হাওরে সব ফসল হারিয়ে সর্বশান্ত কৃষকÑ সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, ময়মনসিংহ ,জামালপুর সিরাজগঞ্জ,মৌলভীবাজার, কিশোরগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলার হাওর অঞ্চলের কৃষকের পরিবারে এখন শুধুই হাহাকার। অনেক এলাকায় ত্রাণ সহায়তা পৌঁছায়নি বলেও অভিযোগ রয়েছে। সুনামগঞ্জের সব কটি হাওর তলিয়ে গেছে। পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে বোরো ফসল। ভেঙেছে লাখো কৃষকের স্বপ্ন। ফসলহানিতে হাওরপারের মানুষ এখন দিশেহারা। হাওরে এখন শুধুই হাহাকার। প্রায় ২৩ দিন ধরে স্থানীয়দের অক্লান্ত পরিশ্রমে টিকিয়ে রাখা ফসল রক্ষা বাঁধটি সোমবার ভেঙে যায়। এতে পানিতে তলিয়ে যায় সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জের সর্বশেষ পাকনার হাওরের প্রায় ২২ হাজার একর জমির ধান।
সর্বশেষ সুরক্ষিত হাওরটিও তলিয়ে যাওয়ায় সর্বশান্ত আশপাশের প্রায় ৪০ গ্রামের কৃষক। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ও ঠিকাদাররা সময়মতো কাজ শেষ না করায় ফসল রক্ষা হয়নি তাদের।এছাড়াও পানিতে ফসল তলিয়ে যাওয়ায় এবং মাছ মরে যাওয়ায় মৌলভীবাজারের অন্তত ৩৫ হাজার কৃষক ও জেলে পরিবারে এখন শুধুই হাহাকার। অনেক এলাকায় এখনো ত্রাণ সামগ্রী পৌঁছায় নি বলে অভিযোগ ক্ষতিগ্রস্তদের। হাওরাঞ্চলকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকা হিসেবে ঘোষণার দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।হাওরবাসির জন্য ত্রাণ তৎপরতা বাড়াতে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক।কিশোরগঞ্জের হাওর অঞ্চলের কমপক্ষে ১৫ হাজার হেক্টর জমির সোনালী ধান পানির নিচে। প্রতিদিনই পানি বাড়তে থাকায় অনেক এলাকার আধাপাকা ধান কাটতে বাধ্য হচ্ছেন কৃষক।কৃষি কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এখন পর্যন্ত নিকলী উপজেলার ৭ হাজার ৫২৫ হেক্টর জমির বোরো ধান ও ৮০ হেক্টর জমির বাদাম তলিয়ে গেছে।
সুনামগঞ্জ: আমরা পথের ফকির অই (হয়ে) গেছি। আর মাইত্যা (কথা বলে) কিতা অইত। সব শেষ। অখন এখটাই চিন্তা, বাঁচতাম কিলা…(বাঁচব কেমন করে)।’ হাওর থেকে কেটে আনা ভেজা কাঁচা ধানের গোছা নাড়াচাড়া করতে করতে এমন দীর্ঘশ্বাস ফেলেন সত্তরোর্ধ্ব আবদুল খালিক।এই দীর্ঘশ্বাস, এই কষ্ট এখন শুধু আবদুল খালিকের একার নয়, সুনামগঞ্জের হাওর এলাকার ফসলহারা সব কৃষকের বুকে। শ্রমে-ঘামে ফলানো ফসল হারিয়ে হাওরের কৃষকেরা এখন অসহায়, নিঃস্ব।কৃষক আবদুল খালিকের বাড়ি জেলার তাহিরপুর উপজেলার শনির হাওরের পশ্চিমপাড়ের আনোয়ারপুর গ্রামে। সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের আনোয়ারপুর বাজারের পাশে শনির হাওরপারে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। এই হাওরটি ডুবেছে গত রোববার। তাঁরা হাওরের উঁচু জায়গা থেকে কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। কিন্তু জেলার অন্য হাওরগুলো যখন ডুবে, তখন ধানগাছ ছিল কাঁচা। তাই এই সুযোগও পাননি ওই সব হাওর এলাকার কৃষকেরা।
এসব কাঁচা ধানে কী হবে? এমন প্রশ্নে আবদুল খালিক বললেন, যা পারছি আনছি। ধান না-ই পাইলাম, গরুর তো কিছু খেড় (খড়) অইব। চিন্তা তো খালি আমরার না, গরু পালতাম কিলা।দেখা গেল, সুনামগঞ্জ-তাহিরপুর সড়কের ওপর আরও অনেকে একইভাবে কাঁচা ধান কেটে এনে রেখেছেন। এখনো কাটছেন কেউ কেউ। একই গ্রামের মনরূপা বেগম (৫০) এক ছেলে ও দুই মেয়ের জামাইকে নিয়ে হাওর থেকে কিছু কাঁচা ধান এনে এক জায়গায় জড়ো করছিলেন। বিপদের সময় মেয়ের জামাইরা এসেছেন তাঁদের সাহায্য করতে। মনরূপা বেগমের দিকে তাকাতেই বলে ওঠেন, ‘ইশ্, আর একটা সাপ্তা সময় পাইতাম, তাইলেই অইগিছিল। মানুষ পাকনা ধান কাটত পারত। লোহাছড়া গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা আবদুল জলিলের (৭২) তিন একর জমি ছিল। সামান্য জমি উঁচুতে থাকায় কিছু কাঁচা ধান কাটতে পেরেছেন। মেয়ের রাশেদা বেগমকে নিয়ে সেই ধান হাওর থেকে তুলে এনে সড়কের ওপর স্তূপ করছেন। আবদুল জলিল বলেন, ‘ইবার এলাকায় আকাল দেখা দিব। মানুষ না খাইয়া মরব। আপনার সরকাররে ই কথা জানাইন যেন। বাঁচাইলে সরকারেই বাঁচাইত।শনির হাওরটি এলাকার মানুষের স্বেচ্ছাশ্রমে টিকে ছিল ২৩ দিন। যে কারণে ধান পাকতে শুরু করেছিল। যখন হাওরে পানি ঢুকতে থাকে, তখন হাওরে উঁচু অংশে থাকা সেই আধা পাকা কিছু ধান কাটার চেষ্টা করেছেন কৃষকেরা।
তাহিরপুর সদরের কাছাকাছি মধ্যতাহিরপুর গ্রামের পাশে কথা হয় নারায়ণ বর্মণের (৫৪) সঙ্গে। এলাকার মাটিয়ান হাওরে দুই একর এবং শনির হাওরে এক একর জমি ছিল তাঁর। মাটিয়ান হাওরে জমির ধান এপ্রিলের প্রথম দিকেই তলিয়ে গেছে। ভরসা ছিল শনির হাওর। সেটিও তলিয়ে যায় গত রোববার। নারায়ণ বর্মণ জানান, তাঁর দুই ছেলের মধ্যে একজন এবার এসএসসি দিয়েছে, অন্যজন সপ্তম শ্রেণিতে পড়ে। ঘরে সব মিলিয়ে নয়জন মানুষ। নারায়ণ বলেন,এখন ছেলেদের লেখাপড়ার খরচ কই থেকে পাব। আর খাবইবা কী। সবই ভরসা ছিল এই ধানে।সুনামগঞ্জ থেকে তাহিরপুর যেতে পথে কথা হয় প্রায় ২০ জন নারী-পুরুষের সঙ্গে। তাঁরা জানালেন, সুনামগঞ্জের ধনী-গরিব সব কৃষকের অবস্থা এখন এক। সবাই ফসল হারিয়ে অসহায়। কারও ঘরে খাবার নেই। অনাহারে অর্ধাহারে দিন যাচ্ছে।
ধনী-গরিবের একই অবস্থা, এই কথাটি নিজেই পরিষ্কার করলেন উপজেলার বড়দল দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ। তাঁর তিন মেয়ের মধ্যে দুই মেয়ে সিলেটে থেকে স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে লেখাপড়া করেন। এক মেয়ে এবার স্নাতক পাস করেছেন। তাকেও পড়াশোনার জন্য সিলেটে পাঠানোর চিন্তা ছিল। আবুল কালাম বলেন,‘আমি এলাকার সচ্ছল গৃহস্থ। আমার আর অন্য কোনো পেশা নেই। ১০ একর জমির সব ধান তলিয়ে গেছে। এই ধানেই আমি রাজার হালে চলতাম। এখন কী করব ভেবে পাচ্ছি না। এখন বোঝেন সাধারণ কৃষকেরা কী অবস্থায় আছে।এবার সুনামগঞ্জের ১৪২টি ছোট-বড় হাওরের সব বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলায় ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। ধানের (চালে) লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন। স্থানীয় কৃষকেরা বলছেন, আবাদ করা ধানের প্রায় ৯০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঋণের কিস্তির চিন্তায় অস্থিরআনোয়ারপুরের মনরূপা বেগম বলছিলেন, জমিতে ধান লাগানো সময় দুটি বেসরকারি সংস্থা থেকে ৪০ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছিলেন। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয় ১ হাজার ২০০ টাকা। ধান না পাওয়ায় এখন এই কিস্তি চালিয়ে যাবেন কীভাবে, এ চিন্তায় দিশেহারা তিনি। একইভাবে ২৫ হাজার টাকা ঋণ নিয়েছেন নারায়ণ বর্মণ। সপ্তাহে তাঁর কিস্তি ৬৭৫ টাকা। মধ্য তাহিরপুর গ্রামের অলক ধরের দুটি সংস্থায় ঋণ আছে ৩০ হাজার টাকা। তাঁর সপ্তাহে কিস্তি ৮০০ টাকা। অলক ধর জানান, অগ্রহায়ণ মাসে ঋণ নিয়েছিলেন। ফসল তুলে সব টাকা পরিশোধের চিন্তা ছিল। এখন ফসল গেছে, কিস্তি কীভাবে চালাবেন আর নিজে কীভাবে চলবেনÑএই ভেবে কূল পাচ্ছেন না। অলক ধর বলেন, কিস্তির টাকার জন্য সোমবার রাত ১০টা পর্যন্ত বাড়িতে অপেক্ষা করে গেছেন একটি সংস্থার লোক। তিনি বলেছেন, দেওয়ার কোনো ক্ষমতা নেই। মঙ্গলবার সকালে আবার আসার কথা ছিল। কিন্তু তিনি বাড়ি থেকে বের হয়ে আসায় জানেন না ওই লোক এসেছেন কি না।
হাওরে ফসল লাগানোর সময় বিভিন্ন এনজিওর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি দেওয়া বন্ধ করে দিতে কৃষকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের (সদর ও বিশ্বম্ভরপুর) সাংসদ পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ। সাংসদ বলেছেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী হাওরে ফসলহানির পর কৃষিঋণ আদায় বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এখন উচ্চ সুদে এনজিওগুলোর কাছ থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তির যন্ত্রণায় আছে ফসলহারা মানুষ। এনজিওগুলোর ঋণ মওকুফ করতে হবে।’তাহিরপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান কামরুজ্জামান কামরুল তাঁর দপ্তরে বসে জানান, তিনি এনজিও ঋণের কোনো কিস্তি না দিতে কৃষকদের বলে দিয়েছেন। এই ঋণ মওকুফ চান তিনিও। কামরুল বলেন,‘কৃষকদের ঋণের কিস্তি না দেওয়ার জন্য যেমন বলেছি, তেমনি এনজিও কর্মকর্তাদের পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছি, ফসলহারা মানুষদের ঋণের কিস্তির জন্য হয়রানি করলে পরিণাম ভালো হবে না।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) গাফিলতি আর বাঁধ নির্মাণকারী ঠিকাদারদের দুর্নীতি-ব্যর্থতার কারণে সুনামগঞ্জের হাওরাঞ্চলের তিন লাখ কৃষক পরিবার পথে বসেছে। ঠিকাদারেরা হাওরের বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতের দায়িত্ব পেয়ে তা সময়মতো ও সঠিকভাবে শেষ করেননি। ফলে ফসল রক্ষা বাঁধগুলো একে একে ভেঙে ফসলহানির মতো বিপর্যয় ঘটে গেছে।এ ধরনের বিপর্যয়ের আশঙ্কা আগেই করেছিল হাওরবিষয়ক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর জোট ‘হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম’ ও নাগরিক সংগঠনগুলো। মার্চের দ্বিতীয় সপ্তাহে তারা পাঁচটি জেলার সাতটি হাওরের বাঁধ নির্মাণকাজ পর্যবেক্ষণ করে তা জানিয়েছিল স্থানীয় প্রশাসনকে। এর দুই সপ্তাহ পরই প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে বাঁধ ভেঙে ফসলহানি ঘটে। এবার সুনামগঞ্জের হাওরে ২ লাখ ২৩ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছিল। কৃষকেরা জানিয়েছেন, ৯০ শতাংশ ফসলই পানিতে ভেসে গেছে।
মঙ্গলবার হাওর অ্যাডভোকেসি প্ল্যাটফর্ম (হ্যাপ) হাওরের বিপর্যয়ের কারণ ও করণীয় বিষয়ে একটি প্রতিবেদন চূড়ান্ত করেছে। তাতে এই বিপর্যয়ের পেছনে বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতি-অনিয়মের পাশাপাশি স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির (পিআইসি) গাফিলতিকেও দায়ী করেছে। কারণ, পিআইসির দায়িত্ব ছিল বাঁধ মেরামত করা। আর বাঁধ নির্মাণ ও উঁচু করার দায়িত্ব ছিল ঠিকাদারদের।এ ব্যাপারে জানতে চাইলে পাউবোর মহাপরিচালক জাহাঙ্গীর কবির বলেন, কাজে গাফিলতির জন্য আমরা পাউবোর সুনামগঞ্জের নির্বাহী প্রেেকৗশলীকে প্রত্যাহার করে নিয়েছি। অন্য কোনো কর্মকর্তার গাফিলতি ছিল কি না, তা আমরা খতিয়ে দেখছি।তবে এই বিপর্যয়ের পেছনে হাওরের কৃষকদের ভূমিকাও আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, তারা হাওর থেকে ধান কেটে নিয়ে যাওয়ার জন্য বাঁধের ৮০০টি স্থান কেটে ফেলেছিল। এসব ভাঙা অংশ এত দ্রুত মেরামত করা যায়নি। আর এক সপ্তাহের মধ্যে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কয়েক গুণ বেড়ে যাওয়ায় এই বিপর্যয় ঘটে।৩১ মার্চের মধ্যে বাঁধ নির্মাণের কাজ শেষ করার শর্তে ২৬টি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কাজ নিয়েছিল। তারা নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করতে পারেনি। যতটুকু হয়েছে, তাও নিম্নমানের বলে অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে পাউবোর অবস্থান জানতে চাইলে মহাপরিচালক বলেন, এ বিষয়ে পাউবো, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত কমিটি করেছে।এদিকে হাওরের উন্নয়নে দায়িত্বপ্রাপ্ত অপর সরকারি সংস্থা হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের মহাপরিচালকসহ চার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ১৮ এপ্রিল কানাডা সফরে গেছেন। ৩ মে তাঁদের দেশে ফেরার কথা। এ বিষয়ে বোর্ডের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
হ্যাপের যুগ্ম আহ্বায়ক মো. শরিফুজ্জামান প্র বলেন, ‘হাওরের এই মহাবিপর্যয়ের পেছনে পাউবোর দুর্নীতি-অনিয়ম এবং ঠিকাদারদের গাফিলতির বিষয়টি আমরা গত মার্চ থেকে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে জানিয়েছি। হাওরবাসীর প্রতি এই নিদারুণ অবহেলার আরেকটি প্রমাণ হলো, এই দুর্যোগের সময় হাওর বোর্ডের কর্মকর্তারা বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।
হ্যাপের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাঁধ নির্মাণের বরাদ্দ ডিসেম্বরে দেওয়া হলেও পিআইসি তাদের কমিটির নাম চূড়ান্ত করেছে ফেব্র“য়ারিতে। ওই কমিটির অনুমোদন ছাড়া ঠিকাদারেরা কাজ শুরু করতে পারেন না। প্রতিটি উপজেলায় স্থানীয় সাংসদের তিনজন প্রতিনিধি, উপজেলা চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন পরিষদের তিনজন প্রতিনিধি ওই কমিটিতে থাকেন। তাঁরা প্রতিটি প্রকল্পের নির্মাণকাজের অনুমোদন দেন ও তদারকি করে থাকেন।হাওরে বিপর্যয়ের কারণ অনুসন্ধানে পাউবোর গঠিত তদন্ত কমিটিও পিআইসির গাফিলতিকে দায়ী করেছে। একই সঙ্গে তারা ঠিকাদারদের ওপরও দোষ চাপিয়েছে। তবে এই বিপর্যয়ের পেছনে তারা সবচেয়ে বেশি দায়ী করছে আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনাকে।পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে হাওরের জন্য ৮৬ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে পাউবোর মাধ্যমে ৬৫ কোটি টাকা ও স্থানীয় প্রশাসনের মাধ্যমে কাজের বিনিময়ে টাকা (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় ২১ কোটি টাকা দেওয়া হয়। কিন্তু ৩১ মার্চের মধ্যে ওই কাজের ৬৫ শতাংশ শেষ হয়। আর ঠিকাদারদের ৩১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়।
বাঁধ নির্মাণে তিন কোটি টাকার তিনটি কাজের ঠিকাদারি পেয়েছিল মেসার্স নুর ট্রেডিং নামের একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। এর স্বত্বাধিকারী সুনামগঞ্জ জেলা যুবলীগের আহ্বায়ক খাইরুল হুদা চপল। তাঁর ভাই সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও সুনামগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক নুরুল হুদা মুকুট। খাইরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা এসব ছোটখাটো কাজ করি না। আমার ঠিকাদারি লাইসেন্স ব্যবহার করে অন্যরা হাওরের এ কাজ নিয়েছে। কাজের গাফিলতি ও নিম্নমান নিয়ে আমি কিছু বলতে পারব না।’সাবেক ছাত্রলীগ নেতা ও সুনামগঞ্জ চেম্বার অব কমার্সের সহসভাপতি সজীব রঞ্জন দাশের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নয়টি প্যাকেজে প্রায় ছয় কোটি টাকার কাজ পেয়েছে। কাজের গাফিলতি ও নিম্নমান নিয়ে তাঁকে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘আমরা জানুয়ারিতে কার্যাদেশ পেয়েছি। আর মার্চে কাজ শুরু করতে না করতে বৃষ্টি শুরু হয়ে যায়। ফলে ৬০ শতাংশের বেশি কাজ করা যায়নি। নিম্নমানের কাজের অভিযোগের কথা বলা হলে তিনি বলেন, মাটি দিয়ে বাঁধ নির্মাণে মানের কোনো প্রশ্ন নেই। এখানে তো ইট-সিমেন্ট ব্যবহার হচ্ছে না।
হ্যাপের হাওরবিষয়ক প্রতিবেদনের সমন্বয়কারী আনিসুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, বিপর্যয়ের পেছনে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না দিলে এ ঘটনা আবারও ঘটবে। বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় হাওরে জরুরি অবস্থা ও দুর্গত এলাকা ঘোষণা করে সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় অগ্রাধিকার দেওয়া উচিত।
মৌলভীবাজারে অবস্থিত দেশের বৃহত্তম হাকালুকি হাওরের বোরোসহ অন্যান্য ফসল পাহাড়ি ঢল থেকে রক্ষায় সরকারি কোনো উদ্যোগ এখনো নেওয়া হয়নি। এ কারণে আগাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে জেলার কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় হাওরের বিভিন্ন এলাকায় ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। এদিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবল থেকে হাওরের ফসল রক্ষাসহ বিভিন্ন দাবি জানিয়ে কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতি গতকাল সোমবার বিকেলে কুলাউড়ার ইউএনওর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেয়।তিন উপজেলার কৃষি কর্মকর্তার কার্যালয়, প্রশাসন ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) কর্মকর্তাদের সূত্রে জানা গেছে, হাকালুকি হাওরের আয়তন প্রায় ২৮ হাজার হেক্টর। এটি দেশের বৃহত্তম হাওর। কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা ছাড়াও সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ ও গোলাপগঞ্জ উপজেলার কিছু এলাকাজুড়ে এ হাওরটি বিস্তৃত। এ বছর মার্চ মাসের শেষ দিকে টানা কয়েক দিনের ভারী বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শুধু কুলাউড়া, জুড়ী ও বড়লেখা উপজেলায় হাওর তলিয়ে প্রায় ৯৫ কোটি টাকার কাঁচা ও আধা পাকা বোরো ধানের ক্ষতি হয়। ক্ষতিগ্রস্ত হন ২৬ হাজার কৃষক। এর আগে ২০১০ সালে এপ্রিল মাসের দিকে একইভাবে আগাম বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে হাওরের বোরো ধান তলিয়ে গিয়েছিল। হাওরের বিভিন্ন এলাকা প্রায় ছয় মাস জলাবদ্ধ ছিল। হাওরটির ফসল রক্ষায় ১৯৮২ সালের দিকে পাউবো একটি সেচ প্রকল্পের প্রস্তুতি নিয়েছিল। তখন মাছ চাষ ব্যাহত হওয়ার কারণ দেখিয়ে পরিবেশবিদ ও মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তারা আপত্তি জানালে প্রকল্পটি আর বাস্তবায়ন হয়নি। এরপর আর কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। কৃষক সমিতি ও ক্ষেতমজুর সমিতির দেওয়া স্মারকলিপিতে হাওর অঞ্চলকে দুর্গত এলাকা ঘোষণা, ফসল রক্ষায় পলিতে ভরাট হয়ে পড়া নদ-নদী ও খাল পুনঃখনন, বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং হাওরের বিল (জলমহাল) ইজারা প্রথা বাতিলসহ ১০ দফা দাবি উল্লেখ করা হয়।