গাজীপুরে মাল্টিফ্যাবস পোশাক কারখানায় ভয়াবহ বয়লার বিস্ফোরণ ও হতাহতের ঘটনায় জেলা প্রশাসন গঠিত তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। প্রতিবেদনে ওই কমিটি কারখানার বয়লার বিস্ফোরণের পেছনে সাতটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় দুর্ঘটনা না ঘটে এবং কোন প্রাণের ক্ষতি না হয় সেজন্য জন্য ২০টি সুপারিশসহ একটা রূপরেখা এ প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক দেওয়ান মোহাম্মদ হুমায়ুন কবির বৃহস্পতিবার তার ভাওয়াল সম্মেলন কক্ষে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে সাংবাদিকদের জানান, গত ৩জুলাই সন্ধ্যায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকাস্থিত মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামের পোশাক কারখানায় বয়লারের ভয়াবহ বিষ্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এতে কারখানার একটি চারতলা ভবনের নীচতলা ও দ্বিতীয় তলার দুই পাশের দেয়াল ধ্বসে পড়ে এবং দরজা-জানালা ও মেশিনপত্র উড়ে যায় এবং দুমড়ে মুচড়ে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে ধ্বংসস্তুপে পরিনত হয়। কারখানায় ভয়াবহ বিষ্ফোরণ ও ভেঙে পড়া কাঠামোর নিচে চাপা পড়ে এবং বিষ্ফোরিত বয়লারের টুকরোর আঘাতে কর্মকর্তাসহ এপর্যন্ত ১৩ মারা গেছে এবং ৭০ জন আহত হয়েছে। এঘটনায় তদন্তের জন্য ঘটনার দিনই গাজীপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট মোঃ রাহেনুল ইসলামকে প্রধান করে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে ৮ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। তদন্ত শেষে কমিটি বুধবার বিকেলে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। এছাড়াও ঘটনার তদন্তে ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকেও আরো একটি তদন্ত কমিটি গঠণ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের গঠিত ওই কমিটি তদন্তকালে বয়লার বিশেষজ্ঞের মতামত এবং ২৯জনের জবানবন্দি গ্রহণ করে ২৮পৃষ্ঠার প্রতিবেদন দাখিল করে। ভবিষ্যতে যাতে এ জাতীয় দুর্ঘটনা না ঘটে এবং কোন প্রাণের ক্ষতি না হয় সেজন্য জন্য ২০টি সুপারিশসহ একটা রূপরেখা এ প্রতিবেদনে দেওয়া হয়েছে।

জেলা প্রশাসক তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য উল্লেখ করে জানান, কারখানার ওই কক্ষে দুটি বয়লার ছিল। এর মধ্যে একটি ১০ টনের এবং অপরটি পাঁচ টনের। ঘটনার সময় যান্ত্রিকত্রুটির কারনে পাঁচটনের ছোট বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়েছে। বিস্ফোরণে পার্শ্ববর্তী ১০ টনের বয়লারটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। মূলতঃ বয়লারের সেপটিকভাল্বের যান্ত্রিক ত্রুটির কারনে বয়লারটি বিষ্ফোরিত হয়। ১৯৯৬ সালে জার্মানীর অমনিকা কোম্পানীর তৈরী বয়লারটি ঘটনার সময় কারিগরিভাবে একদম নিখুঁত ছিল এটা বলা যাবে না। ১৯৯৮ সালে ইউরোপ এশিয়াটিক কোম্পানী কর্তৃক বয়লারটি স্থাপন করা হয়েছিল। যার রেটিং ছিল ৯৬৮ বর্গফুট। বয়লারটি প্রথম ২০০৩ সালের ১০ জুন বয়লার পরিদর্শক কর্তৃক পরিদর্শন করা হয় এবং রেজিষ্ট্রেশন লাভ করে। সর্বশেষ প্রধান বয়লার পরিদর্শকের কার্যালয় ২০১৬ সালের ৩১ আগস্ট ১০ বারে এ বছর ২৪ জুন পর্যন্ত চালানোর অনুমতি প্রদান করে। বিষ্ফোরণের দিন বয়লারটির রেজিষ্ট্রেশনের মেয়াদ উত্তীর্ণ হলেও বয়লারের আয়ুষ্কাল উত্তীর্ণ হয়েছে এমনি বলা যাবে না। যে কক্ষে বয়লারটি ছিল তার কাঠামোগত বা দেয়াল সুরক্ষিত ছিল না। প্রতিবেদনে প্রতিটি ক্রুটি চিহ্নিত করা হয়েছে। বয়লার বিস্ফোরণের পাঁচটি কারিগরি ও দুটি প্রশাসনিক ত্রুটি ও দুর্বলতা ছিল বলে তদন্ত কমিটি মনে করছে। এগুলো হলো- বয়লারের প্রেশার গেজ নষ্ট হয়ে যাওয়া, ডেলিভারি লাইন বন্ধ থাকা, লিভারটিতে শ্লট না কাটা, অপারেটর কর্তৃক প্রেশার রিলিজ করতে ব্যর্থ হওয়া, বয়লার মেইনটেন্যান্স কর্তৃপক্ষের বয়লার অপারেটরদের তদারকের অভাব, অবকাঠামোগত ও ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কারণে বয়লারটি বিস্ফোরিত হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির নিকট প্রতীয়মান হয়েছে। ঘটনার সময় লিভারটিতে শ্লট কাটা না থাকায় বয়লারের কম্পনে ডেড ওয়েট উচ্চ চাপের দিকে সরে গিয়ে ওভার প্রেশার সিচুয়েশন তৈরি হয়েছিল। ঈদের ছুটির পর কারখানাটি ৪ জুলাই চালু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু কারখানার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমতি না নিয়ে ৩ জুলাই পরীক্ষামূলকভাবে কারখানার বয়লার চালু করা হয়েছিল। তাই এঘটনার জন্য তদন্ত প্রতিবেদনে বয়লার অপারেটরদের দায়ী করা হয়। আবার বয়লার অপারেটরদের সঠিকভাবে তদারকি না করায় ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলী এবং সার্বিক অব্যবস্থাপনার কারনে সংশ্লিষ্ট ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষকে ওই প্রতিবেদনে দায়ী করা হয়েছে।

তিনি আরো জানান, তদন্ত কমিটি ২৮ পৃষ্ঠার তদন্ত রিপোর্ট দাখিল করে। এর সঙ্গে ৯১ পৃষ্ঠা সংযুক্তি দেয়া হয়েছে। তদন্ত কমিটি ওই প্রতিবেদনে ২০টি সুপারিশ দিয়েছে। এতে বিদ্যমান বয়লার অপারেটর নিয়োগ আইন (বয়লার এটেনডেন্ট রুলস ১৯৫৩) সংশোধন করে বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা লেভেল করা, তাদেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, শিল্পঘন এলাকায় বয়লার টেষ্টিং ল্যাব স্থাপন ও সরকার কর্তৃক স্বীকৃত প্রকৌশল প্রতিষ্ঠাণ/সংস্থা থেকে বছরে একবার পরীক্ষা বাধ্যতামূলক নিশ্চিত করা এবং বিদ্যমান বয়লার আইন ১৯২৩ সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধিসহ যুগোপযোগী করার সুপারিশও দেওয়া হয়েছে। এসব সুপারিশে উন্নত বয়লার নির্মাণ ও বয়লারের ক্ষটি সুরক্ষিত করণসহ যথাযথ তদারকের কথা বলা হয়েছে। বয়লার বিষ্ফোরণের এ ঘটনায় কারখানার প্রায় ৩৫ কোটি ৬২ লাখ টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।

তদন্ত কমিটির ২০ সুপারিশ ॥
প্রতিবেদনের তদন্ত কমিটি ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে। এরমধ্যে স্টীম কনজামশন ক্যাপাসিটি অনুযায়ী দেড়গুন স্টীম প্রোডাকশন ক্ষমতা সম্পন্ন বয়লার ক্রয় করা এবং ডেড ওয়েট সিস্টেম বয়লার সেফটি ভাল্ব প্রতিস্থাপন করে স্পিং লোডেড/ আধুনিক সেফটি ভাল্ব স্থাপন করা, চার ঘন্টা অগ্নিপ্রতিরোধক ইট দিয়ে দেয়াল নির্মাণ এবং দুই ঘন্টা অগ্নিপ্রতিরোধক দরজা স্থাপন করা। বয়লার রুম ম্যানুয়াল অনুয়ায়ী নির্মাণ করা। অনুমোদিত প্রেসারে বয়লারের সেফটি ভাল্বের সেটিং প্রেসার নিশ্চিত করা। বয়লার ওভার হেড’র উপরে ছয় ফুট ফাঁকা রেখে আরসিসি ছাদ নির্মাণ করতে হবে। সাত দিনে একবার সেফটি ভাল্ব-এর প্রেসার চেকআপ এবং সেফটি ভাল্বের সেফটি ভাল্ব ব্লো-আপ চেক করা, ব্লো-আপ চেক করা, ব্লো-ডাউন-ভাল্ব মাসে একবার চেক করা। প্রতিবছর একবার হাইড্রোস্টাটিক ও হ্যামার টেস্ট করা, স্বল্প শিক্ষিত/ অশিক্ষিত বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম দুইমাসের একটি নিবিড় থিউরি এবং প্রাকটিকেল প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, কারখানায় ন্যূনতম একজন বিএসসি প্রকৌশলী নিয়োগ বাধ্যতামূলক করা এবং বয়লার বন্ধ ও চালু করার সময় প্রকৌশলীর উপস্থিত নিশ্চিত করা ও তার লিখিত প্রত্যয়ন বাধ্যতামূলক থাকা। বয়লার, জেনারেটর, টারবাইন, কেমিক্যাল গোডাউনসহ ঝুকিপূর্ণস্থানের নিরাপত্তা তদারকি মালিক নিজে বা তার নিজস্ব তত্ববধানে সম্পন্ন করা। বয়লার ও টারবাইন তদারকির জন্য ৫সদস্যের কমিটি গঠন, বিদ্যমান বয়লার আইন ১৯২৩ সংশোধন করে শাস্তির মেয়াদ বৃদ্ধি করে যুগোপযোগী করা, বিদ্যমান বয়লার অপারেটর নিয়োগ আইন (বয়লার এটেনডেন্ট রুলস ১৯৫৩) সংশোধন করে বয়লার অপারেটরদের ন্যূনতম শিক্ষাগত যোগ্যতা ডিপ্লোমা লেভেল করাসহ ২০টি সুপারিশ করা হয়েছে।

জেলা প্রশাসক আরো জানান, অন্ততঃ গাজীপুরে যাতে আর কোন প্রাণের ক্ষতি না হয় সেজন্য এখন থেকে জেলা প্রশাসনের একাধিক টিম জেলার কারখানাগুলোতে নিয়মিত পরিদর্শণ করবে। প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এসময় তিনি অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, মাদক, জুয়া ও পতিতাবৃতিসহ অসামাজিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে কর্মসূচি গ্রহনের ঘোষণা দেন।

সংবাদ সম্মেলনে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মাহমুদ হাসানসহ বিভিন্ন কর্মকর্তা ও সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

উল্লেখ্য, গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের কাশিমপুর নয়াপাড়া এলাকায় মাল্টিফ্যাবস লিমিটেড নামের এ পোশাক কারখানাটি ১৯৯২-৯৩ইং সালে প্রতিষ্ঠিত হয়। এ কারখানায় সুইডেন, ডেনমার্ক, জার্মানী, জাপান, রাশিয়া, স্পেন, নেদারল্যান্ডস ও ইউকে সহ বিভিন্ন দেশের কাজ করে থাকে।