বন্যা পরিস্থিতির ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ১২টির পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে, ৫৫টি পয়েন্টে পানি বেড়েছে। বন্যাদুর্গত এলাকায় যারা খোলা আকাশের নিচে, উঁচু বাঁধে বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের দ্রুত আশ্রয় কেন্দ্রে নেয়া হয়েছে জানিয়ে মন্ত্রী বলেন, কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিলে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসাসেবা দেয়া হবে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে অনুরোধ করছি। যে কোনো দুর্যোগ পরিস্থিতিতে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর মতো পর্যাপ্ত খাদ্য সরকারের কাছে মজুদ রয়েছে বলেও দাবি করেন মায়া। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্য অধিদফতরের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানাবÑ তারা যেন বন্যা প্লাবিত এলাকার টিউবওয়েলগুলো উঁচু করে এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান। আজ থেকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা প্লাবিত প্রত্যেকটি এলাকা সফর করে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের কথা শুনবেন এবং তাদের সমস্যা সমাধান করবেন বলেও জানান মন্ত্রী। তিনি বলেন, বন্যা নিয়ে রাজনীতি না করে আমি দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান জানাবÑ আসুন, আমরা বন্যা প্লাবিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মানবিক কর্তব্য পালন করি। নিজস্ব প্রতিবেদক, ব্যুরো ও সংবাদদাতাদের খবরÑ

কুড়িগ্রাম: কুড়িগ্রামে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় জেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। প্লাবিত হয়ে পড়েছে নতুন নতুন এলাকা। এসব এলাকার পানিবন্দী প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ মানবেতর জীবন যাপন করছে। বুধবার বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। নিহতরা হলেন চিলমারী উপজেলার শাখাহাতি গ্রামের সাইদুল ইসলামের মেয়ে লাইলী বেগম (২৮) ও সদর উপজেলার সদর উপজেলার খামার হলোখানা গ্রামের পনির উদ্দিনের ছেলে হামিদুল হক (১৭)। স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করে জেলায় ৮৭টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্রের পানি বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার ও সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে ব্রহ্মপুত্র নদের প্রবল ¯্রােতে চিলমারী উপজেলার কাঁচকোলে ডানতীর রক্ষা প্রকল্পের ৫০ মিটার বাঁধ ও রৌমারী উপজেলার যাদুর চরে কত্তিমারী বাজার রক্ষা বাঁধ ভেঙ্গে নতুন করে ৫০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭ উপজেলার ৪২ ইউনিয়নের ৫শ গ্রামের ২ লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী জীবন যাপন করছে।

অনেক পরিবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে উচুঁ জায়গায় আশ্রয় নিলেও এসব এলাকায় খাদ্য ও বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। ১শ ৫০ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পানি উঠায় বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।জেলায় ১ হাজার হেক্টর জমির আউশ, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে।সরকারীভাবে স্বপ্ল পরিসরে ত্রান তৎপরতা শুরু হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। কিন্তু এখন পর্যন্ত বেসরকারী কোন ত্রান তৎপরতা চোখে পড়েনি।সদর উপজেলার ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার চর ভগবতিরপুরের আমজাদ আলী জানান, ৬ দিন ধরে পানিবন্দী অবস্থায় বউ-বাচ্চা নিয়ে নৌকায় জীবন যাপন করছি। বাড়ি-ঘর, গরু-ছাগল ছেড়ে কোথাও যাব সে জায়গাও নাই। এমন অবস্থায় ঘরে খাবারও শেষ হয়ে গেছে।চেয়ারম্যান মেম্বাররা ১০ কেজি করে চাল দিচ্ছে তাও সবাই পাচ্ছে না। একই চরের আমেনা বেগম জানান, ঘরের ভিতর চৌকি ভাসিয়ে কোন রকমে একবেলা রান্না বাড়া করে ছেলে-মেয়েদের খাওয়াচ্ছি। খুব কষ্টে দিন যাচ্ছে আমাদের।কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আমান উদ্দিন মঞ্জু জানান, আমার উপজেলার ৮ ইউনিয়নের মধ্যে ৬টি ইউনিয়নের প্রায় ৬০ হাজার মানুষ বন্যা কবলিত হয়ে পড়েছে। সরকারীভাবে ২০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ পেয়েছি যা বিতরন অব্যাহত আছে।

কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডাঃ এসএম আমিনুল ইসলাম জানান, বুধবার বিকেলে বন্যার পানিতে ডুবে ২ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে লাইলী বেগম মৃগী রোগী। চরাঞ্চলে ৯টি কমিউনিটি ক্লিনিক তলিয়ে যাওয়ায় পাশ্ববর্তী উচুঁ জায়গায় কার্যক্রম চালু রাখা হয়েছে। জেলার বন্যা কবলিত এলাকা গুলোতে ৮৭টি মেডিকেল টিম কাজ করছে। স্বাস্থ্য বিভাগের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ছুটি বাতিল করা হয়েছে। কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে বন্যা কবলিত ৭ উপজেলায় বন্যার্ত মানুষের মাঝে এপর্যন্ত ৩শ মেট্রিক টন চাল, ৮ লাখ টাকা ও ২ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বিতরন করা হয়েছে। আরো নতুন করে ১শ মেট্রিক টন চাল, ২ হাজার শুকনো খাবারের প্যাকেট ও ৩ লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে যা বিতরনের কার্যক্রম চলছে।স্থানী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোঃ শফিকুল ইসলাম জানান, গত ২৪ ঘন্টায় চিলমারী পয়েন্টে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি ৫ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৩৭ সেন্টিমিটার, সেতু পয়েন্টে ধরলার পানি ৭ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার ১৮ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার পানি কাউনিয়া পয়েন্টে ১৪ সেন্টিমিটার হ্রাস পেয়ে বিপদসীমার নীচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।

জামালপুর : জামালপুরে গত ২৪ ঘন্টায় যমুনার পানি আরও ১৬ সেন্টিমিটার বৃদ্ধি পাওয়ায় কমপক্ষে দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলার পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)’র নির্বাহী প্রকৌশলী নব কুমার রায় জানান, বুধবার (১২ জুলাই) সকালে বাহাদুরাবাদ পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৭৬ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একই পয়েন্টে মঙ্গলবার যমুনার পানি ছিল বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপরে। যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাইসহ জামালপুর জেলার সবগুলো নদীর পানি বেড়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন তিনি।

জেলার নদ-নদীগুলোর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ, মাদারগঞ্জ, সরিষাবাড়ি ও জামালপুর সদরের আরো ১৫টি ইউনিয়ন নতুন করে প্লাবিত হয়েছে। জেলার ৬টি উপজেলার ৪০টি ইউনিয়নের দেড় লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে ১৩৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। স্থানীয়রা জানান, টানা বন্যায় পানিবন্দি মানুষের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দুর্গত মানুষের ঘরে খাবার নেই। গবাদিপশুর খাবার জোটাতেও হিমশিম খেতে হচ্ছে তাদের। জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গত কয়েক দিনে ৯০ মেট্রিক টন চাল, ৩ হাজার ২০০ প্যাকেট শুকনো খাবার ও দেড় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে। তবে এই ত্রাণ প্রয়োজনের তুলনায় একেবারেই কম বলে অভিযোগ দুর্গতদের।জামালপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) রাসেল সাবরিন জানান, নতুন করে ১০০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫ লাখ টাকা চেয়ে ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে চাহিদাপত্র পাঠানো হয়েছে।এদিকে বন্যাকবলিত এলাকায় পানিবাহিত নানা রোগ ছড়িয়ে পড়ছে। তা প্রতিরোধে বন্যাকবলিত এলাকায় ৭৭টি মেডিকেল টিম কাজ শুরু করেছে বলে নিশ্চিত করেছে জামালপুরের সিভিল সার্জন কার্যালয়।

গাইবান্ধা : গাইবান্ধার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতি আরও অবনতি হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২৪ ঘণ্টায় ব্রহ্মপুত্রের পানি বৃদ্ধি পেয়ে এখন বিপদসীমার ৫৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ঘাঘট নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ৪১ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এছাড়া তিস্তা, যমুনা ও করতোয়া নদীর পানি এখন বিপদসীমার সামান্য নিচ দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যার পানি হু হু করে বৃদ্ধি পাওয়ায় চার উপজেলার ৮২ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গাইবান্ধার সিভিল সার্জন ডা. মোঃ আমির আলী জানান, আমাদের প্রায় ১ হাজার জনের ১২০টি মেডিকেল টিম গঠন করা হয়েছে। তারা বন্যাদুর্গত এলাকায় কাজ করছেন। কন্ট্রোল রুম খোলার কাজ চলছে। এছাড়া খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও পর্যাপ্ত ওষুধ মজুদ রয়েছে। জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ আমিনুল ইসলাম ম-ল বলেন, নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চল ও চরাঞ্চলের ৬১টি প্রাথমিক বিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। এসব বিদ্যালয়ের শ্রেণিকক্ষে পানি উঠেছে। এছাড়া আরও ৫২টি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠ ও রাস্তাঘাট প্লাবিত হয়েছে। আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে বিদ্যালয়গুলোকে খুলে দেয়ার জন্য প্রধান শিক্ষকদের বলা হয়েছে। এদিকে জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা গেছে, বন্যার পানি বৃদ্ধির ফলে সুন্দরগঞ্জ, সাঘাটা, ফুলছড়ি ও সদর উপজেলার ২৩টি ইউনিয়নের ঘরবাড়ি, আবাদি ফসল তলিয়ে গেছে। মঙ্গলবার বিকাল থেকে সাবেক ফুলছড়ি উপজেলা হেডকোয়ার্টারে পানি উঠেছে। ফলে ওই বন্দরে চলাচলের একমাত্র বাহন এখন নৌকা। এছাড়া ভরতখালী থেকে ফুলছড়ি বন্দরে যাওয়ার রাস্তাটি পানিতে তলিয়ে যাওয়ায় লোকজনকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে। বন্যাকবলিত চার উপজেলায় ৮২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। এর মধ্যে ১৭টিতে বন্যাকবলিত মানুষ আশ্রয় নিতে শুরু করেছেন। জেলা প্রশাসন থেকে আরও বলা হয়েছে, দুর্যোগ ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত ২২৫ মে. টন চাল ও ১৫ লাখ টাকা দুর্গত মানুষদের মধ্যে বিতরণের কাজ শুরু হয়েছে।

বগুড়া : ভারতের উজান থেকে নেমে আসা পানির তোড়ে বগুড়ায় যমুনা নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। ২৪ ঘণ্টায় আরও ১০ সেন্টিমিটার বেড়ে সারিয়াকান্দি পয়েন্টে যমুনার পানি বিপদসীমার ৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ভারত তিস্তা ব্যারাজের সব গেট খুলে দেয়ার পর থেকেই যমুনার পানি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। ফলে বগুড়া জেলার সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলায় প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। জেলা ত্রাণ তহবিল থেকে কিছু নগদ অর্থ ও চাল বরাদ্দ দিলেও চাহিদার তুলনায় তা অপ্রতুল বলে স্থানীয়রা দাবি করেছেন। এদিকে জেলা প্রশাসক নূরে আলম সিদ্দিকী বুধবার বন্যাকবলিত সারিয়াকান্দি উপজেলা পরিদর্শন করেছেন। এ সময় তিনি বন্যাদুর্গতদের ভীত না হয়ে সাহসিকতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলার আহ্বান জানান। দুর্গতদের জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় সবধরনের সবযোগিতারও আশ্বাস দেন তিনি। বগুড়া জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা শাহারুল ইসলাম মোঃ আবু হেনা জানান, বন্যাকবলিত এলাকা ৪ লাখ টাকা (জিআর ক্যাশ), ২৫০ মেট্রিক টন জিআর চাল বরাদ্দ হয়েছে। এর মধ্যে সারিয়াকান্দি উপজেলায় ১ লাখ টাকা, ১০০ মেট্রিক টন চাল, সোনাতলা উপজেলায় ২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হয়েছে। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ১৪ ইউনিয়নের ৭৫ গ্রামের ১৩ হাজার ২২২ পরিবার। সারিয়াকান্দি আশ্রয়প্রকল্পে আশ্রয় নিয়েছে ৭৬৫ পরিবার। বাঁধের ওপর ৩ হাজার ৩৫৫ পরিবার ও বিভিন্ন বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিয়েছে। জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা গোপাল চন্দ্র জানান, বন্যায় পানি প্রবেশ করায় ৮২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পাঠ দান বন্ধ হয়ে গেছে। সারিয়াকান্দি উপজেলায় ৫৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, সোনাতলায় ১২টি ও ধুনটে পাঁচটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পাঠদান বন্ধ রয়েছে। এছাড়া পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় ও দুইটি মাদরাসায় পানি ওঠায় বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপপরিচালক প্রতুল চন্দ্র জানান, পাট, ধান, সবজি ও বীজতলাসহ ৩ হাজার ৮৭৭ হেক্টর জমির ফসল বন্যার পানিতে ক্ষতি হয়েছে। গোটা জেলায় ১ হাজার ৩৬৭ হেক্টর জমির আউশ, ২ হাজার ৪৪০ হেক্টর জমির পাট, ৩০ হেক্টর বীজতলা, ৪০ হেক্টর সবজির ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এছাড়া ৮৫টি পুকুর বন্যার পানিতে নিমজ্জিত হয়েছে। বগুড়া জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা হোসেন আলী জানান, সোনাতলা, সারিয়াকান্দি ও ধুনট উপজেলার ৭৫টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পানি উঠেছে। ১২টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা উপস্থিত থাকলেও শিক্ষার্থীরা আসছে না।

সিরাজগঞ্জ : যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় সিরাজগঞ্জে সার্বিক বন্যা পরি¯ি’তির আরও অবনতি ঘটেছে। বন্যাকবলিত এলাকার প্রায় ৮৫ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। চর ও দুর্গম অঞ্চলের বন্যা পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। সে সঙ্গে অনেক স্থানে প্রচন্ড ভাঙনও শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বহু জায়গার জমি-গাছপালা নদীতে বিলীন হয়েছে। বন্যা ও ভাঙন পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সব কর্মকর্তা ও কর্মচারীর ছুটি বাতিল করা হয়েছে। বর্তমানে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ৬৭ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। প্লাবিত হচ্ছে আরও নতুন নতুন এলাকা। আখ-পাটসহ বিভিন্ন ফসল ডুবে গেছে। যমুনা নদীর তীরবর্তী শাহজাদপুর, চৌহালী, বেলকুচি, কাজিপুর ও সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার নিম্নাঞ্চলের ২ শতাধিক বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাটবাজারসহ বহু বাড়িঘর ডুবে গেছে। বন্যাকবলিত এলাকার অনেক স্থানে বিশুদ্ধ পানি ও জ্বালানি সংকট দেখা দিয়েছে। অনেক স্থানে এখনও ত্রাণসামগ্রী না পৌঁছায় বন্যাদুর্গতরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। শাহজাদপুরের ইউএনও আলিমুন রাজীব জানান, এ উপজেলার বাঘাবাড়ী এলাকার গরুর বাথানে পানি ঢুকে পড়ায় বাথানগুলো অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে। টাঙ্গাইল : উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে যমুনা নদীর পানি। এতে করে টাঙ্গাইলে যমুনা নদীর পানি বিপদসীমার ১৩.৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহজাহান সিরাজ জানান, পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বুধবার সকাল থেকেই গোপালপুর উপজেলার নলিন পয়েন্টে যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে বিপদসীমার ১৩.৩৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে ভূঞাপুর উপজেলার ফকিরপাড়া, চর বেতুয়া, চর বামন হাঁটা, চর কুতুবপুর গ্রামে নতুন করে যমুনার পানি প্রবেশ করেছে। অপরদিকে পানি বাড়তে থাকায় উপজেলার গাবসারা, গোবিন্দাসী ও অর্জুনা ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। বিশেষ করে ধলেশ্বরী নদীর পানির বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে দেখা দিয়েছে ব্যাপক ভাঙন। গত কয়েক দিনের ভাঙনে নাগরপুর উপজেলার মোকনা ইউনিয়নের আগদিঘুলিয়া গ্রামের সাধনা একাডেমি হাইস্কুল, শত বছরের পুরনো আগদিঘুলিয়া বাজার, কালিমন্দিরসহ শতাধিক পরিবারের ঘরবাড়ি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। ফলে বিপাকে পড়েছে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় হুমকির মধ্যে পড়েছে টাঙ্গাইল-ভূঞাপুর-তারাকান্দি সড়ক। লালমনিরহাট : লালমনিরহাটে বন্যা পরিস্থিতির সার্বিক অবনতি হয়েছে। তিস্তার পানি কমলেও বেড়েছে ধরলার পানি। পানির প্রবল চাপে নতুন করে দুইটি বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ধসে গেছে। ধরলার প্রবল ¯্রােতে সদর উপজেলার শিবেরকুটি এলাকার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্মিত একটি বাঁধটি ধসে গিয়ে নতুন করে প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। অপরদিকে তিস্তার প্রবল পানির ¯্রােতে ভেসে গেছে আদিতমারী উপজেলার কুটিরপাড় স্বেচ্ছাশ্রমে নির্মিত বালুর বাঁধ। ফলে নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে হাজারো পরিবার। বন্ধ রয়েছে বন্যাদুর্গত এলাকার বিদ্যালয়। এসব এলাকায় মানুষের মধ্যে খাদ্য ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। এখন পর্যন্ত সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে বন্যাদুর্গত এলাকার মানুষের মাঝে যে পরিমাণ ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে তা খুবই সামান্য বলে জানিয়েছেন বন্যাকবলিত মানুষজন। ফলে তারা চরম দুঃখ-কষ্টের মধ্যে দিয়ে অনাহারে-অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন।

সিলেটে : সিলেটে পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হয়েছে। অধিকাংশ এলাকার পানি নেমে গেছে। তবে সুরমা ও কুশিয়ারার তিনটি পয়েন্টে এখনও বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এ কারণে বন্যাকবলিত উঁচু এলাকার পানি নেমে গেলেও নি¤œাঞ্চলের পানি নামছে ধীরে ধীরে। তবে পানি কমলেও দুর্ভোগ কমছে না দুর্গত মানুষদের। রাস্তাঘাট ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় বন্যাকবলিত এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থায় ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়েছেন জনগণ। অনেকের ঘর পানির ¯্রােতের কবলে ভেঙে গেছে। তাছাড়া বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবও রয়েছে বন্যাকবলিত এলাকায়। বন্যার্তদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। এদিকে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পক্ষ থেকে বুধবার ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার বন্যাদুর্গত সহ¯্রাধিক মানুষের মাঝে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করেছেন সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সদস্য আবদুর রকিব চৌধুরীর তত্ত্বাবধানে উপজেলার সাত ইউনিয়নে বন্যার্তদের মাঝে এ ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
মৌলভীবাজার : মৌলভীবাজারের হাকালুকি হাওরপারের বড়লেখা, কুলাউড়া ও জুড়ী উপজেলায় বন্যার পরিস্থিতি ধীরগতিতে উন্নতি হচ্ছে। শিবিরে আশ্রয় নেয়া বন্যার্তরা এখনও তাদের বাড়িতে যাওয়ার অবস্থা হয়নি। এছাড়াও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন হাওরপারের মানুষ। কাটছে নির্ঘুমরাত। কারণ নতুন উপদ্রব ‘আফাল’ আর ‘বলন’। এ দুইটি উপদ্রবই হাকালুকি হাওর এলাকার মানুষের নতুন আতঙ্ক। আফাল (বড় ঢেউ) ও বলনের (ঘূর্ণায়মান ঢেউ) তোড়ে চোখের সামনে ঘরবাড়ি বিলীন হচ্ছে। এদিকে জেলা পরিষদের ভা-ারে ত্রাণ পুড়িয়ে যাওয়ায় বিভিন্ন ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে জেলা পরিষদের ত্রাণ ভা-ারে সাহায্য বা জেলা পরিষদের মাধ্যমে ত্রাণ বিতরণের অনুরোধ জানিয়েছেন মৌলভীবাজার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোঃ আজিজুর রহমান।এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, গত শুক্রবার বিকাল থেকে বন্যার পানি আস্তে আস্তে কমতে শুরু করে। তবে প্রতিদিনের বৃষ্টির কারণে দ্রুত বন্যারর উন্নতি হচ্ছে না। রাস্তাঘাট ও বসতঘরের কিছু পানি কমলেও বন্যার্তদের দুর্ভোগ বাড়ছে। পানি নামার সঙ্গে মারাত্মক দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, দেখা দিচ্ছে অসুখ-বিসুখ।

রংপুর : তিস্তার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে রংপুরের তিন উপজেলায় ১২ ইউনিয়নের ৪৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তিস্তার ডান তীরে ফাটল দেখা দিয়েছে। ফলে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছে তিস্তাপারের মানুষ। সরেজমিন বন্যাকবলিত এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, গঙ্গাচড়ায় ছয় ইউনিয়নের প্রায় ৩০ হাজার পরিবার, পীরগাছার তিন ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার পরিবার, কাউনিয়ার তিন ইউনিয়নের প্রায় ৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। গঙ্গাচড়ায় তিস্তার নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে উপজেলার নোহালী, আলমবিদিতর, কোলকোন্দ, লক্ষ্মীটারী, গজঘণ্টা ও মর্ণেয়া ইউনিয়নের প্রায় ৩ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। পীরগাছা উপজেলার তিন ইউনিয়নের ২০ গ্রামের প্রায় ১০ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। উপজেলার ছাওলা ইউনিয়নের গাবুড়া, শিবদেবচর, আমিনপাড়া, চরছাওলা কামারের হাট, রামসিং, জুয়ানের চরসহ প্রায় ১০টি গ্রাম বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। গ্রামগুলোতে অবস্থিত প্রায় ৮টি প্রাথমিক বিদ্যালয় পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় তা বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।