চলতি বছরের প্রথম চার মাসে নৌ-দুর্ঘটনায় মারা গেছেন ৮৯ জন। এ ধারা অব্যাহত থাকলে এ বছর নৌ-দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বেসরকারি সংগঠন নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি।শুক্রবার রাজধানীর পুরানো পল্টনের কমরেড মণি সিংহ সড়কের মুক্তি ভবনে চলমান দুর্যোগ মৌসুম ও বিদ্যমান নৌ-পরিবহন ব্যবস্থা’ শীর্ষক এক আলোচনা সভায় জাতীয় কমিটি এ তথ্য জানায়। নৌ, সড়ক ও রেলপথ রক্ষা জাতীয় কমিটি এ আলোচনা সভার আয়োজন করে।কমিটির পক্ষে সাধারণ সম্পাদক আশীষ কুমার দে বলেন, চলতি বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের প্রথম চার মাসে দেশের বিভিন্ন নৌপথে দুর্ঘটনায় মোট ৮৯ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই ধারা বজায় থাকলে এ বছর নৌ-দুর্ঘটনায় মৃতের সংখ্যা আগের বছরগুলোকে ছাড়িয়ে যাবে। ২০১৫ সালে নৌ-দুর্ঘটনায় দেশের বিভিন্ন নৌপথে ৩৫৯ জন এবং ২০১৬ সালে ২৭৯ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছিল।
যাত্রীভোগান্তি লাঘব ও আসন্ন ঈদুল ফিতরে নিরাপদ নৌ চলাচলের স্বার্থে ১০টি জরুরি সুপারিশ তুলে ধরে তিনি বলেন, ত্র“টিপূর্ণ, সার্ভেবিহীন ও অনিবন্ধিত লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বিআইডব্লিউটিএকে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করতে হবে। চলমান দুর্যোগ মৌসুমকে বিবেচনায় নিয়ে ও পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে অবৈধ নৌযান চলাচল বন্ধে পহেলা রমযান থেকে গুরুত্বপূর্ণ নৌপথে ভ্রাম্যমাণ আদালতের কার্যক্রম শুরু করতে হবে। আইন লঙ্ঘনকারী নৌযান, মালিক, মাস্টার ও ড্রাইভারের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। দুর্যোগ মৌসুমে টেলিভিশন ও বেতারে এবং লাউড স্পিকারে সব টার্মিনালে প্রতি ঘণ্টায় আবহাওয়া বার্তা প্রচার করতে হবে। সব নৌযানকে আবহাওয়া বার্তা মেনে চলাচল করতে বাধ্য করতে হবে। জননিরাপত্তা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠনের স্বার্থে বিভিন্ন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার দায়িত্ব দিতে হবে।
আশীষ কুমার দে বলেন, ঈদে ত্র“টিপূর্ণ ও লক্কড়-ঝক্কড় লঞ্চ চলাচল বন্ধে ইতিমধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ লঞ্চগুলোকে ঈদ-পূর্ববর্তী ১৫ দিনের মধ্যে বার্ষিক সার্ভে সনদ দেওয়া যাবে না। তিনি আরও বলেন, কোস্ট গার্ড ও নৌ পুলিশের পাশাপাশি উপকূলীয় জেলাগুলোর পুলিশ প্রশাসনকে নৌ নিরাপত্তার কাজে সম্পৃক্তকরণ করতে হবে। ঈদের ১৫ দিন আগে সব টার্মিনাল ও গুরুত্বপূর্ণ লঞ্চঘাটে ক্লোজ সার্কিট টিভি স্থাপনসহ পর্যাপ্ত নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ করতে হবে। যাত্রীদের সুবিধার্থে সব টার্মিনালের শৌচাগারগুলোতে পর্যাপ্ত পানিসহ সেগুলো পরিচ্ছন্ন রাখা এবং ইফতারির জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করতে হবে।দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় নৌ-দুর্ঘটনা এড়াতে সরকারকে সতর্কতা অবলম্বন ও কঠোর হওয়ার পরামর্শ দিয়ে এ সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন জাতীয় কমিটির প্রধান উপদেষ্টা ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ মনজুরুল আহসান খান, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নৌযান ও নৌযন্ত্র কৌশল বিভাগের অধ্যাপক ড. মীর তারেক আলী, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীর, জাতীয় কমিটির যুগ্ম সম্পাদক সঞ্জিব বিশ্বাস, প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক জসি সিকদার, সিটিজেন্স রাইট্স মুভমেন্টের মহাসচিব তুসার রেহমান, যাত্রী অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সেকেন্দার হায়াৎ প্রমুখ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন রাজনীতিক ও সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞসহ বিশিষ্টজনেরাও।দুর্ঘটনা এড়াতে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান চলাচলের ক্ষেত্রে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর ও বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন কর্তৃপক্ষসহ (বিআইডব্লিউটিএ) সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে মনজুরুল আহসান খান বলেন, এ দেশে শ্রমিকের বেতন বাড়ে না অথচ দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বেতন ডাবল হয়। দেশের নৌ ও সড়ক পরিবহনসহ শিল্প সেক্টরে শক্তিশালী মাফিয়া চক্র গড়ে উঠেছে। তারা সরকারের অর্থমন্ত্রীকেও ধমক দিতে ভয় পায় না। এই মাফিয়া চক্রের হাতে সরকার এবং জনগণ জিম্মি হয়ে পড়েছে। মাফিয়া চক্রের দাপটে দিশেহারা দেশের সাধারণ মানুষ। এ দুরবস্থা মোকাবিলায় জনমতের চাপ সৃষ্টি করে শক্তিশালী প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে।জনভোগান্তি লাঘবে সারা দেশের লঞ্চ টার্মিনাল ও ঘাটগুলোতে যাত্রীসুবিধা বাড়ানো এবং গুরুত্বপূর্ণ নৌপথগুলোতে নিরাপত্তা জোরদারের ওপর গুরুত্বারোপ করে তিনি বলেন, এ জন্য নৌ পুলিশ ও কোস্ট গার্ডের পাশাপাশি উপকূলীয় জেলাগুলোর পুলিশ প্রশাসনকে সম্পৃক্ত করতে হবে।গার্মেন্টস শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুরবস্থার প্রসঙ্গ টেনে তিনি আরও বলেন, পোশাকশিল্প কারখানার শ্রমিকদের দুরবস্থা মোকাবিলা করা না গেলে লাখ লাখ শ্রমিক রাস্তায় নেমে এসে র্যাব-পুলিশের গাড়ি উল্টে দেবে।মনজুরুল আহসান খান বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়নের কুপ্রভাবে গ্রীষ্মকালেই শুরু হয়েছে প্রবল বর্ষণ। সেই সঙ্গে প্রায় প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো স্থানে প্রলয়ংকরী ঝড় হচ্ছে, অনেক এলাকায় বন্যাও দেখা দিয়েছে। এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন ব্যবস্থা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে; আসন্ন ঈদে এই ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যাবে।