অধস্তন আদালতে প্রেষণে থাকা ১৭ জন বিচারকের বিদেশ যাওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট।সুপ্রিমকোর্টের ওয়েবসাইটে উল্লেখিত তথ্য অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্ট এ সংক্রান্ত এক আদেশ জারি করে। এই সংক্রান্ত আইন মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রের পাল্টায় সোমবার আরেকটি পরিপত্রে সুপ্রিম কোর্ট ওই ১৭ জনকে বিদেশ না পাঠানোর আগের নির্দেশনাই বহাল রেখেছে।

সার্কুলারে বলা হয়েছে, সুপ্রিমকোর্টের সঙ্গে পরামর্শ না করে ওই ১৭ বিচারককে বিদেশে যাওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। এ নিষেধাজ্ঞা লঙ্ঘন করা হলে সংশ্লি¬ষ্ট বিচারকেরা বিভাগীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে অভিযুক্ত হবেন বলেও বলা হয়।হাইকোর্ট বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার (বিচার) মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন চৌধুরীর সই করা ওই সার্কুলারের অনুলিপি ১৭ জন বিচারকের বরাবর পাঠানো হয়েছে। রাষ্ট্রপতির অনুশাসন উল্লেখ করে প্রেষণ প্রশাসনে দায়িত্ব পালনরত বিচার বিভাগের ১৭ কর্মকর্তাকে আইন মন্ত্রণালয় বিদেশ পাঠাতে চাইলেও সুপ্রিম কোর্ট অনুমতি না দেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল রয়েছে।এই ১৭ জন জুডিসিয়াল সার্ভিসের সদস্য, তারা প্রেষণে সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে দায়িত্ব পালন করছেন। তাদেরকে প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে পাঠানোর জন্য গত ৩ থেকে ১৭ মে সরকারি অফিস আদেশ জারি করে আইন মন্ত্রণালয়। আগামী ২৮ মে থেকে প্রশিক্ষণের জন্য তাদের যাওয়ার কথা ছিল।সুপ্রিম কোর্টের সহকারী রেজিস্ট্রার (বিচার) মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন চৌধুরী স্বাক্ষরিত পরিপত্রে ১৭ বিচারকের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের সাথে পরামর্শ না করে আইন মন্ত্রণালয় থেকে বিদেশ গমনের আদেশ জারি করায় আপনাদেরকে উক্ত বিদেশ গমন না করার জন্য অত্র কোর্ট নির্দেশনা প্রদান করছে।সুপ্রিম কোর্টের সর্বশেষ এই পরিপত্রের বিষয়ে আইনমন্ত্রী ও সচিব কেউ মন্তব্য করতে রাজি হননি।আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, আমি এ বিষয়ে কোনো কথা বলব না।একই কথা বলেছেন সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হকও।

অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন বলেন, ১৭ জনের নামে ও তাদের সংস্থা প্রধানকে আমরা চিঠি দিয়েছি।আমরা বলেছি, বিদেশ যাওয়ার ব্যাপারে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি নেই, তাই তাদেরকে বিদেশ যাওয়া থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে।এই ১৭ জন হলেন- আইন কমিশনের সচিব মো. আলী আকবর, মুখ্য গবেষণা কর্মকর্তা ফউজুল আজিম ও অনুবাদ কর্মকর্তা ফাতেমা জাহান স্বর্ণা, আইন মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বিকাশ কুমার সাহা, যুগ্ম সচিব এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়া, উপ-সচিব শেখ হুমায়ূন কবির, উপ-সচিব মো. বদিউজ্জামান, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. রেজাউল করিম, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. নুরুল আলম সিদ্দীক, জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব কাজী মুশফিক মাহবুব রবিন ও উপ-সলিসিটর মোহাম্মদ মোরশেদ ইমতিয়াজ।এছাড়া দুর্নীতি দমন কমিশনের পরিচালক আবুল হাসনাত মো. আবদুল ওয়াদুদ, বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউশনের পরিচালক মো. হাসানুল ইসলাম ও উপ-পরিচালক এফএম আহসানুল হক।অন্যরা হলেন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের ডেপুটি রেজিস্ট্রার কেশব রায় চৌধুরী, প্রশাসনিক আপিল ট্রাইব্যুনালের রেজিস্ট্রার ইয়াসমিন বেগম এবং জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান কেন্দ্রের সহকারী পরিচালক মো. আক্তারুজ্জামান।তাদের বিদেশ যাওয়া নিয়ে আগে থেকে সুপ্রিম কোর্ট ও আইন মন্ত্রণালয়ের টানাপড়েন চলছিল।

গত ৯ মে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ সংক্রান্ত’ একটি পরিপত্র জারি করে সুপ্রিম কোর্ট।এতে বলা হয়েছিল, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তার বাস্তবায়ন হয়।ফলে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান, বিদেশ গমন ও চাকরির অন্যান্য শর্তসহ সকল বিষয় সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করা অনস্বীকার্য।আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অফিসে প্রেষণ বা অন্যভাবে নিয়োগ পাওয়া বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিদেশ না পাঠানোর নির্দেশনা দেওয়া হয় ওই পরিপত্রে।তাতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিচারিক পদে কর্মরত, প্রেষণ বা অন্যভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা কেউ বিদেশে গেলে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।সুপ্রিম কোর্টের ওই পরিপত্রের পাল্টায় গত ১৬ মে আইন মন্ত্রণালয় আরেকটি পরিপত্র জারি করে।রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে গতবছর ১১ এপ্রিল মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা একটি পত্রের বরাতে তাতে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্র“য়ারি সুপ্রিম কোর্টের একটি স্মারকপত্রের পরিপ্রেক্ষিতে অধঃস্তন আদালতের বিচারকরা প্রেষণে কর্মরত থাকাকালে বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা নেই। ওই পত্রের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টকেও পাঠানো হয়েছিল।ওই পরিপত্র জারির পর প্রেষণে বা অন্যভাবে নিযুক্ত বিচার বিভাগীয় অনেক কর্মকর্তা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই সরকারি আদেশে বিদেশে গেছেন এবং কেউ কেউ এখনও বিদেশে অবস্থান করছেন বলে মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য।

আইন মন্ত্রণালয়ের ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সুপ্রিম কোর্টের সোমবারের পরিপত্রে বলা হয়েছে, সুপ্রিম কোর্টের জারি করা সার্কুলারটি (৯ মে) সংবিধানের ১০৭ অনুচ্ছেদ বলে প্রণীত বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের রুলস- ১৯৭৩ এর অধীন, তা কোনো প্রশাসনিক আদেশ/পত্রের দ্বারা অকার্যকর হয় না।ফলে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগ থেকে জারি করা সার্কুলারটি (৯ মে) বর্তমানে কার্যকর রয়েছে এবং উক্ত সার্কুলার অনুসরণ করা বাংলাদেশ জুডিসিয়াল সার্ভিসের সকল সদস্যগণের (প্রেষণে বা অন্যবিধভাবে কর্মরত সদস্যগণসহ) জন্য বাধ্যতামূলক।সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি ছাড়া বিদেশ গেলে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে এই পরিপত্রেও সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।নিম্ন আদালতের ৫৪০ জন বিচারককে প্রশিক্ষণ দিতে গত ২৮ র্মাচ ঢাকায় আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি ইউনিভার্সিটির সমঝোতা স্মারক সই হয়।আদালত ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক দুই বছর মেয়াদী এই প্রকল্পের আওতায় অধস্তন আদালতের ৫৪০ জন বিচারককে প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশ পাঠানোর পরিকল্পনা নেয় আইন মন্ত্রণালয়।