মুক্তিযুদ্ধকালীন মানবতাবিরোধী অপরাধ তথা যুদ্ধাপরাধের মামলায় অভিযুক্ত কিশোরগঞ্জের রাজাকার সৈয়দ মো. হুসাইন ও মোহাম্মদ মোসলেম প্রধানকে মৃত্যুদন্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বুধবার ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হকের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিচারিক প্যানেল এ রায় ঘোষণা করে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বিচারে গঠিত ট্রাইব্যুনালে এটি ২৮তম রায়।মামলার রায় শুরুর প্রাক্কালে তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক তার প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, তারা যে রায় দিতে যাচ্ছেন, তা এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। পরে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের সার সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন। অপর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ার্দী পড়েন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক দন্ড ঘোষণা করেন।
রায় পরবর্তী এক প্রতিক্রিয়ায় প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ বলেন, এ রায় দেশের বিচারের ইতিহাসে আরেকটি সাফল্য। প্রসিকিউশন আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার বাহিনীর সদস্য হিসেবে হত্যা, গণহত্যা, লুণ্ঠন, অপহরণ ও নির্যাতনের সুনির্দিষ্ট ছয় অভিযোগে তাদের বিচার হয়। আনীত ছয় অভিযোগই ট্রাইব্যুনালে প্রমাণ করতে পেরেছে প্রসিকিউশন। প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান (সিএভি) রাখে। আজ রায় ঘোষণার দিন মঙ্গলবার ধার্য করে দেয় ট্রাইব্যুনাল। দুই আসামির মধ্যে মোসলেম প্রধানকে গ্রেফতার করা হলেও হুসাইন পলাতক।একাত্তরে কিশোরগঞ্জ এলাকায় হত্যা, গণহত্যা, ধর্ষণের মত
রায়ে বলা হয়, প্রসিকিউশনের আনা ছয় অভিযোগের সবগুলোই প্রমাণিত হয়েছে। ফাঁসিতে ঝুলিয়ে আসামিদের সাজা কার্যকর করতে হবে। সেই সঙ্গে পলাতক মো. হুসাইনকে গ্রেপ্তার করে সাজা কার্যকর করতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও পুলিশের আইজিকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে ট্রাইব্যুনালের রায়ে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে ইন্টারপোলের সহযোগিতা নিতে বলা হয়েছে। মামলার অভিযোগপত্রে বলা হয়, দুই আসামি একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তাদের মধ্যে হুসাইন নিকলি থানা এলাকায় রাজাকার দারোগা হিসেবে এবং মোসলেম প্রধান নিকলি ইউনিয়নে রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন।তারা তখনকার কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে এ মামলার বিচারে উঠে এসেছে।হুসাইনের বড় ভাই সৈয়দ মো. হাসান ওরফে হাছেন আলীকেও যুদ্ধাপরাধের দায়ে মৃতুদন্ড দিয়েছে ট্রাইব্যুনাল। ভাইয়ের মত হাছেন আলীও পলাতক।
রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করে ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় সাংবাদিকদের বলেন, রায়ে আমরা অত্যন্ত খুশি। সফলভাবে কাজ করতে পেরেছি। দুটো মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে, একটি আমৃত্যু কারাদন্ড এবং অপর তিনটি অভিযোগে ২২ বছরের সশ্রম কারাদন্ড হয়েছে।একটি দিক দিয়ে এ মামলায় অসাধারণ সাফল্য এসেছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, এই রায়ে প্রথমবারের মত যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে গণহত্যার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। একাত্তরের গণধর্ষণকে আদালত জেনোসাইডাল রেপ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, ওই চার্জে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদন্ড দেওয়া হয়েছে।অন্যদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবী আবদুস সাত্তার পালোয়ান বলেন, ট্রাইব্যুনাল ও আইনের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল। মক্কেলের সঙ্গে পরামর্শ করে আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।নিয়ম অনুযায়ী ট্রাইব্যুনালের মামলায় রায়ের এক মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ আদালতে আপিল করা যায়। তবে পলাতক পলাতক সৈয়দ মো. হুসাইনকে সে সুযোগ নিতে হলে আত্মসমর্পণ করতে হবে।ট্রাইব্যুনালে এ পর্যন্ত রায় আসা ২৮টি মামলার ৪৮ আসামির মধ্যে মোট ৩০ যুদ্ধাপরাধীর সর্বোচ্চ সাজার আদেশ হল। বুধবার বেলা সাড়ে ১০টার আদালত বসার পর ১১টার কিছুক্ষণ আগে কিশোরগঞ্জের দুই আসামির রায়ের কার্যক্রম শুরু হয়।তিন সদস্যের এ ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান বিচারপতি আনোয়ারুল হক প্রারম্ভিক বক্তব্যে জানান, তারা যে রায় দিতে যাচ্ছেন, তা এসেছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে।পরে বিচারপতি শাহিনুর ইসলাম রায়ের সার সংক্ষেপ পড়া শুরু করেন। অপর বিচারপতি মো. সোহরাওয়ারদীও পড়বেন রায়ের দ্বিতীয় অংশ। সবশেষে বিচারপতি আনোয়ারুল হক সাজা ঘোষণা করেন।দুই আসামির মধ্যে মোসলেম প্রধানকে সকালে রায়ের জন্য কারাগার থেকে আদালতে নিয়ে আসা হয়। আর পলাতক হুসাইন মালয়েশিয়ায় রয়েছেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য। সৈয়দ মোসলেহ উদ্দিন ও সৈয়দা ফাতেমা বানুর ছেলে মো. হুসাইনের জন্ম ১৯৫১ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর।তার স্থায়ী ঠিকানা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাছিহাতা হলেও তার সর্বশেষ বর্তমান ঠিকানা ছিল ঢাকার খিলক্ষেতের পিংক সিটির ৬ নম্বর সড়কের ২ নম্বর বাড়ি। তবে মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি কিশোরগঞ্জের হয়বতনগরে থাকতেন বলে প্রসিকিউশনের তথ্য।হুসাইন কিশোরগঞ্জের গুরুদয়াল কলেজ থেকে ১৯৬৯ সালে এসএসসি ও ১৯৭৫ সালে বিএ পাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের আগে তিনি আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও যুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তান ডেমোক্র্যাটিক পার্টির মতাদর্শ গ্রহণ করেন।ওই সময় নিকলি থানা এলাকায় রাজাকার দারোগা হিসেবে পরিচিত হুসাইন কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ। তিনি ট্রাইব্যুনালের রায়ে মৃতুদন্ড প্রাপ্ত পলাতক সৈয়দ মো. হাসান ওরফে হাছেন আলীর ছোটভাই।১৯৪৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের নিকলি থানার কামারহাটি গ্রামে মোসলেমের জন্ম। তার বাবা লাভু শেখ ও মা রেজিয়া আখতার। তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই; তবে অক্ষরজ্ঞান আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি নিকলি ইউনিয়নের রাজাকার কমান্ডার হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং কিশোরগঞ্জ মহকুমার বিভিন্ন জায়গায় ব্যক্তিগত ও যৌথভাবে গণহত্যাসহ মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটিত করেন বলে প্রসিকিউশনের অভিযোগ।মোসলেম পরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হন।
২০১৪ সালের ১৩ নভেম্বর হুসাইনের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে একটি অভিযোগ দাখিল করা হয়। ওই অভিযোগ তদন্তকালে মোসলেম প্রধানের নাম আসে।ট্রাইব্যুনাল গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করলে ২০১৫ সালের ৭ জুলাই কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার কামারহাটি গ্রাম থেকে মোসলেমকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর দুইজনের বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, অগ্নিসংযোগসহ মানবতাবিরোধী অপরাধের ছয়টি ঘটনায় ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করে তদন্ত সংস্থা। এ মামলায় সাক্ষী করা হয় মোট ৪৭ জনকে।অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে গত বছরের ৯ মে মোসলেম ও হুসাইনের বিচার শুরু করে ট্রাইব্যুনাল।প্রসিকিউশন ও আসামিপক্ষের যুক্তি উপস্থাপন শেষে গত ৭ মার্চ ট্রাইব্যুনাল মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখে।ট্রাইব্যুনালে এ মামলায় প্রসিকিউশনের পক্ষে শুনানি করেন প্রসিকিউটর তুরিন আফরোজ। আসামিদের পক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট আবদুস সাত্তার পালোয়ান।