কয়েক ঘণ্টার টানা বর্ষণ নিমেষেই পাল্টে দিল রাঙামাটির চিত্র। পাহাড়ধস ও পাহাড়ি ঢলে জেলার কাপ্তাই, কাউখালী, বিলাইছড়ি, জুরাছড়িসহ বিভিন্ন স্থানে এ পর্যন্ত ১১০ জন নিহত হয়েছেন। এ ঘটনায় থমকে গেছে পুরো জেলার জনজীবন। আতঙ্ক যেন কাটছেই না মানুষের।
ভয়াবহ এই দুর্যোগের সঙ্গে যোগ হয়েছে বিদ্যুৎ ও বিশুদ্ধ পানির সংকট। জেলা শহরের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী জেলাগুলোর যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। শহরে প্রবেশের প্রধান সড়কের অন্তত ১০টি স্থানে সড়ক কিংবা সেতু ধসে পড়ে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন জনপদে পরিণত হয়েছে রাঙামাটি। প্রাকৃতিক এই দুর্যোগে শহরের ১০টি স্থানে এবং কাপ্তাই, কাউখালী ও বরকলে খোলা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র। এসব আশ্রয়কেন্দ্রে বৃহস্পতিবার বিকেল পর্যন্ত আশ্রয় নিয়েছে প্রায় দুই হাজার মানুষ। স্থানীয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে দুর্যোগকবলিত এসব মানুষের জন্য খাবার ও পানির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
পাহাড়ধসে বিপর্যস্ত রাঙামাটিতে এখনো চলছে উদ্ধার অভিযান। উদ্ধার অভিযান চলাকালে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত এক শিশুসহ দুজনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের রাঙামাটি ইউনিটকে সহযোগিতা করতে চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা থেকে যোগ দিয়েছে প্রতিষ্ঠানটির ৬০ জনের একটি প্রশিক্ষিত দল। তাঁরা বুধবার থেকে রাঙামাটিতে উদ্ধার অভিযানে অংশ নিয়েছেন।
তবে বিভিন্ন স্থানে মাটিচাপা পড়ে প্রায় ১০ থেকে ২০ ফুট উঁচু ঢিবি তৈরি হওয়ায় সেসব জায়গায় উদ্ধার তৎপরতা চালানো অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। উদ্ধারকাজে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীদের সহযোগিতা করছেন সেনাবাহিনীর সদস্যরা। এ অভিযানে কর্মকর্তাসহ পাঁচ সহকর্মীকে হারানোর বেদনাকে লুকিয়ে উদ্ধার অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তাঁরা।
রাঙামাটি ফায়ার সার্ভিসের উপপরিচালক গোলাম মোস্তফা বলেন, ‘এটা আমাদের জন্য নতুন অভিজ্ঞতা। এত বড় দুর্যোগ মোকাবিলা করার মতো অবকাঠামো ও জনবল আমাদের নেই। আবার তাৎক্ষণিকভাবে আশপাশের ইউনিট থেকেও পর্যাপ্ত সহযোগিতা পাওয়া সহজ ছিল না। সেই সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিবন্ধকতা বড় সমস্যা তৈরি করেছে। তবুও যতক্ষণ পর্যন্ত একটি মানুষও চাপা থাকার অভিযোগ থাকবে, আমাদের উদ্ধার তৎপরতা চলবে।’
ভয়াবহ এই প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় থেকে রাঙামাটি শহরের ১০টি আশ্রয়কেন্দ্রে প্রায় দুই হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। জেলা প্রশাসন এসব মানুষের জন্য খাবার ও বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করছে। জেলা প্রশাসনের পাশাপাশি বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন, রাজনৈতিক নেতারাও বাড়িয়ে দিয়েছেন সহযোগিতার হাত।
বৃহস্পতিবার সকাল থেকেই শহরের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র ঘুরে দেখা যায়, এগুলোতে বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে ত্রাণ সহায়তা দেওয়া হচ্ছে। তবে আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা মানুষের অনেকেই পর্যাপ্ত সহযোগিতা না পাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক (ডিসি) মোহাম্মদ মানজারুল মান্নান বলেন, ‘আমরা ইতোমধ্যেই প্রায় ৩৫ লাখ টাকা, ৫০০ বান্ডিল ঢেউটিন, ২০০ টন চাল পেয়েছি। এসব চাল তো সরাসরি তাদের দিয়ে লাভ নেই, কারণ তাদের রান্না করে খাওয়ার মতো অবস্থা নেই। তাই আমাদের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট, স্থানীয় কমিশনারদের নেতৃত্বে প্রতিটি আশ্রয়কেন্দ্রে খাবারের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’
ডিসি বলেন, ঢেউটিনসহ বাড়িঘর মেরামতের জন্য সহযোগিতা দেওয়া হবে। ত্রাণ সহযোগিতা বা খাবার পাচ্ছেন না, এমন কোনো অভিযোগ থাকলে সরাসরি জানানোর পরামর্শ দেন তিনি। সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য সর্বোচ্চ সহযোগিতা করছে এবং করবে। গতকাল বিকেল থেকে আবার রাঙামাটিতে প্রায় চার ঘণ্টা টানা বৃষ্টি হয়েছে। একদিন বন্ধ থাকার পর আবার বৃষ্টি শুরু হওয়ায় আতঙ্কিত হয়ে পড়ে বিপন্ন মানুষ। বৃহস্পতিবার বিকেলে শহরের রূপনগর এলাকা থেকে প্রায় ২৫০ জন মানুষ রাঙামাটি সরকারি কলেজকেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
রাঙামাটি পৌরসভার মেয়র আকবর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘এটা রাঙামাটির মানুষের জন্য নতুন এক অভিজ্ঞতা। এমন ভয়ংকর দুর্যোগ আর ভয়ানক পরিণতি মোকাবিলার অভিজ্ঞতা একেবারেই নতুন আমাদের। তবুও সবাই ভেদাভেদ ভুলে যেভাবে এগিয়ে এসেছে, তাতে দুর্যোগ মোকাবিলা করা কিছুটি সহজ হয়েছে। আমরা দেশের মানুষের কাছে দোয়া ও সহযোগিতা চাই।’