বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) বি এ এইচ আদনান হারুনকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা। মঙ্গলবার বেলা ১১টার পর তিনি অধিদপ্তরের কার্যালয়ে আসেন। সেখানে বেলা দুইটা পর্যন্ত তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদ চলে। রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষকে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে শুল্ক আইন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ও মানি লন্ডারিং আইনে অভিযোগের অনুসন্ধান ও তদন্তের শুনানিতে অংশ নিতে বলা হয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আদনান হারুন এসেছিলেন। এ সময় তাঁর সঙ্গে তাঁর চাচা ও মামা ছিলেন।জিজ্ঞাসাবাদ শেষে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আদনান সাংবাদিকদের বলেন, তিনি শুল্ক গোয়েন্দাদের সব প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। তিনি মনে করেন তাঁর কাছ থেকে পাওয়া জবাবে তাঁরা সন্তুষ্ট।তবে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান সাংবাদিকদের বলেন, গত তিন মাসে আদনান ৮ লাখ ২৭ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন। জমা দিয়েছেন মাত্র ১০ হাজার টাকা।

গত ২৮ মার্চ বনানীর রেইনট্রি হোটেলে দুই ছাত্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছেÑএই অভিযোগে ১৪ মে শুল্ক গোয়েন্দারা ওই হোটেলে অভিযান চালান। অভিযানে রেইনট্রি হোটেলের ১০১ নম্বর কক্ষে ১০ বোতল মদ পাওয়া যায়। প্রথমে হোটেল কর্তৃপক্ষ আটক মাদককে জুস হিসেবে বর্ণনা করে। এরপর সংবাদ সম্মেলন করে হোটেল থেকে মদ উদ্ধার হয়নি বলে দাবি করে। এসব নিয়ে শুনানির জন্য শুল্ক গোয়েন্দারা হোটেল রেইনট্রি কর্তৃপক্ষকে ১৭ মে তলব করেন। তখন অসুস্থতার কথা বলে সময় প্রার্থনা করে রেইনট্রির মালিকপক্ষ। হোটেল মালিককে ছয় দিনের সময় দিয়ে ২৩ মে সশরীর হাজির হতে পুনরায় নোটিশ দেওয়া হয়। রেইনট্রি কর্তৃপক্ষ এই নোটিশকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট আবেদন করে। ওই আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সোমবার দুপুরে হাইকোর্ট নোটিশের কার্যকারিতা স্থগিতাদেশ দেন। এর পরপরই রাষ্ট্রপক্ষ ওই স্থগিতাদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। সাড়ে তিন ঘণ্টার ব্যবধানে গতকাল বিকেলেই শুনানি শেষে হাইকোর্টের স্থগিতাদেশটি স্থগিত করেন আপিল বিভাগ। এর ফলে আজ রেইনট্রি হোটেল কর্তৃপক্ষকে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে উপস্থিত হতে বলা হয়। তলবে হাজিরা এড়াতে আদালতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর নির্ধারিত সময়ে শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের কার্যালয়ে উপস্থিত হয়েছেন বনানীর রেইনট্রি হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এইচ এম আদনান।ঝালকাঠির সরকারদলীয় সাংসদ বজলুল হক হারুনের ছেলে আদনান মঙ্গলবার বেলা সোয়া ১১টার দিকে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে যান। ফুপা আকবর হোসেন মঞ্জু ও চাচা মুজিবুল হক কামাল এ সময় তার সঙ্গে ছিলেন।

লাইসেন্স না থাকার পরও রেইনট্রি হোটেলে মদ রাখা এবং ভ্যাট ও শুল্ক ফাঁকির অভিযোগের বিষয়ে সেখানে ব্যাখ্যা দিতে হবে আদনানকে।বনানীর চার তারকা ওই হোটেলে গত ২৮ মার্চ জন্মদিনের দাওয়াতে ডেকে নিয়ে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগে গত ৬ মে থানায় একটি মামলা হয়। আপন জুয়েলার্সের অন্যতম মালিক দিলদারের ছেলে সাফাত আহমেদ ও তার দুই বন্ধুসহ ছয়জনকে সেখানে আসামি করা হয়।দিলদার ও তার ভাইদের বিরুদ্ধে সোনা চোরাচালানের অভিযোগ থাকায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের নির্দেশে একটি অনুসন্ধান কমিটি করে তদন্ত শুরু করে শুল্ক গোয়েন্দা অধিদপ্তর।এর অংশ হিসেবে গত ১৪ ও ১৫ মে ঢাকায় আপন জুয়েলার্সের পাঁচটি শাখায় অভিযান চালিয়ে বাদে সাড়ে ১৩ মণ স্বর্ণালঙ্কার ও ৪২৭ গ্রাম হীরার গয়না ‘আটক’ করা হয়, যার মোট দাম ১৭৯ কোটি টাকা।ওই সময়ই বনানীর হোটেল রেইনট্রিতে অভিযান চালান শুল্ক গোয়েন্দারা। চার তারকা ওই হোটেলের বিভিন্ন কক্ষ তল্লাশি করে ১০ বোতল বিদেশি মদ ও নথিপত্র জব্দ করা হয়।শুল্ক গোয়েন্দারা জানান, হোটেল কর্তৃপক্ষ বারের লাইসেন্স দেখাতে না পারলেও সেখানে মদ রাখা হয়েছিল।গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ভ্যাট নিবন্ধন নিলেও কোনো অর্থ পরিশোধ না করে ওই হোটেল কর্তৃপক্ষ আট লাখ ১৫ হাজার টাকা ভ্যাট ফাঁকি দিয়েছে বলেও শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের অভিযোগ।এরপর গত ১৪ মে ‘ব্যাখ্যাহীনভাবে’ সোনা ও হীরার গয়না মজুদের অভিযোগে আপন জুয়েলার্স এবং অবৈধভাবে মদ রাখার অভিযোগে বনানীর রেইনট্রি হোটেলের মালিকদের তলব করা হয়। সে অনুযায়ী আপন জুয়েলার্সের তিন মালিক দিলদার ও তার দুই ভাই গুলজার আহমেদ ও আজাদ আহমেদ গত ১৭ মে শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে হাজির হলে তাদের পাঁচ ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। কিন্তু তারা আটক গয়নার কোনো বৈধ কাগজপত্র দেখাতে না পারায় ২৩ মে আবার হাজির হতে বলা হয়।অন্যদিকে রেইনট্রির এমডি আদনান সেদিন অসুস্থতার কথা বলে নিজে না গিয়ে আইনজীবীর মাধ্যমে সময়ের আবেদন পাঠান।

শুল্ক গোয়েন্দা বিভাগের মহাপরিচালক মইনুল খান সেদিন বলেন, রেইনট্রির ব্যবস্থাপনা পরিচালক অসুস্থতার কথা বলে এখানে আসেননি। কিন্তু তার অসুস্থতার কোনো কাগজপত্রও আইনজীবীরা দেখাতে পারেননি। আগামী ২৩ মে বেলা ১১টায় তাদের আসতে বলা হয়েছে। সেদিন না এলে শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তর একতরফাভাবেই শুনানির নিষ্পত্তি করবে।তলবের ওই নোটিস আটকাতে গত রোববার হাই কোর্টে আবেদন করেন এমপিপুত্র আদনান। তার আবেদন শুনে হাই কোর্ট সোমবার শুল্ক গোয়েন্দা দপ্তরের নোটিসের কার্যকারিতা এক মাসের জন্য স্থগিত করলেও কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চেম্বার আদালতে ওই আদেশ আটকে যায়। চেম্বার আদালতের বিচারপতি মির্জা হোসেন হায়দার হাই কোর্টের ওই আদেশ ছয় সপ্তাহের জন্য স্থগিত করে দিলে আদনানের হাজির এড়ানোর পথ বন্ধ হয়ে যায়।আদনান হারুন মঙ্গলবার শুল্ক গোয়েন্দা কার্যালয়ে আসার পর তার অসুস্থতার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগের চেয়ে বেটার।বনানীতে আবাসিক এলাকায় কে ব্লকের ২৭ নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়িতে রেইনট্রি হোটেলের মালিক আল-হুমায়রা ড়্রুপ। ঝালকাঠি-১ আসনে আওয়ামী লীগের সাংসদ বজলুল হক হারুন ওই গ্র“পের চেয়ারম্যান। তার মেয়ে হুমায়রার নামে ওই গ্রুপের নাম। তার চার ছেলেমেয়েই পরিচালনা পর্ষদে আছেন। সাংসদ হারুনের ছেলেদের মধ্যে এইচ এম আদনান হারুন আছেন ওই হোটেলের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্বে। তবে দেখাশোনা করেন মূলত তার ভাই মাহির হারুন।মাহিরের বন্ধু পরিচয় দিয়েই সাফাত ধর্ষণের ঘটনার দিন ওই হোটেলে উঠেছিলেন বলে হোটেলকর্মীরা পুলিশকে জানিয়েছেন।মামলার আসামিদের মধ্যে সাফাত, তার বন্ধু সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল হোসেন ও দেহরক্ষী রহমত আলী ইতোমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। মামলার আরেক আসামি নাঈম আশরাফকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।