এসো হে বৈশাখ এসো এসো, তাপস নিঃশ্বাস বায়ে, মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক যাক, এসো, এসো চিরায়ত এই আহ্বানের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪২৪।শুক্রবার জীর্ণ-পুরাতনকে পেছনে ফেলে সম্ভাবনার নতুন বছরে প্রবেশ করলো বাঙালি জাতি। বর্ণিল উৎসবে মেতে উঠল দেশ। রাজধানীসহ সারা দেশেই বর্ষবরণের নানা আয়োজন করা হয়।লাল ও সাদা রঙের পাঞ্জাবি, শাড়ি আর জামায় ফুটে উঠলো রাজধানীসহ বাঙালিয়ানা।সকালেই বিভিন্ন এলাকায় এমনকি অনেকের ঘরে খাওয়া হয় পান্তা-ইলিশ।বৈশাখের শুরুর দিনটিতে গনগনে রোদ উপেক্ষা করে বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, চারুকলা, টিএসসি এলাকায় বৈশাখী সাজে ঢল নামে সাধারণ মানুষের।তরূণীদের পরনে লাল পেড়ে সাদা জমিনের শাড়ি, যুবকরা এসেছেন লাল-সাদা পাঞ্জাবি পরে। বৈশাখী সাজ থেকে বাদ যায়নি শিশু-কিশোররাও।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ এলাকায় গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পুতুল নাচ, নাগরদোলায় চড়ার আনন্দে মেতে উঠেছে শিশুরা। সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রায় যারা অংশ নিতে পারেননি তারা বিকেলে গ্রাম্য মেলার সাধ নিতে এসেছেন চারুকলায়।সকালের মঙ্গল শোভাযাত্রা শেষে চারুকলা চত্বরে সাজিয়ে রাখা রাজা-রানি, বাঘ, পেঁচাগুলো দর্শনার্থীদের বিনোদনের খোরাক হয়ে উঠেছে। সেগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে সেলফি ও ছবি তুলছেন অনেকেই।১৪২৪ বঙ্গাব্দের প্রথম সূর্যের আলো ফুটেছে ধরায়। সে আলোয় উদ্ভাসিত চারিদিক।সে আলোয় আলোকিত রাজধানী ঢাকার রমনা বটমূল। সেখানে বর্ষবরণের অনুষ্ঠান শুরু ঠিক সকাল সোয়া ছয়টায়। গানে গানে, কবিতায়, বাদ্যযন্ত্রের মুর্ছনায় শুরু হয় নতুন একটি দিন, নতুন একটি বছর। আর বলাই চলে নতুন একটি অধ্যায়।

ভোরের আলো যখন ফুটতে শুরু করেছে তখন থেকেই দিকে দিকে বেজে ওঠে, এসো এসো হে বৈশাখ এসো এসো। অনেকেই সেই গান গাইতে গাইতে ঢুকে পড়তে থাকেন রমনা বটমূল চত্তরে। সেখানে সকাল সোয়া ছয়টায় শুরু হয় বর্ষবরণ মূল উৎসব। ছায়ানটের আয়োজনে ঐতিহ্যবাহী এই অনুষ্ঠান বর্ষবরণের সূচনা বলেই বিবেচিত।রমনার বটমূলে বর্ষবরণরাগ ভৈরবী দিয়ে শুরু হয় ছায়ানটের পরিবেশনা। সে রাগের অনিন্দ্য মূর্ছনায় এরই মধ্যে ভরে উঠেছে রমনার চারিদিক। তবলা আর মৃদঙ্গের স্বর আর সুর যেনো সৃষ্টি করেছে এক অপরূপ দ্যোতনা। রমনা বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ উৎসবশিল্পীদের সোনালি রঙা পরিচ্ছদে সকালের সোনালী আলো পড়ে চারিদিক করে তুলেছে স্বর্ণময়।
এ বছর ছায়ানটের এই আয়োজনের মূল প্রতিপাদ্য আনন্দ, আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও মানবতা।ছায়ানট এ বছর উদযাপন করছে ৫০ বছর পূর্তি। ফলে আয়োজনে থাকছে বাড়তি কিছু।প্রথমাংশে বাদন, যা এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। দ্বিতীয়াংশে গান-কবিতা আবৃতি আর শেষ পর্বে থাকবে একটি লোকপালার উপস্থাপনা। আর ঐতিহ্য মেনে ছায়ানট প্রধান সনজিদা খাতুনের একটি দিকনির্দেশনামূলক বক্তৃতাতো থাকবেই। লোকপালায় দেওয়ানা মদিনার উপস্থাপনা থাকবে নেত্রকোণার বিখ্যাত দিলু বয়াতি ও তার দলের।মোহাম্মদপুর থেকে বাবার সঙ্গে এসেছেন ছয় বছরের সিয়াম। প্রথমবার নাগরদোলায় কিছুটা ভয় কাজ করলেও অন্য শিশুদের সঙ্গে সে-ও উচ্ছ্বসিত। আজ অনেক আনন্দ লাগছে, বাবার সাথে এসেছি মেলায়- জানায় সিয়াম।

চারুকলা প্রাঙ্গণেই দর্শনার্থীদের আরেক আকর্ষণের জায়গা ‘নিউ সোনার বাংলা পুতুল নাচ’। ৫০ টাকায় আধঘণ্টা ধরে চারটি পুতুলের নাচ দেখতে পাচ্ছেন তারা।পুতুল নাচের টিকেট বিক্রেতা সাহানা জানালেন, শিশু থেকে শুরু করে সব বয়সের মানুষই উপভোগ করছেন। চারটি পুতুল কীভাবে মানুষের সঙ্গে কথা বলে তা দেখতে পাচ্ছে দর্শক।শুধু চারুকলা এলাকা নয়, শাহবাগ থেকে টিএসসি পর্যন্ত রাস্তার দু’পাশে তালপাতার হাতপাখা, টুনটুন গাড়ি, বাঁশের বাশি, চুড়ি-ফিতার পসরা সাজিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। ঠিক যেনো গ্রাম্য মেলার সাধ পাচ্ছে নববর্ষকে স্বাগত জানিয়ে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বাণী দিয়েছেন। রাষ্ট্রপতি তার বাণীতে বলেন, বাংলা নববর্ষের মধ্যে নিহিত রয়েছে বাঙালির আত্মপরিচয়, উত্থান এবং জাতিসত্তা বিকাশের শেকড়। তিনি বলেন, স্বাধীনতা পূর্বকালে আমাদের সংস্কৃতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধের ওপর বারবার আঘাত এসেছে। নিজস্ব ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভিন্নধারায় প্রবাহিত করতে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে ভিনদেশি সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালি জাতি তা কখনো মেনে নেয়নি। তাইতো প্রতি বছর পহেলা বৈশাখ বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতিসত্তা বিকাশের প্রবল শক্তি নিয়ে উপস্থিত হয়।প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, বাংলা নববর্ষ এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদ পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বাঙালি জাতি বর্ষবরণ উৎসবকে ধারণ করেছে তাদের জীবনযাত্রা ও সংস্কৃতির অনুষঙ্গ হিসেবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে আমরা প্রগতি এবং অগ্রগতির দিকে ধাবিত হচ্ছি। তিনি বলেন, অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিগত বছরটি ছিল বাংলাদেশের জন্য প্রভূত সাফল্যময়। বাংলাদেশ আজ আর্থসামাজিক উন্নয়নে বিশ্বের রোল মডেল।দুনিয়ার বহু দেশেই একটা সাধারণ উৎসব হলো নববর্ষ। বাংলাদেশে গ্রামেগঞ্জে এ উৎসব বহুকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে মেলা আর হালখাতা হিসেবে। পাহাড়ে এই উৎসবের নাম বৈসাবি।

ভারতবর্ষে মুঘল স¤্রাটরা হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে খাজনা আদায় করত। কিন্তু হিজরি সন চাঁদের ওপর নির্ভরশীল হওয়ায় তা কৃষি ফলনের সঙ্গে মিলত না। এতে অসময়ে কৃষকদের খাজনা পরিশোধে বাধ্য করতে হতো। খাজনা আদায় সুষ্ঠুভাবে করতেই স¤্রাট আকবর বাংলা সনের প্রবর্তন করেন। তিনি মূলত প্রাচীন বর্ষপঞ্জিতে সংস্কার আনার আদেশ দেন। স¤্রাটের আদেশ মতে তৎকালীন বাংলার বিখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও চিন্তাবিদ ফতেহউল্লাহ সিরাজি সৌর সন এবং আরবি হিজরি সনের ওপর ভিত্তি করে নতুন বাংলা সনের নিয়ম তৈরি করেন। ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দের ১০ মার্চ বা ১১ মার্চ থেকে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে বঙ্গাব্দ বা বাংলাবর্ষ নামে পরিচিত হয়।

তখন প্রত্যেককে চৈত্র মাসের শেষ দিনের মধ্যে সব খাজনা, মাশুল ও শুল্ক পরিশোধ করতে হতো। এর পরদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখে ভূমির মালিকরা নিজ নিজ অঞ্চলের অধিবাসীদের মিষ্টি দিয়ে আপ্যায়ন করতেন। পরে পাকিস্তান শাসনামলে আনুষ্ঠানিকভাবে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। আর ষাটের দশকের শেষে তা বিশেষ মাত্রা পায় রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনের মাধ্যমে।১৯৮৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে বের হয় প্রথম মঙ্গল শোভাযাত্রা। ২০১৬ সালের ৩০ নভেম্বর ইউনেস্কো এ শোভাযাত্রাকে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের মর্যাদা দিয়েছে।এদিকে বাঙালির এই প্রাণের উৎসবকে ঘিরে রমনা পার্কসহ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরোটাই ঢেকে দেয়া হয় নিরাপত্তার চাদরে। শুধু রাজধানী ঢাকায়ই নয়, এ উপলক্ষে সারা দেশেই বিশেষ নিরাপত্তাব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।বর্ষবরণে রমনার বটমূলের ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ছায়ানট ভোরে সূর্যের আলো দেখার সঙ্গে সঙ্গেই অর্থাৎ ভোর ৬টা ১০ মিনিটে সরোদবাদন দিয়ে শুরু করে বর্ষবরণের মূল অনুষ্ঠান। রমনায় ছায়ানটের অনুষ্ঠানের অর্ধশতাব্দী পূরণ উপলক্ষে এবারের আয়োজন হবে বড় ও তিন পর্বে বিভক্ত। বেলা ১০টায় হয় দেওয়ানা মদিনা লোকপালা। এদিকে চারুকলার শিক্ষার্থীরা সকাল ৯টায় বের হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল প্রতিপাদ্য করা হয়েছে- আনন্দলোকে মঙ্গলালোকে বিরাজ সত্য সুন্দর। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট বিকেল ৪টায় রাজধানীর মিরপুর, দনিয়া রায়েরবাজারসহ বিভিন্নস্থানে একক ও দলীয় লোকসংগীত, নৃত্য ও আবৃত্তিসহ নানা আয়োজন পরিবেশন করবে। বাংলা একাডেমি সকাল সাড়ে ৭টায় একাডেমির রবীন্দ্র-চত্বরে বর্ষবরণ উপলক্ষে একক বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। দিবসটি উপলক্ষে একাডেমি ‘বইয়ের আড়ং’ শিরোনামে বইমেলার আয়োজন করে। এ ছাড়া ১০ দিনব্যাপী বৈশাখী মেলাও হবে। শনিবার বিকেল ৫টায় আয়োজন করেছে বিশেষ নাট্যানুষ্ঠানের। অনুষ্ঠানে লালন ফকিরের জীবন ও দর্শননির্ভর নাটক ‘ম্যান অব দ্য হার্ট’ পরিবেশিত হবে।বর্ষবরণ উপলক্ষে চ্যানেল আই ও সুরের ধারা বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলনকেন্দ্রে আয়োজন করে সানসিল্ক হাজারো কণ্ঠে’ বর্ষবরণের অনুষ্ঠান। অন্যদিকে জাতীয় প্রেসক্লাব ও ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি বর্ষবরণে তাদের সদস্য ও তাদের পরিবারের জন্য দিনব্যাপী নানা আয়োজন করে ।