চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে উড়িয়ে দিয়ে আইসিসি চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির অষ্টম আসরের শিরোপা জিতে নিয়েছে পাকিস্তান। আজ ফাইনালে টিম ইন্ডিয়াকে ১৮০ রানের বড় ব্যবধানে হারায় পাকিস্তান। রানের ক্ষেত্রে এটি পাকিস্তানের সপ্তম বড় জয়। আর ভারতের বিপক্ষে এটি তাদের সবচেয়ে বড় জয়। টিম ইন্ডিয়ার বিপক্ষে পাকিস্তানের আগের বড় জয়টি ছিলো ১৫৯ রানের।
লন্ডনের কেনিংটন ওভালে টস হেরে প্রথমে ব্যাট করে ৫০ ওভারে ৪ উইকেটে ৩৩৮ রান করে পাকিস্তান। দলের পক্ষে জামান ১১৪, আজহার আলী ৫৯ ও মোহাম্মদ হাফিজ অপরাজিত ৫৭ রান করেন। জবাবে ৩০ দশমিক ৩ ওভারে ১৫৮ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত।

ভারতের সামনে ফাইনাল ম্যাচ জয়ের টার্গেট ছিলো ৩৩৯ রান। সেই বড় টার্গেটের লক্ষ্যে খেলতে নেমে পাকিস্তানের পেসার মোহাম্মদ আমিরের তোপে পড়ে ভারত। ইনিংসের তৃতীয় বলেই ভারতের ওপেনার রোহিত শর্মাকে শূন্য রানে বিদায় দেন আমির। উইকেট নেয়ার ধারাবাহিকতা পরবর্তীতেও অব্যাহত রাখেন আমির। নিজের দ্বিতীয় ওভারের চতুর্থ আমির এবার শিকার করেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলিকে। আগের ডেলিভারিতে স্লিপে ক্যাচ দিয়ে বেঁেচ যাওয়া কোহলি, এবার পয়েন্টে ক্যাচ দিয়ে নিজের উইকেটের বির্সজন দেন। ৯ বলে ৫ রান করেন তিনি। ৬ রানে ২ উইকেট হারানোর পর প্রতিরোধ গড়া চেষ্টা করেন আরেক ওপেনার শিখল ধাওয়ান ও যুবরাজ সিং। ৪টি বাউন্ডারিতে খেলার নিয়ন্ত্রন নিজেদের দখলে নেবার চেষ্টা করেন ধাওয়ান। কিন্তু ধাওয়ানের পথেও কাটা হয়ে দাঁড়ান আমির। ২২ বলে ২১ রান তোলার পর আমিরের তৃতীয় শিকার হন ধাওয়ান। ৩৩ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে খাদের কিনারায় পড়ে যাওয়া ভারতকে তোলার দায়িত্ব নেন যুবরাজ ও উইকেটরক্ষক-সাবেক অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি। কিন্তু পাকিস্তানী বোলারদের বিপক্ষে তারাও ব্যর্থ হন। যুবরাজকে ২২ রানে লেগ স্পিনার শাহদাব খান এবং ধোনিকে ৪ রানে শিকার করেন পেসার হাসান আলী। এতে ৫ উইকেটে ৫৪ রানে পরিণত হয়ে ম্যাচে হার দেখে ফেলে ভারত।

সেই হার আরও বেশি নিশ্চিত হয়ে যায়, স্বীকৃত ব্যাটসম্যানদের মধ্যে কেদার যাদবও ব্যক্তিগত ৯ রানে থেমে গেলে। কারন দলীয় ৭২ রানে ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে প্যাভিলিয়নে ফিরেন কেদার। ফলে পাকিস্তানের জয় হয়ে দাড়ায় সময়ের ব্যাপার।
কিন্তু এরপরই পাকিস্তানের জয়কে দীর্ঘায়িত করেন হার্ডিক পান্ডে। পাকিস্তানের বোলারদের উপর চড়াও হন তিনি। ৬টি বিশাল ছক্কা ও ৪টি চার মেরে ওয়ানডে ক্যারিয়ারে নিজের দ্বিতীয় হাফ-সেঞ্চুরির দেখা পান পান্ডে। তার টি-২০ মেজাজে ব্যাটিং-এ বিনোদনের রসদ পায় স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্র্শকরা। কিন্তু পান্ডের মারমুখী মেজাজে পানি ঢেলে দেন তারই সতীর্থ রবীন্দ্র জাজেদা। ২৭তম ওভারের তৃতীয় বলে রানের জন্য ডাক দিয়েও, দৌঁড় দেননি জাদেজা। কিন্তু ঠিকই দৌঁড় দিয়ে রান আউটে নিজেদের ইনিংসের সমাপ্তি টানেন পান্ডে। ফলে ৪৩ বলে ৭৬ রানেই থেমে যায় পান্ডের ইনিংস। জাদেজার সাথে সপ্তম উইকেটে ৫৭ বলে ৮০ রান করেন পান্ডে।

দলীয় ১৫২ রানে পান্ডের বিদায়ের পর, বাকি ৩ উইকেট ৬ রানের ব্যবধানে হারিয়ে ১৫৮ রানেই গুটিয়ে যায় ভারত। পাকিস্তানের আমির ও হাসান ৩টি করে উইকেট নেন। ম্যাচের সেরা পাকিস্তানে ফখর জামান। টুর্নামেন্ট সেরা ও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের পুরস্কার লাভ করেন একই দরের হাসান আলী। এর আগে, টস জিতে প্রথমে ফিল্ডিং করার সিদ্বান্ত নেন ভারতের অধিনায়ক বিরাট কোহলি। বল হাতে শুরুটা ভালোই করেন এবারে আসরে ভারতের সেরা বোলার পেসার ভুবেনশ্বর কুমার। প্রথম ওভারেই মেডেন নেন তিনি। ভুবির বোলিং-এ উজ্জীবিত হয়ে উঠেন অন্য প্রান্তে আক্রমনে আসা পেসার জসপ্রিত বুমরাহ। তাই নিজের দ্বিতীয় ওভারের প্রথম বলেই পাকিস্তানের ওপেনার ফকর জামানকে তুলে নেন বুমরাহ। কিন্তু থার্ড আম্পায়ারের সহায়তা নিয়ে বুমরাহ’র ডেলিভারিটি ‘নো’ ডাকেন অনফিল্ড আম্পায়ার। তাই ব্যক্তিগত ৩ রানেই নিশ্চিতভাবে জীবন পেয়ে যান জামান।

জীবন পেয়ে আরেক ওপেনার আজহার আলীকে নিয়ে ভারতীয় বোলারদের উপর চড়ে বসেন জামান। মারমুখী মেজাজ থেকে নিজেকে বিরত রেখে কিছুটা সর্তক ছিলেন জামান। তবে রানের চাকা দ্রুত গতিতে ছুটিয়েছেন আজহার। তাই ১৮তম ওভার শেষে ১০০ রানে পৌঁছে যায় পাকিস্তান। এ সময় আজহার ৪৬ ও জামান ৪১ রানে অপরাজিত ছিলেন। এরপর দলীয় ১২৮ রানে ভেঙ্গে যায় এই জুটি। রান আউটের ফাঁেদ পড়ে আউট হন আজহার। ৬টি চার ও ১টি ছক্কায় ৭১ বলে ৫৯ রান করে বিদায় নেন আজহার। আউট হবার আগে জামানকে নিয়ে আইসিসির ইভেন্টে ভারতের বিপক্ষে উদ্বোধনী জুটিতে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন আজহার। এই জুটি হতো না, ঐ নো-বলের পরও রান আউটের অনেক সুযোগ মিস করেছে ভারতের ফিল্ডাররা। সেই সুযোগটি ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন পাকিস্তানের দুই ওপেনার।

দ্বিতীয় উইকেটে বড় জুটি পেয়েছে পাকিস্তান। জামানের সাথে ৬১ বলে ৭২ রানের জুটি গড়েন বাবর আজম। এরমাঝে ওয়ানডে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরির স্বাদ পান এবারের আসরের গ্রুপ পর্বে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে অভিষেক হওয়া জামান। ভারতের মিডিয়াম পেসার হার্ডিক পান্ডের বলে আউট হবার আগে ১২টি চার ও ৩টি ছক্কায় ১০৬ বলে ১১৪ রান করেন জামান।
জামানকে ফিরিয়ে দেয়ার পর পাকিস্তানের রানের লাগাম টেনে আনার পরিকল্পনা করে ভারতের বোলাররা। তাতে সাফল্য পাবার পথ দেখান ভুবেনশ্বর। চার নম্বরে নামা শোয়েব মালিককে ১২ রানের বেশি করতে দেননি ভুবি। ১৬ বলে ১২ রান করেন মালিক। ৪০তম ওভারের চতুর্থ বলে দলীয় ২৪৭ রানে চতুর্থ উইকেট হারায় পাকিস্তান। এ অবস্থায় রানের চূড়ায় উঠার স্বপ্ন দেখছিলো পাকিস্তান।

পাকিস্তানের সেই স্বপ্নে ধাক্কা দেন বাংলাদেশের বিপক্ষে ম্যাচে আক্রমনে এনে ইনিংসের চিত্র পাল্টে দেয়া ভারতের অকেশনাল অফ-স্পিনার কেদার যাদব। ৫২ বলে ৪৬ রান করা বাবরকে শিকার করেন তিনি। এতে ৩শ’র মধ্যে পাকিস্তানকে আটকে রাখার অসম্ভব চিন্তা করে ভারত। কিন্তু সেটি হতে দেননি মোহাম্মদ হাফিজ ও ইমাদ ওয়াসিম। পঞ্চম উইকেটে ৪৫ বলে অবিচ্ছিন্ন ৭১ রান যোগ করেন হাফিজ-ওয়াসিম। ফলে ৪ উইকেটে ৩৩৮ রানের বড় সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ৩২তম হাফ-সেঞ্চুরি তুলে ৫৭ রানে অপরাজিত থাকেন হাফিজ। তার ৩৭ বলের ইনিংসে ৪টি চার ও ৩টি ছক্কা ছিলো। অন্যপ্রান্তে ১টি করে চার ও ছক্কায় ২১ বলে অপরাজিত ২৫ রান করেন ওয়াসিম। ভারতের ভুবেনশ্বর, পান্ডে ও কেদার ১টি করে উইকেট নেন।

স্কোর কার্ড :
পাকিস্তান ইনিংস :
আজহার আলী রান আউট (বুমরাহ/ধোনি) ৫৯
ফখর জামান ক জাদেজা ব পান্ডিয়া ১১৪
বাবর আজম ক যুবরাজ ব জাদব ৪৬
শোয়েব মালিক ক যাদব ব কুমার ১২
মোহাম্মদ হাফিজ অপরাজিত ৫৭
ইমাদ ওয়াসিম অপরাজিত ২৫
অতিরিক্ত (লেবা-৯, ও-১৩, নেব-৩) ২৫
মোট (৪ উইকেট; ৫০ ওভার) ৩৩৮
উইকেট পতন : ১-১২৮, ২-২০০, ৩-২৪৭, ৪-২৭৬।
বোলিং : বি কুমার ১০-২-৪৪-১(ও-১), জে বুমরাহ ০-০-৬৮-০(নেব-৩, ও-৫), আর অশ্বিন ১০-০-৭০-০(ও-৪), এইচ পান্ডে ১০-০-৫৩-১(ও-১), আর জাদেজা ৮-০-৬৭-০, কে যাদব ৩-০-২৭-১(ও-২)।
ভারত ইনিংস :
আর শর্মা এলবিডব্লু ব আমির ০
এস ধাওয়ান ক সরফরাজ ব আমির ২১
বি কোহলি ক সাদাব খান ব আমির ৫
যুবরাজ সিং এলবিড¦লু ব সাদাব খান ২২
এম ধোনি ক ইমাদ ব হাসান আলী ৪
কে যাদব ক সরফরাজ ব সাদাব খান ৯
এইচ পান্ডিয়া রান আউট (আমির/ হাসান আলী) ৭৬
আর জাদেজা ক বাবর আজম ব জুনাইদ খান ১৫
আর অশ্বিন সরফরাজ ব হাসান আলী ১
ভুবনেশ্বর অপরাজিত ১
বুমরাহ ক সরফরাজ ব হাসান আলী ১
অতিরিক্ত:( লেবা-২, ও-১) ৩
মোট : (অল আউট, ৩০.৩ ওভার) ১৫৮
উইকেট পতন : ১-০, ২-৬, ৩-৩৩, ৪-৫৪, ৫-৫৪,৬-৭২,৭-১৫২, ৮-১৫৬, ৯-১৫৬,১০ -১৫৮।
বোলিং :
মোহাম্মদ আমির ৬-২-১৬-৩, জুনাইদ খান ৬-১-২০-১(ও-১), মোহাম্মদ হাফিজ ১-০-১৩-০, হাসান আলী ৬.৩-১- ১৯-৩, সাদাব খান ৭-০-৬০-২, ইমাদ ওয়াসিম ০.৩-০-৩-০, ফখর জামান ৩.৩-০-২৫-০।
ফল : পাকিস্তান ১৮০ রানে জয়ী
ম্যাচ সেরা: ফখর জামান(পাকিস্তান)।
সর্বোচ্চ রান : শিখর ধাওয়ান (ইন্ডিয়া)
সর্বোচ্চ উইকেট শিকার : হাসান আলী (পাকিস্তান)।
টুর্নামেন্ট সেরা : হাসান আলী (পাকিস্তান)।