বৃষ্টির পানি জমে থাকা,নিম্নমানের সংস্কার ও অপরিকল্পিত উন্নয়নকাজের জন্য মহাসড়কে ঈদ যাত্রার আগেই দুর্ভোগ চেপে বসেছে। গত ছয় বছরের তুলনায় সড়ক-মহাসড়কে চলাচলের উপযোগিতা বাড়লেও স্থানে স্থানে গর্ত, সড়ক দেবে যাওয়া, সড়কের অংশ বন্ধ রেখে উন্নয়নকাজের ফলে এ অবস্থা দেখা দিয়েছে।গাড়িচালক, যাত্রী ও মহাসড়কের পাশের লোকজন বলছে, ঢাকা-টাঙ্গাইল, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-সিলেট, ঢাকা-যশোর-খুলনা, ঢাকা-আরিচা মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে এরই মধ্যে গাড়ির চাপ বেড়ে যাওয়ায় যানজটে পড়ে যাত্রা-সময় আগের চেয়ে কোথাও দ্বিগুণ বেশি লাগছে।এ সপ্তাহের শেষ দিকে শুরু হবে ঈদ যাত্রার মূল¯্রােত। এর মধ্যে সড়ক-মহাসড়কে সংস্কারকাজ শেষ করতে না পারলে এবং সেই সঙ্গে সমন্বিত ব্যবস্থাপনা না থাকলে ঈদ যাত্রায় পথে পথে ভুগতে হবে যাত্রীদের।
তবে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এরই মধ্যে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কসহ বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়ক পরিদর্শন করেছেন। তিনি প্রকৌশলীদের সব সড়ক-মহাসড়ক যানবাহন চলাচলের উপযোগী রাখতে নির্দেশ দিয়েছেন।ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়ক ব্যবহার করে উত্তরের ১৬ জেলার যাত্রীরা চলাচল করে। তবে চার লেন প্রকল্পের জন্য এ মহাসড়ক নিয়ে যাত্রীদের মধ্যে তৈরি হয়েছে দুশ্চিন্তা। এ পথের যাত্রীরা জানায়, ঢাকার মহাখালী থেকে বগুড়া যেতে স্বাভাবিক সময়ে লাগে পাঁচ ঘণ্টা। এখন লাগছে ১০ ঘণ্টা পর্যন্ত। এর বড় কারণ জয়দেবপুর থেকে এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন নির্মাণের কাজ। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে তিন মাস আগে শুরু হওয়া সংস্কারকাজ।ঢাকা-বগুড়া রুটে চলাচলকারী শাহ ফতেহ আলী পরিবহনের যাত্রী রেজাউল করিম জানান, ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে বাইপাইল হয়ে ওই মহাসড়কের চন্দ্রা, কালিয়াকৈর, মির্জাপুর পর্যন্ত অংশে রাস্তা বন্ধ রেখেও কাজ করা হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, গাজীপুরের জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত চার লেন প্রকল্পের কাজের অংশ হিসেবে গাজীপুরের কোনাবাড়ী ও কালিয়াকৈরে নির্মাণ করা হবে দুটি উড়াল সেতু (ফ্লাইওভার)। নতুন অবকাঠামো নির্মাণের জন্য মহাসড়কের অংশ বন্ধ রেখে কাজ করা হচ্ছে দিনের বেলায়ও। এ ছাড়া সংস্কারকাজ চলছে চন্দ্রা, সফিপুর, মৌচাক, খাড়াজোড়াসহ বিভিন্ন স্থানে। এসব কারণে মহাসড়কে গাড়ি চলাচলের জায়গা কমে গেছে। তা ছাড়া ঈদ সামনে রেখে পণ্য ও যাত্রীবাহী গাড়ি চলাচল বেড়ে যাওয়ায় মহাসড়কের স্থানে স্থানে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে।যাত্রীরা জানায়, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক নিয়ে এর আগে তেমন বড় ধরনের দুর্ভোগে পড়তে হয়নি তাদের। তবে বর্তমানে এ মহাসড়কের বিভিন্ন স্থানে কমপক্ষে ২০ কিলোমিটার অংশ চলাচলের অনুপযোগী। এ কারণে যাত্রাবাড়ী, কুতুবখালী, গাউছিয়া, শেরপুর, সাদীপুরসহ বিভিন্ন অংশে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে যাত্রাবাড়ী থেকে গাউছিয়া অংশের অবস্থা সবচেয়ে খারাপ হয়ে আছে।সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে যাত্রাবাড়ী থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এক কিলোমিটার অংশ দিয়ে গাড়ি চলাচল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়েছে। সেখানে স্থানে স্থানে তৈরি হয়েছে ছোট-বড় সব গর্ত। ফেলে রাখা হয়েছে নির্মাণসামগ্রী।
নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জ ও আড়াইহাজার এবং নরসিংদী, কিশোরগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ বৃহত্তর সিলেটের বিভিন্ন জেলায় যাওয়ার মূলপথ ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক।নারায়ণগঞ্জের ভুলতার গাউছিয়া মার্কেটের কাছে উড়াল সেতু নির্মাণের ফলে মার্কেটের আগে-পরে কমপক্ষে ১২ থেকে ১৫ কিলোমিটার অংশে যানজট সৃষ্টি হচ্ছে। যাত্রাবাড়ী-ডেমরা সড়কও খানাখন্দে ভরা।এ ছাড়া ঢাকা-খুলনা মহাসড়কের গাড়িচালকরা যাত্রীদের নিয়ে সাভার, দৌলতদিয়া, যশোরের পালবাড়ি, মড়ুলিসহ বিভিন্ন স্থানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা যানজটে আটকে পড়ছেন। মহাসড়কে সাভারের বাইশ মাইল থেকে শুরু হয়ে নলাম পর্যন্ত অংশে প্রতিবছরই বর্ষা মৌসুমে পানি জমে যায়।যশোরের পালবাড়ি-দড়াটানা-মনিহার-মড়ুলি মহাসড়কের কোথাও পিচ উঠে গেছে; কোথাও ফুলে উঠেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় পৌনে সাত কোটি টাকা ব্যয়ে যশোর সড়ক বিভাগ সড়কটি সংস্কার করেছে। তবে ছয় মাস যেতে না যেতেই বেহাল হয়ে পড়েছে।এদিকে সংস্কারকাজ শেষ করার এক বছর না যেতেই কাহালু-বগুড়া সংযোগ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার বেহাল হয়ে পড়েছে।বিশেষজ্ঞ মত : বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলাবদ্ধতার কারণে পিচের সড়ক নষ্ট হচ্ছে স্থানে স্থানে। বিটুমিন দিয়ে সড়কের ওপরের অংশ তৈরি করায় টানা বৃষ্টিপাতে সড়ক-মহাসড়কের ওপরের অংশ উঠে যাচ্ছে। এর ওপর রয়েছে অতিরিক্ত ওজনের পণ্যবাহী গাড়ির চলাচল, প্রকৌশলীদের গাফিলতি।বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল হক বলেন, কংক্রিটের সড়ক নির্মাণে একসঙ্গে খরচ বেশি হয়; তবে টিকে বেশিদিন। এরই মধ্যে বিভিন্ন মহাসড়ক ও সড়কের পাশে থাকা বাজার এলাকায় কংক্রিটের সড়ক নির্মাণ করা শুরু হয়েছে।
দায়িত্বশীল কর্মকর্তার বক্তব্য : গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকায় বেহাল মহাসড়ক সম্পর্কে গাজীপুর সড়ক বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী নাহিন রেজা বলেন, ঢাকা-টাঙ্গাইল চার লেন প্রকল্পের কাজ চলছে। এ জন্য এবার ঈদ যাত্রায় একটু দুর্ভোগ হতেই পারে। তবে চন্দ্রায় যাতে গাড়ি চলাচলে একটা ব্যবস্থাপনা থাকে তার জন্য আমরা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মিলে সভা করেছি। দৌলতদিয়া লঞ্চঘাট এবং ১ নম্বর ফেরিঘাটের মাঝে নির্মাণাধীন নতুন ঘাটের জন্য সংযোগ সড়কের কাজ এগোচ্ছে ধীরগতিতে। ছবিটি গতকাল দুপুরে তোলা ষ আশরাফুল আলমদক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের এবারের ঈদযাত্রায় পদ্মা পার হওয়াটা নির্বিঘেœ হবে কি না, তা নির্ভর করছে প্রকৃতির মর্জির ওপর। রাজবাড়ীর দৌলতদিয়ার পরিত্যক্ত ঘাটে জোড়াতালি দিয়ে ঈদের বাড়তি চাপ সামলাতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। তবে ভারী বৃষ্টি বা বাতাসসহ বৃষ্টি হলেই ভাঙনে সমস্ত জোড়াতালি ধুয়েমুছে যাওয়ার শঙ্কাটাকেই বড় করে দেখছেন দায়িত্বরত কর্মকর্তারা।ঘাট তদারকির দায়িত্বে থাকা বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা বলছেন, পদ্মার দৌলতদিয়া প্রান্তে চারটি ঘাটের মধ্যে দুটি গত বছরই পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন ঘাট তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়। এখনো নতুন ঘাটের সংযোগ সড়ক তৈরি না হওয়ায় পরিত্যক্ত ঘাটেই জোড়াতালি দিয়ে এবার ঈদে যানবাহন পারাপার চলবে। তবে ভারী বৃষ্টি বা ভাঙনের কারণে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন তাঁরা। এদিকে পাটুরিয়া প্রান্তের কর্মকর্তারা আশার বাণী শুনিয়ে বলছেন, এবার পাটুরিয়ার চারটি ঘাটই সচল, ফেরিও পর্যাপ্ত।দুই ঘাটে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে এ পর্যন্ত ঘাটের পরিস্থিতিকে ভালো বলছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাসের চাপ ছিল মাঝারি, ট্রাকের চাপ একেবারেই কম। অল্প সময়ের মধ্যেই যানবাহনগুলো পারাপার হচ্ছিল। ঘাটে অপেক্ষমাণ রাজবাড়ীগামী রাবেয়া পরিবহনের চালক মো. সেলিম বলেন, এখন তো ঘাটে অনেক কম সময় লাগছে। আসামাত্রই পার হচ্ছি।সরেজমিনে দেখা যায়, দৌলতদিয়ার ৪ নম্বর ঘাটের পাশ দিয়ে নদীতে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ঘাট এলাকার বেশির ভাগ লোকজন সরে গেছেন, বাকিরাও চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছেন। টিকে আছে শুধু ঘাটটি। যেকোনো সময় এটিও ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা। তাঁরা বলছেন, ৩ নম্বর ঘাটটিও ভাঙনের ঝুঁকিতে আছে।
বিআইডব্লিউটিএর দৌলতদিয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপসহকারী প্রকৌশলী মো. শাহ আলম বলেন, পাটুরিয়া প্রান্তে চারটি ঘাটই সচল রয়েছে। তবে ভাঙনের কারণে দৌলতদিয়া প্রান্তের চারটি ঘাটের মধ্যে ৩ ও ৪ নম্বর ঘাট গত বছরই পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তখনই দৌলতদিয়ায় দুটি নতুন ঘাট তৈরির কাজ শুরু হয়। তবে সড়ক ও জনপথ (সওজ) বিভাগ এখন পর্যন্ত দুই ঘাটের সংযোগ সড়ক তৈরি করতে না পারায় এগুলো এই ঈদেও চালু করা যাচ্ছে না। এখন ৩ ও ৪ নম্বর ঘাট সচল রেখে ঈদের পারাপার করার জন্য সব রকম ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ভাঙন রোধে পাইলিং করা হয়েছে, জিও ব্যাগ ফেলা হয়েছে। তিনি বলেন, ঘাটে পানি এখন মাঝামাঝি পর্যায়ে রয়েছে। এ অবস্থা বহাল থাকলে ঈদের বাড়তি চাপেও পারাপারে তেমন সমস্যা হবে না। তবে কোনো দুর্যোগ ঘটলে পরিস্থিতি বদলাতে পারে।রাস্তা তৈরির কাজ সওজ অধিদপ্তরের। যোগাযোগ করা হলে সওজ রাজবাড়ীর নির্বাহী প্রকৌশলী মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঠিকাদার কাজ করছেন। তাঁর পেছনে কর্মকর্তারা লেগে আছেন, ঠিকাদারকে প্রণোদনা দিয়ে যাচ্ছেন। সবাই প্রাণান্ত চেষ্টা করছেন। রাস্তায় বালু ভরাটের কাজ চলছে। এটি শেষ হলেই অন্য কাজগুলো দ্রুত শেষ হবে। ইট দেখা আছে। রোলার রেডি আছে।সওজ কর্মকর্তারা বলছেন, কাজ কোনোভাবেই ঈদের আগে শেষ করা সম্ভব নয়। দৌলতদিয়া প্রান্ত শঙ্কায় থাকলেও আরিচা প্রান্তের কর্মকর্তারা বলছেন পরিস্থিতি ভালো। বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন সংস্থার (বিআইডব্লিউটিসি) আরিচা কার্যালয়ের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (এজিএম) জিল্লুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, পাটুরিয়ার চারটি ঘাটই পূর্ণমাত্রায় সচল রয়েছে। ঈদে এই চার ঘাটে তাঁদের ১৯টি ফেরি চলাচল করবে। যদি কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটে, তাহলে তেমন একটা ভোগান্তির আশঙ্কা নেই।বিআইডব্লিউটিসির ঘাটে কর্মরত লোকজন বলেন, সাধারণত ঘাটে ১৩ থেকে ১৫টি ফেরি সেবা দিয়ে যায়। এই ফেরি দিয়ে ২৪ ঘণ্টায় গড়ে দুই থেকে সোয়া দুই হাজার যানবাহন পারাপার করা যায়। ঈদের সময় চার ঘাটে ১৯টি ফেরি চলাচল করবে। এর মধ্যে রো রো (বড়) ফেরি ১০টি, ইউটিলিটি ফেরি ৬টি ও কে টাইপ ফেরি রয়েছে ৩টি।কর্মকর্তারা বলেন, এখন পাটুরিয়া থেকে দৌলতদিয়া প্রায় সাড়ে ৩ নটিক্যাল মাইল অতিক্রম করতে একটি ফেরির সময় লাগে ৩৫ থেকে ৪০ মিনিট। এ অবস্থা বহাল থাকলে ঈদের যানবাহন পারাপারে তেমন একটা সমস্যা হবে না। তবে ভারী বৃষ্টি হলে ঘাট ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা থাকে। এ ছাড়া বৃষ্টি হলে ¯্রােতের গতিবেগ বেড়ে যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পারাপারে সময় বেশি লাগবে।পাটুরিয়া ঘাটে কর্মরত মানিকগঞ্জ জেলা পুলিশের ট্রাফিক পরিদর্শক (টিআই) আনোয়ার হোসেন বলেন, ঈদের চাপ সামলাতে পুলিশের ভালো প্রস্তুতি রয়েছে। সে সময় ঘাটের শৃঙ্খলা বজায় রাখতে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন থাকবে।