বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেছেন, তার দল আগামিতে ক্ষমতায় গেলে সংসদে আইন করে সুপ্রিমকোর্টের জন্য আলাদা সেক্রেটারিয়েট (সচিবালয়) প্রতিষ্ঠা করবে।শনিবার রাজধানীতে জাতীয় প্রেসক্লাবে স্বাধীনতা অধিকার আন্দোলন’ আয়োজিত ‘বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ও বর্তমান প্রেক্ষাপট শীর্ষক আলোচনা সভায় তিনি এ কথা বলেন।মওদুদ বলেন,আলদা সচিবালয় প্রতিষ্ঠার কারণ তুলে ধরে সাবেক আইনমন্ত্রী বলেন,এখনো নিম্ন আদালতের বিচারকরা আইন মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকেন।তিনি বলেন, সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভবপর হবে না যতদিন পর্যন্ত নিম্ন আদালতের সমস্ত নিয়োগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা রক্ষা করার সমস্ত দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের ওপর অর্পিত না হয়।
আমরা মনে করি, সেজন্য বিচার বিভাগের জন্য আলাদা সচিবালয় প্রয়োজন হবে এবং সেদিন সেটা করা হবে সেদিনই সম্পূর্ণভাবে বিচার বিভাগ স্বাধীন হবে এবং আইন মন্ত্রণালয় বা প্রশাসন বা সরকারের ওপরে আমাদের বিচার বিভাগ আর নির্ভরশীল হতে হবে না।এ সময় তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে সুরক্ষা করার জন্য সংসদের দ্বারা আইন করে সুপ্রিম কোর্টের জন্য আলাদা একটা সেক্রেটারিয়েট প্রতিষ্ঠা করবো। ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলে সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগের রায়কে ‘ঐতিহাসিক’ অভিহিত করে মওদুদ আহমদ বলেন, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে একটি ফ্যাসিবাদী সরকার ক্ষমতাসীন আছেন, সেই প্রেক্ষাপটে এই রায় দেশের সব শ্রেণির মানুষের মনের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটিয়েছে।তিনি বলেন, এই রায়ের মাধ্যমে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আরো সুরক্ষিত হবে। বাংলাদেশের মানুষ এখন প্রত্যাশা করে যে, তারা আইনের শাসন দেখবে এবং দেশের সব মানুষের সমান অধিকার দেখবে।
তিনি আরও বলেন, সুপ্রিম কোর্ট একটা ব্রাইভরেন্ট, একটা ফাংশনাল, একটা এফেক্টিভ একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাংলাদেশের মানুষের রক্ষাকবজ হিসেবে কাজ করবেন- এটাই আমরা প্রত্যাশা করি।নিম্ন আদালতের বর্তমান অবস্থা তুলে ধরে ‘ সত্যিকার অর্থে বিচারবিভাগ পৃথকীকরণ হয়নি বলে মন্তব্য করেন মওদুদ।তিনি বলেন, আগে আমলাদের মধ্যে প্রশাসন থেকে যারা এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে কাজ করতেন, তাদের চাইতে এখন জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটরা অনেক নিম্ন স্তরের পরিচয় দেন।তিনি বলেন, বিচারের ক্ষেত্রে তারা (জুডিশিয়াল ম্যাজেস্ট্রেট) একেবারেই নমনীয় হয়ে যান সরকারের প্রভাবে, রাজনৈতিক প্রভাবে। আজকে সেজন্য মাঝে মধ্যে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারবিভাগ প্রশাসনের কাছে জিম্মি, মাঝে-মাঝে তিনি ক্ষোভও প্রকাশ করেন। এই ক্ষোভের পেছনের একটি মাত্র জিনিস সবচাইতে বেশি কাজ করে তা হলো বিবেক।৭২ সালের সংবিধানের প্রসঙ্গ টেনে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করে মওদুদ আহমদ বলেন, এই সরকারের অনেক নেতৃবৃন্দরা যারা ৭২ সালের সংবিধানের কথা বলেন তাদের লজ্জা হওয়া উচিৎ।
৭২ সালের সংবিধান ভালো ছিল উল্লেখ করে একে সংশোধন করে বিকৃত করার অভিযোগ করেন। তিনি বলেন, সেই সংবিধানকে আপনারাই তো খন্ডবিখন্ড করেছেন, ডিফাই করেছেন ডিফেইজ করেছেন ট্রাংকেট করে দেশে একদলীয় স্বৈরাচারি সরকার কায়েম করেছিলেন।তিনি বলেন, আমি বলব, আপনারা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করুন, ’৭২ সালের সংবিধানকে আপনারা কী করেছিলেন? চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে সংশোধন করে কী লিখেছিলেন, ভুলে গেছেন?মওদুদ প্রশ্ন রেখে বলেন, নো ইমপিচমেন্টও হবে না, কোনো সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল না, রাষ্ট্রপতি একাই যেকোনো বিচারপতিকে অপসারণ করে দিতে পারবেন- এই কথাটা কারা সংবিধানে লিখেছিলেন, ১১৬ অনুচ্ছেদ কারা বাতিল করেছিলেন? তারা এখন বলে আমাদের ৭২ সালের সংবিধান লঙ্ঘন করে এই রায় দেয়া হয়েছে।বিচারক অপসারণে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে দেয়া রায়ের প্রশংসা করেন এ বিএনপি নেতা।
তিনি বলেন বলেন, কাদের হাতে আমরা বিচারকদের অপসারণের দায়িত্ব দিতে চাই? এই সংসদ? যারা অধিকাংশই নির্বাচিত নন, তাদের কাছে? আমাদের দেশে গণতন্ত্র এখনো মেচ্যুরিটি অর্জন করতে পারে নাই, ইট ইজ এ ইমমেচ্যুর ডিমোক্রেসি, এখানে গণতন্ত্র নেই, গণতন্ত্র চর্চা নেই।তিনি আরও বলেন, সরকার চেয়েছিলো ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে বিচার বিভাগকে করায়ত্ব করা ও আরো নতজানু করা। যাতে করে উচ্চতম আদালতও নিম্নতম আদালতের মতো তাদের কথা শুনে, তারা ভয় পায় যাতে করে তারা সরকারের বিরুদ্ধে কোনো রায় না দেয়।ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় এখন সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের মাধ্যমে বিচারপতি অপসারণ করতে হবে মন্তব্য করে এই কাউন্সিল গঠনের বিষয়টি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান প্রবর্তন করেছিলে বলে উল্লেখ করেন মওদুদ।
ষোড়শ সংশোধনীর বিষয়ে ক্ষমতাসীন দলের সমালোচনা করে নাগরিক ঐক্যের আহবায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, উনারা (সরকার) বলেছেন যে, ষোড়শ সংশোধনীর বাতিলের মধ্য দিয়ে আমরা প্রমাণ করলাম দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা আছে। তাহলে আবার অপেক্ষা করছেন কেনো যে, পুরো রায়টা দেখি, তারপরে কথা বলব, আপিল করবো কিনা।তিনি বলেন, আমাদের এটর্নি জেনারেল বললেন যে, এই রায়ে আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছি। সমগ্র দেশ আনন্দিত হয়েছে আর উনি (এটর্নি জেনারেল) হতাশ হয়েছেন কেনো? তার মানে কী করবেন জ্বালা সইতে পারছে না। এই জ্বালা শেষ পর্যন্ত কোথায় যাবে সেটা অন্য কথা।ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের সুপ্রিম কোর্টের রায় দশম সংসদের বিরুদ্ধে ‘চাপাটাঘাত’ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সম্পাদক ব্যারিস্টার মাহবুবউদ্দিন খোকন ষোড়শ সংশোধনীর রায়কে দেশে বিচার বিভাগের স্বাধীনতার জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি পথ নির্দেশনা হিসেবে অভিহিত করেন।তিনি বলেন, এই রায়ে জনগনের আশা-আকাংখার প্রতিফলন ঘটেছে। আমি বলব, অনতিবিলম্বে বিচারক নিয়োগের একটি নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। আমি দাবি করবো, এই নীতিমালা প্রণয়নের আগে যেন কোনো বিচারক নিয়োগ না দেয়া হয়।সংগঠনের সভাপতি কাজী মনিরুজ্জামান মনিরের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় গণফোরামের প্রেসিডিয়ামের সদস্য অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, বিএনপির প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক এ বি এম মোশাররফ হোসেন, নির্বাহী কমিটির সদস্য আবু নাসের মুহাম্মদ রহমাতুল্লাহ প্রমূখ বক্তব্য রাখেন।