দেশবাসী রমজান মাসে সংযম করলেও উজানের ঢলে বাঁধ ভেঙে সর্বস্ব হারানো হাওর পাড়ের কৃষকরা যেন এই সংযম করে আসছে আরও আগে থেকেই। একের পর এক বাঁধ ভাঙা আর বৈরি আবহাওয়া ও বৃষ্টির আঘাতে থমকে গেছে হাওর পাড়ের মানুষের ঈদের আনন্দ। বেঁচে থাকতেই যেখানে নিরন্তন সংগ্রাম করতে হচ্ছে অসহায় কৃষক ও তাদের পরিবারকে, সেখানে ঈদ এবার কোনও উৎসব হিসেবে দাঁড়ায়নি। এবারের অকাল বন্যায় সোনালী ফসলের সঙ্গে সঙ্গে তলিয়ে গেছে হাওরের কৃষকের সব স্বপ্ন। চাওয়া পাওয়া। বানের পানিতে ভেসে গেছে হাওর পাড়ের মানুষের ঈদ আনন্দ।

যে ধানকে পুঁজি করে তাদের বেঁচে থাকা, সে ধানই নেই আর মাঠে। কাঁধে চেপে আছে ঋণের বোঝা, এক বেলা আধা বেলা খেয়ে এখন দিন কাটছে গৃহস্থেরও, ঈদের বার্তা যেন তাদের জন্য এনেছে বুক ভরা কষ্ট আর আহাজারি। কান্না চেপে রেখে দাঁতে দাঁত কামড়ে আগামীর অপেক্ষায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দিন পাড়ি দিচ্ছেন এখন কৃষক। ধান গেলেও ঋণের বোঝা চেপে থাকায় মহাজন ও এনজিওদের চাপে ঈদ তাদের কাটবে নিরানন্দে।যেখানে তাদের বাঁচা-মরার লড়াই সেখানে তারা ভুলে গেছে সবচেয়ে বড় ঈদ আনন্দ ঈদুল ফিতরের কথা। এবারের ঈদ জামাতে হয়তো তারা আল্লাহর কাছে এ প্রার্থনাই করবেন, সব ঋণের বোঝা কাঁধ থেকে নামিয়ে যেন সামনের বোরো মৌসুমে ঘুরে দাঁড়াতে পারেন। পরিবারের মুখে হাসি ফুটিয়ে নিজেদের উপার্জিত টাকায় একমুঠো খাবার তুলে দিতে পারেন। আগামী ঈদের আনন্দে সবার সঙ্গে মিলেমিশে কাজ করতে পারেন।

মিঠামইন উপজেলার কৃষক রমজান আলী চোখে-মুখে ক্লান্তি আর বিষণœতার ছাপ নিয়ে বলেন, এমন অইবো হেইডা তো বুঝতে পারি নাই। আমার ঘরে পাঁচ বছরের একটা মাইয়্যা আছে। আমি মাইয়্যাডার দিহে চাইতারিনা, খুব খারাপ লাগে। হে তো আর অভাব বুঝে না, হের তো ঈদই আনন্দ। অল্প জমাইন্যা টেহা আর এনজিও থেইক্যা ঋণ নিয়া জমি চাষ করছি। কিন্তু অত দেনা লইয়্যা কেমনে বাঁচুম, আর ঈদের কতা তো ভাবতাম পারি না।ইটনা উপজেলার কৃষক জমশেদ মিয়া দুই মেয়ে, এক ছেলে ও স্ত্রী নিয়ে পাঁচজনের সংসার। অল্প কিছু জমিতে ভরা মৌসুমে বোরো আবাদ করেছিলেন। তিনি বলেন, ভাই মহাজনী ঋণ নিয়া আবাদ করছিলাম, প্রতি বছরই তাই করি। কিন্তু এখনতো মরণের পথে, আফনে জিগাইন ঈদের কথা। আগে তো বাঁইচ্যা লই, পরে ঈদের কথা ভাববাম।ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রাম উপজেলার ছোট বড় মার্কেট ও বস্ত্র বিপনী ঘুরে দেখা যায়, প্রতিবছর যেখানে নিম্ন বা মধ্যম আয়ের মানুষজন ঈদের কেনাকাটায় ব্যস্ত সময় পার করতেন। সেখানে এ বছর এসব বস্ত্র বিপনীগুলো প্রায় ক্রেতা শূন্য। ঈদ এসে গেলো, কিন্তু বিক্রি হচ্ছে না প্রায় কিছুই। বিষয়টা আগেভাগে বুঝতে পেরে ব্যবসায়ীরাও এবার ঈদে নতুন করে বিনিয়োগ করার সাহস পাননি। দোকানে যা মজুদ ছিল, এবারের ঈদে সেটাই সম্বল।কাপড় বিক্রেতারা জানান, প্রতিবছরই ঈদুল ফিতরে আমরা বেশ ভালো কাপড় চোপড় বিক্রি করে থাকি। কিন্তু এ বছর অকাল বন্যায় কৃষকের ব্যাপক ক্ষতি হওয়ায় তারা মার্কেটে আসছেন না। যারা আসছেন তারা মধ্যম আয়ের। কিন্তু তারাও খুব একটা বেশি দামের কাপড় কেনার সাহস পাচ্ছেন না। আর নিম্ন আয়ের কৃষকদেরতো দেখাই মিলছে না।

কৃষি বিভাগের সূত্র মতে, এবারের অকাল বন্যায় জেলার হাওরবেষ্টিত অঞ্চল ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ, নিকলী, তাড়াইল, হোসেনপুর, কটিয়াদী, বাজিতপুর ও ভৈরবে এ বছর ১ লাখ ৩৮ হাজার ৯২ জন কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এ দুর্যোগে কৃষকের আবাদকৃত ধানের ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ৬০ হেক্টর। টাকার হিসেবে যা প্রায় নয়শত কোটি টাকা। তার মধ্যে অষ্টগ্রাম, ইটনা, মিঠামইন ও নিকলীতে ক্ষতির পরিমাণ বেশি।তাই হাওর পাড়ের অসহায় কৃষকদের দাবি শুধু ত্রাণ নয়, পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি সংস্থাগুলো যদি ঈদে নতুন বস্ত্র বিতরণ করতো, তাহলে হয়তো তারা পরিবারের সবার সঙ্গে ঈদ আনন্দে অংশীদার হতে পারতেন। সব জরাজীর্ণতাকে ভুলে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে পারতেন। সামনের মৌসুমে নতুন করে বোরো চাষ আবাদের মাধ্যমে বাঁচার স্বপ্ন দেখতেন। এমনটাই প্রত্যাশা করছেন হাওর পাড়ের অসহায় কৃষক ও তাদের পরিবার।