উত্তরের জেলাগুলোর নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় অবনতি হচ্ছে বন্যা পরিস্থিতির।অন্তত ১০ দিন পানিবন্দি ওই অঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।বুধবার বার ব্রহ্মপুত্র,ঘাঘট, ধরলা ও যমুনার পানি বেড়ে বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া তিস্তার পানি কিছুটা কমলেও বিপৎসীমার উপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে।নদ-নদীর পানি বেড়ে উত্তরের গাইবান্ধা, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, নীলফামারী, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জের নিম্নাঞ্চলের কয়েক লাখ লোক পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে। অন্তত ১০ দিন ধরে পানিবন্দি থাকায় ওই অঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট।বন্যায় দেশের ১৩ জেলায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী।বুধবার সচিবালয়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী এই তথ্য জানান।

মন্ত্রী বিভিন্ন জেলার বন্যা পরিস্থিতি তুলে ধরে বলেন, উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯০টি পর্যবেক্ষণ পয়েন্টের মধ্যে ১২টিতে পানি বিপৎসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। ৫৫টি পয়েন্টে পানি বৃদ্ধি পেয়েছে।ত্রাণের তথ্য তুলে ধরে মন্ত্রী বলেন, ৩ জুলাই থেকে গতকাল পর্যন্ত ১৩ জেলায় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চার হাজার মেট্রিক টন চাল, ১ কোটি ৯ লাখ ৫০ হাজার টাকা ও সাড়ে ১৮ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো খাদ্য আছে বলেও জানান মন্ত্রী।সংবাদ সম্মেলনে অন্যদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণসচিব মো. শাহ কামাল। ত্রাণসামগ্রীর ‘অভাব নেই’ জানিয়ে ‘বন্যা নিয়ে রাজনীতি’ না করে দলমত নির্বিশেষে সবাইকে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানোর অনুরোধ করেছেন তিনি।

উজানের ঢল ও ভারি বর্ষণে দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় চলতি মাসের শুরু থেকে বন্যা চলছে। সব মিলিয়ে মোট ৪৫ উপজেলায় কয়েক লাখ মানুষ এখন পানিবন্দি।বাড়ি-ঘর ডুবে যাওয়ায় অনেকে নিরাশ্রয় হয়ে পড়েছেন। পানি ওঠায় বন্ধ রাখা হয়েছে কয়েকশ বিদ্যালয়।এর মধ্যে আরও কয়েকদিন ভারি বর্ষণের আভাস দিয়েছে আবহাওয়া অধিদপ্তর; ফলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটতে পারে।বন্যা পরিস্থিতি নিয়ে বুধবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে মন্ত্রী মায়া বলেন, সিলেট, মৌলভীবাজার, কক্সবাজার, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, লালমনিরহাট, নীলফামারী, বগুড়া, জামালপুর, সিরাজগঞ্জ জেলা বর্তমানে বন্যা কবলিত। উত্তরের পানি মধ্যাঞ্চলে নেমে এলে আরও নতুন জেলা প্লাবিত হতে পারে।মঙ্গলবার পর্যন্ত দেশের নয়টি নদীর পানি ১৭টি পয়েন্টে বিপৎসীমার উপর দিয়ে বইছিল। এসব নদীর মোট ৫৫টি পয়েন্টে পানি বাড়ার প্রবণতা অব্যাহত ছিল।মায়া বলেন, উজানের দেশ চীন, ভারত, নেপাল ও ভুটানে এবার বন্যা হয়েছে। ৃ ভাটির দেশ হিসেবে উজানের প্রভাব আমাদের ওপর পড়বে। তার আলোকে আমরা প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণ করে বন্যা পরিস্থিতি মোকাবেলা করছি এবং মানুষের জন্য সহনশীল অবস্থায় রাখতে সক্ষম হয়েছি।

বন্যা কবলিত ১৩ জেলায় গত ৩ থেকে ১১ জুলাই পর্যন্ত ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে চার হাজার মেট্রিক টন চাল, এক কোটি নয় লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং নয় ধরনের শুকনো খাবারের সমন্বয়ে সাড়ে ১৮ হাজার প্যাকেট খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানান মন্ত্রী।দুর্গত ১৩ জেলার ৪৫ উপজেলায় সাড়ে ছয় লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আমরা জেলা প্রশাসকদের বলেছি, তাদের চাহিদা মত খাদ্যশস্য ও আর্থিক বরাদ্দ দেওয়া হবে। একটি লোকও যাতে খাবারের কারণে কষ্ট না পায় সেজন্য জেলা প্রশাসনকে সর্বাত্মকভাবে চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, যারা খোলা আকাশের নিচে, উঁচু বাঁধে বা রাস্তায় আশ্রয় নিয়েছেন তাদের আশ্রয়কেন্দ্রে নেওয়া হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে খাবার, বিশুদ্ধ পানি ও চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে।জনস্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের অনুরোধ জানাব, তারা যেন বন্যা প্লাবিত এলাকার টিউবওয়েলগুলো উঁচু করে দিয়ে এবং পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়ান।

বৃহস্পতিবার থেকে উত্তরাঞ্চলের বন্যা প্লাবিত প্রত্যেকটি এলাকা সফর করবেন জানিয়ে মায়া বলেন, সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করব নিজ নিজ এলাকা সফর করে বন্যা প্লাবিত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করতে, আমাদের ত্রাণসামগ্রীর কোনো অভাব নেই।আর বিএনপি নেতাদের উদ্দেশ্যে তার বক্তব্য- বন্যা নিয়ে রাজনীতি না করে আমি দলমত নির্বিশেষে সবাইকে আহ্বান জানাব- আসুন আমরা বন্যা প্লাবিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে নিজেদের মানবিক কর্তব্য পালন করি।

মায়া বলেন, সরকার প্রত্যেক জেলার বন্যা পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিয়মিত বন্যা ও ত্রাণ কার্যক্রমের খোঁজ-খবর নিচ্ছেন, প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিচ্ছেন।

প্রতিদিন প্রতি জেলার ক্ষয়ক্ষতি, ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম, আশ্রয়কেন্দ্রে আসা মানুষের পরিস্থিতি নিয়ে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ রাখছি।এক প্রশ্নের জবাবে মায়া বলেন, সিলেট ও মৌলভীবাজারে ৩২টি আশ্রয়কেন্দ্রে এক হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন। উত্তরাঞ্চলেও আশ্রয়কেন্দ্র খোলার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।এবার বন্যা হবে ধরে নিয়ে আমাদের প্রস্তুতি ছিল। প্রত্যেক জেলায় প্রচুর ত্রাণ সামগ্রী মজুদ রয়েছে। এবার ৯৮ হাজার শুকনা খাবারের প্যাকেট তৈরি করে রেখেছি। কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলে যেন তাৎক্ষণিকভাবে খাবারের চিন্তা করতে না হয়।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ সচিব শাহ কামাল ছাড়াও মন্ত্রণালয়ের অন্য কর্মকর্তারা সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন।

কুড়িগ্রাম : কুড়িগ্রামে বন্যার পানিতে সড়ক ডুবে যাওয়ায় কলাগাছের ভেলায় করে যাতায়াত করছেন দুর্গতরা। ছবি: সফি খানঅবিরাম বর্ষণ ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি ঘটেছে। আজ বুধবার সকালে ব্রহ্মপুত্র নদের পানি বিপদ সীমার ৩২ সেন্টিমিটার ও ধরলা নদীর পানি ২৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে।এ ছাড়া জেলার তিস্তা, দুধকুমার, হলহলিয়া, জিঞ্জিরাম, সোনাভড়িসহ ১৬টি নদ-নদীর পানি বাড়ায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। জেলার ৯ উপজেলার ৩৫টি ইউনিয়নে আড়াই শ গ্রামের ৩ লাখেরও বেশি মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে।মঙ্গলবার উজান থেকে নেমে আসা পানির প্রবল ¯্রােতে মোগলবাসা বাজার ও হোলখানা বাংটুর ঘাট এলাকায় তীর রক্ষা বাঁধে ভাঙন দেখা দিয়েছে। এতে হুমকির মুখে পরেছে বাজার ও হোলখানা ইউনিয়ন। পানি উন্নয়ন বোর্ড বালির বস্তা এবং বাঁশের পাইলিং দিয়ে ভাঙন ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শফিকুল ইসলাম জানান, কুড়িগ্রাম শহর রক্ষা বাঁধসহ যেখানে ঝুঁকি আছে স্থানীয় জনগণের সহায়তায় বালির বস্তা ও বাঁশের পাইলিং দিয়ে ভাঙন রোধ করছি। আপাতত কোনো সমস্যা নাই।বন্যা কবলিত এলাকাগুলোতে দেখা দিয়েছে বিশুদ্ধ পানির সংকট। নৌকা ও কলার ভেলায় চলাচল করছেন স্থানীয়রা। বন্ধ হয়ে গেছে ৮০টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। ইউনিয়ন পর্যায়ে ৩২টি কমিউনিটি ক্লিনিকের চারপাশে পানি ওঠায় ব্যাহত হচ্ছে চিকিৎসাসেবা। পানি বাড়তে থাকায় অনেক পরিবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পার্শ্ববর্তী আবাসন, বাঁধে আশ্রয় নিচ্ছেন। শত শত একর পাটখেত তলিয়ে গেছে। গবাদিপশুর খাবার নিয়ে সংকটে পড়েছে কৃষক।

সদর উপজেলার চর রসুলপুর এলাকার কৃষক আবদুল কাদের বলেন, ‘নিজেদেরই খাবার ফুরিয়ে যাচ্ছে। ঘরে মাচা করে আছি। গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগি রাখি কোথায়।বন্যা কবলিত এলাকায় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে চাল, শুকনা খাবার ও প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বিতরণ হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় কম বলে অভিযোগ দুর্গতদের। তবে, কুড়িগ্রামের জেলা প্রশাসক আবু ছালেহ মোহাম্মদ ফেরদৌস খান জানান, বন্যা কবলিত উপজেলাগুলোতে দুই হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার, দেড় শ’ মেট্রিকটন চাল ও ৩ লাখ ২৫ হাজার টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত সার্বিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

জামালপুর: জামালপুরে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত সারা জেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে সড়ক যোগাযোগ। পানি বাড়ায় মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজে বেড়াচ্ছে। পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্র না থাকায় অনেকে রাস্তা, সেতু ও বাঁধের ওপর আশ্রয় নিচ্ছে। বন্যার কারণে জেলার ১৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে।

সকাল থেকে বিকেল পাঁচটা পর্যন্ত বিভিন্ন এলাকা ঘুরে এ চিত্র পাওয়া যায়। বন্যাদুর্গত মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলে, ঘরবাড়ি তলিয়ে যাওয়ার পর তারা কোনো আশ্রয়কেন্দ্র খুঁজে পায়নি। তাদের কাছে পৌঁছায়নি কোনো ত্রাণসামগ্রী।এ বিষয়ে জামালপুরের জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর বলেন, দুর্গত এলাকার প্রায় পরিবারেরই কয়েক দিনের জন্য খাবার ঘরে থাকে। তারপরও কয়েক দিন ধরে বিভিন্ন এলাকায় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।সরেজমিনে দেখা যায়, গতকাল বিকেল পাঁচটার দিকে যমুনার বাহাদুরাবাদ ঘাট পয়েন্টে পানি বিপৎসীমার ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। এতে ইসলামপুর, দেওয়ানগঞ্জ, মেলান্দহ ও মাদারগঞ্জ উপজেলার লাখো মানুষ পানিবন্দী হয়ে পড়েছে। দুর্গত এলাকায় এখনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি।বন্যার পানিতে ইসলামপুর-গুঠাইল, ইসলামপুর-উলিয়া, বলিয়াদহ-সিংভাঙা, মেলান্দহ-মাহমুদপুর সড়ক তলিয়ে যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। চারটি উপজেলায় ১৩১টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। ইসলামপুর উপজেলার দেওয়ানপাড়া, সিংভাঙা, ডেবরাইপ্যাচ, দক্ষিণ চিনাডুলী, বলিয়াহদ, ঢেংগারঘর, দরজিপাড়া, খলিশাকুড়ি, নবকুড়া, নোয়ারপাড়াসহ বেশির ভাগ এলাকায় এখনো ত্রাণসামগ্রী পৌঁছায়নি।সকালে নৌকায় ইসলামপুরের দেওয়ানপাড়া এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি ঘরে পানি, অনেকেই খাটের ওপর বসে রয়েছে। অনেকে আবার আসবাব নিয়ে আশ্রয়ের খুঁজে রয়েছে। অনেকের দরজায় ছোট ছোট তালা লাগানো। পুরো এলাকায় তীব্র খাবার-সংকট। মাঝে মাঝে পানি সাঁতরে বা কলাগাছের ভেলায় বাড়িঘর দেখতে আসে কিছু বন্যার্ত মানুষ।

দুপুরে হাওয়া বেগম কলাগাছের ভেলায় বাড়িঘর দেখতে এসেছেন। তাঁর সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, বাপু গত চার দিন থেকে পানি উঠানে ছিল। গত রাত থেকে হু হু করে বানের পানিতে ঘর তলিয়ে যায়। রাতে পরিবারের সবাই চকির মধ্যে ছিল। সকালে ডেবরাইপ্যাচ ব্রিজের ওপর আশ্রয় নিয়েছি। রাত থেকে সবাই না খাওয়া। কোথাও আগুন জ্বালানোর উপায় নাই। ত্রাণসামগ্রী তো দূরের কথা, আমাগো দুঃখ দেখতে প্রশাসনের কোনো লোকজন এখনো আসেননি।বেলা তিনটার দিকে ডেবরাইপ্যাচ সেতুর ওপর বৃদ্ধ আজগর আলী বসে ছিলেন। এ সময় তিনি মুড়ি খাচ্ছিলেন। তিনি বললেন, বাকিতে মুড়ি কিনেছেন। সকালে রান্না হয়নি। বাড়িতেও কোনো খাবার নেই। পরিবারের লোকজনও না খাওয়া অবস্থায়। গত তিন দিনে কোনো লোকজন তাঁদের ত্রাণসামগ্রী দেয়নি। বিশুদ্ধ খাওয়ার পানি ও খাবারের তীব্র সংকট রয়েছে। তাঁরসহ অনেকেরই কথা, আশ্রয়কেন্দ্র থাকলে তাঁদের এই যুদ্ধ করতে হতো না।জেলা প্রশাসক আহমেদ কবীর বলেন, গত রাত থেকে বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে ৯০ মেট্রিক টন চাল, ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং ১ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। দুর্গত এলাকার সংশ্লিষ্ট ইউএনওদের ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পর্যাপ্ত পরিমাণ ত্রাণসামগ্রী মজুত রয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী প্রতিটি দুর্গত এলাকায় পৌঁছে যাবে। বন্যার্তদের জন্য ১৫টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে।

লালমনিরহাট: লালমনিরহাটে সদর উপজেলায় নতুন করে আরও ১০ হাজার পরিবারসহ প্রায় ২৫ হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়েছে পড়েছে।

বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর মাঝে সরকারিভাবে ত্রাণ বিতরণ করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন। তবে এসব ত্রাণ সামগ্রী প্রয়োজনের থেকে অপ্রতুল বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের।এদিকে আদিতমারী উপজেলার মহিষখোচা ইউনিয়নের কুটিরপাড় এলাকায় নির্মিত একটি বালুর বাঁধের ৩০০ ফিট তিস্তার পানির তোড়ে ভেঙে পড়েছে। স্থানীয়রা ভাঙা অংশে বালুর বস্তা আর বাঁশ দিয়ে বাঁধ রক্ষার চেষ্টা করছে।

আদিতমারী উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) আসাদুজ্জামান বলেন, ক্ষতিগ্রস্ত বাঁধ রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আর বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত আদিতমারী উপজেলার প্রায় ৫ হাজার পরিবারের মাঝে ১০ মেট্রিক টন ত্রাণের চাল বিতরণের প্রস্তুতি চলছে।এরমধ্যে দুই শত পরিবারের মাঝে শুকনা খাবার বিতরণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

সদর উপজেলায় ধরলা আর তিস্তার তীরবর্তী প্রায় ১০ হাজার ২০০ পরিবার নতুন করে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব পরিবারের মাঝে দুই শত প্যাকেট শুকনা খাবার সরবরাহের পাশাপাশি ১০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সদর উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা (ইউএনও) শফিকুল ইসলাম।হাতীবান্ধা উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত নয় হাজার পরিবারের মাঝে ২০ মেট্রিক টন ত্রাণের চাল বিতরণের পাশাপাশি প্রায় ১৩৫০ প্যাকেট শুকনা খাবার সরবরাহের কাজ অব্যাহত রয়েছে।মঙ্গলবার সকাল থেকে হাতীবান্ধার বিভিন্ন ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ত্রাণ বিতরণ করেন লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক আবুল ফয়েজ মো. আলাউদ্দিন খান।

নীলফামারী: নীলফামারীর ডালিয়া পয়েন্ট তিস্তার পানি কমলেও বিপৎসীমার ১৪ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তাছাড়া পানি বেড়েছে বুড়ি তিস্তা, চারালকাটা, বুড়িখোড়া, যমুনেশ্বরী, খড়খড়িয়া, দেওনাই, খেড়ুয়া, শালকি, নাউতারা, কুমলাই, ধুম, ধাইজান, চিকলি নদীতে।ফলে নদী তীরবর্তী ডিমলা ও জলঢাকা উপজেলার ১০টি ইউনিয়ন প্লাবিত হয়ে পানিবন্দি অর্ধলক্ষাধিক পরিবারে দেখা দিয়েছে খাদ্যাভাব এবং নানা সংকট।

নীলফামারীর ডালিয়া ডিভিশনের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী মোহাম্মদ হাফিজুল হক বলেন, মঙ্গলবার সকাল থেকে উজানে আবারও ভারি বৃষ্টিপাত শুরু হওয়া তিস্তার পানি আরও দুই/তিন দিন বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হতে পারে।জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, তিস্তা নদীর পানি বিপৎসীমরা উপর প্রবাহিত হওয়ায় নদীর র্তীরবতি ডিমলা উপজেলার টেপাখড়িবাড়ি, ঝুনাগাছ চাপানি, খালিশা চাপানি, পূর্ব ছাতনাই, খগাখড়িবাড়ি, গয়াবাড়ি এবং জলঢাকা উপজেলার গোলমুন্ডা, শৌলমারী, কৈমারী ও ডাউয়াবাড়ি ইউনিয়নে বন্যা দেখা দিয়েছে।এই দশ ইউনিয়নের অর্ধলক্ষাধিক পরিবার পানিবন্দি হয়ে আছে। এর মধ্যে বেশি সংকটে টেপাখড়িবাড়ি ও ঝুনাগাছ চাপানি ইউনিয়নের মানুষ।

পূর্ব ছাতনাই ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল লতিফ খান জানান, নদীর পানি কমলেও বন্যা পরিস্থিতি তেমন উন্নতি ঘটেনি। আমার ইউনিয়নের দুইটি গ্রাম ঝাঁড়সিংহেশ্বর ও পূর্বছাতনাইয়ে অন্তত ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।ওই দুই গ্রামের মানুষের খাদ্যাভাবে পড়েছে। তাদের মাঝে দ্রুত শুকনো খাবার বিতরণ করা প্রয়োজন।

এসব ক্ষতিগ্রস্তদের তালিকা প্রণয়ন করে প্রশাসনের কাছে হস্তান্ত করা হচ্ছে বলে জানান এ চেয়ারম্যান।জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খালেদ রহীম বলেন, “কিছু মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। সেটা দেখা হচ্ছে। আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে নিয়ন্ত্রণ সেল খুলেছি এবং বিষয়টি উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানাচ্ছি সময়মত।

বন্যা কবলিত এলাকায় ৪০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া রয়েছে বলে জানান জেলা প্রশাসক।বন্যার পানিতে তলিয়ে যাওয়া জামালপুরের চিনাডুলি ইউনিয়নের বলিয়াদহ গ্রামের সড়কের ছবিটি মঙ্গলবারের।

সিরাজগঞ্জ: যমুনা নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে সিরাজগঞ্জের পাঁচ উপজেলার চরাঞ্চলের ২৮টি ইউনিয়নের নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে। এতে প্রায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।

যমুনায় পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকায় প্রতিদিনই জেলার নদী তীরবর্তী নিম্নাঞ্চলসহ সিরাজগঞ্জ পৌর এলাকার বেশ কিছু অঞ্চল প্লাবিত হচ্ছে।অপরদিকে পানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরের আরকান্দি থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরী পর্যন্ত এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হয়েছে। ডুবে গেছে এসব অঞ্চলের শত শত একর ফসলি জমি।

সিরাজগঞ্জ পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, কাজীপুরের মাছুয়াকান্দিতে ক্রসবার বাঁধের স্যাংক ভেঙে গেলেও সেখানে জরুরি ভিত্তিতে জিওব্যাগ বালির বস্তা নিক্ষেপের জন্য বরাদ্দ তো দূরের কথা, এখনও বোর্ড থেকে অনুমতিই পাইনি। সদর উপজেলার বাহুকা নামক স্থানেও থেমে থেমে পাড় ভাঙছে।চৌহালী উপজেলার এনায়েতপুরের আরকান্দি থেকে শাহজাদপুরের কৈজুরী পর্যন্ত এলাকায় নদী ভাঙন শুরু হলেও সেখানে বাঁধ না থাকায় কোনো বরাদ্ধ পাওয়া যায়নি বলে জানান তিনি।সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক কামরুন্নাহার সিদ্দীকা জানান, “এখনও সিরাজগঞ্জ জেলায় বন্যা ভয়াবহ অবস্থায় রূপ নেয়নি। এখনও অবস্থা আমাদের নিয়ন্ত্রণেই রয়েছে। বন্যা উপদ্রুত এলাকায় সার্বিক খোঁজ-খবর রাখার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

এরই মধ্যে সদরের সয়দাবাদ ও কাজিপুরের শুভগাছায় ৫ শতাধিক পরিবারকে খয়রাতি ১০ কেজি করে চাল ও নগদ ২০০ টাকা করে সহায়তা দেওয়া হয়েছে বলে জানান তিনি।সিরাজগঞ্জ জেলা ত্রাণ ও পূর্নবাসন কর্মকর্তা আব্দুর রহিম জানান, সরকারি হিসাবে চরাঞ্চলের ২ হাজার পরিবারের ১০ হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়েছে। নতুন করে আরও যে সকল এলাকা প্লাবিত হচ্ছে সেই সব এলাকার তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে।ব্রহ্মপুত্র নদীর পানি বাড়ায় গাইবান্ধার ফুলছড়ি উপজেলার ফজলুপুর ইউনিয়নের কচুখালি গ্রামের বসতবাড়ি হাঁটু পানিতে তলিয়ে।

গাইবান্ধা: গাইবান্ধায় সুন্দরগঞ্জ, গাইবান্ধা সদর, ফুলছড়ি ও সাঘাটা উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। চার উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে।এদিকে পানির তোড়ে গাইবান্ধার সদর উপজেলার কামারজানি বন্দরের দক্ষিণ দিকে ভাঙন শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে ২০টি ঘরবাড়ি সরিয়ে নিতে হয়েছে।

এছাড়া শ্রীপুর ও কামারজানির সীমান্তে সরাইল রেগুলেটরটি ভাঙনের মুখে পড়েছে। পানি উন্নয়ন বোর্ড রেগুলেটরটি রক্ষায় ওই এলাকায় বালি ভর্তি জিও ব্যাগ ব্রহ্মপুত্রের তীরে নিক্ষেপ করছে।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা ইদ্রিস আলী জানান, বন্যায় দুর্গত এলাকার মানুষদের জন্য এ পর্যন্ত ১২৫ মেট্রিক টন চাল ও ১০ লাখ টাকা এবং দুই হাজার প্যাকেট (৫ কেজির) শুকনো খাবার বরাদ্দ পাওয়া গেছে। তার মধ্যে মঙ্গলবার বন্যা কবলিত মানুষদের মাঝে ৯০ মেট্রিক টন চাল ও নগদ ছয় লাখ টাকা বিতরণ করা হয়েছে।