মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানের সঙ্গে তার পরিবারের চার সদস্য বুধবার সাক্ষাৎ করেছে।সকালে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারে মুফতি হান্নানের স্ত্রী জাকিয়া পারভিন রুমা, বড় ভাই আলী উজ্জামান মুন্সি, বড় মেয়ে নিশি খানম ও ছোট মেয়ে নাজরিন খানম দেখা করেন। কারা কর্তৃপক্ষ জানায়, সাক্ষাতের জন্য কারাগারের বার্তা পেয়ে মঙ্গলবার রাতেই মুফতি হান্নানের বড় ভাই, স্ত্রী ও দুই মেয়ে কাশিমপুর কারাগারের উদ্দেশে কোটালিপাড়া থেকে রওনা দেয়। সকাল সাড়ে ৬টায় তারা কাশিমপুর কারাগারে এসে পৌঁছায়। পরে সকাল ৭টা ১০ মিনিটে তাদের সাক্ষাতের অনুমতি দেয়া হয়। প্রায় আধা ঘন্টা তারা মুফতি হান্নানের সঙ্গে কথা বলেন। ৮টা ১৫ মিনিটে তারা কারগার থেকে বেরিয়ে আসেন।কারাগার সূত্র আরো জানায়, রাষ্ট্রপতির কাছে মুফতি হান্নানের প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হওয়ার পর দুই জঙ্গির সাথে শেষ দেখা করার জন্য তাদের স্বজনদের কাছে মঙ্গলবার বার্তা পাঠানো হয়। এতে হান্নানের পরিবার দেখা করতে আসলেও ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত অপর জঙ্গি শরীফ শাহেদুল বিপুলের পরিবারের কোনো সদস্য আজ সকাল পর্যন্ত কারাগারে আসেনি।

কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. মিজানুর রহমান এ তথ্য নিশ্চিত করে জানান, মৃত্যুদন্ড কার্যকর করতে ফাঁসির মঞ্চ পুরোপুরি প্রস্তুত করা হয়েছে। ছামিয়ানা টাঙ্গানো হয়েছে। জল¬াদদেরকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে। কারাবিধি মোতাবেক ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আদেশ পাওয়া মাত্র ফাঁসি কার্যকরের ব্যবস্থা নেয়া হবে।মুফতি আব্দুল হান্নানসহ মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত এ দুই জঙ্গির ফাঁসির রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে গাজীপুর কারা কমপ্লেক্স ও এর আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেয়া হয়েছে।

গাজীপুরের পুলিশ সুপার জানান, কারাগার ও আশপাশের এলাকায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। সাদা পোশাকে পুলিশ তাদের দায়িত্ব পালন করছে। জেলা পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সতর্ক ও তৎপর রয়েছে। ফাঁসির রায় কার্যকর করাকে কেন্দ্র করে গাজীপুরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে।২০০৪ সালের ২১ মে সিলেটের হযরত শাহ জালাল (র.) মাজারে তৎকালীন ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা হয়। হামলায় দুই পুলিশ কর্মকর্তাসহ তিনজন নিহত এবং আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের তৎকালীন জেলা প্রশাসকসহ অর্ধশতাধিক ব্যক্তি আহত হন।এ ঘটনায় দায়েরকৃত মামলায় মুফতি হান্নান, বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনকে মৃত্যুদন্ড দেন বিচারিক আদালত। হাইকোর্টেও আপিল বিভাগের রায় বহাল থাকে।রায় পুনর্বিবেচনা চেয়ে (রিভিউ) তিনজনের করা আবেদন উচ্চ আদালতে খারিজ হওয়ায় গত ২৭ মার্চ তিনজনই কারা কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রাণভিক্ষা চেয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করেন।রোববার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, তাদের প্রাণভিক্ষার আবেদন রাষ্ট্রপতি নাকচ করেছেন। মৃত্যু দন্ডাদেশপ্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান ও শরীফ শাহেদুল আলম বিপুল এখন কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের ফাঁসির সেলে বন্দি রয়েছেন।

এক যুগেরও বেশি সময় আগে সিলেটে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা চালিয়ে তিনজনকে হত্যার মামলায় মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামি মুফতি হান্নান।ওই মামলায় তার দুই সহযোগীশরীফ শাহেদুল বিপুল ও দেলোয়ার হোসেন রিপনেরও একই সাজার রায় এসেছে সর্বোচ্চ আদালত থেকে। রায় পুনর্বিবেচনা এবং অপরাধ স্বীকার করে প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ হয়ে যাওয়ায় এখন কেবল তাদের ফাঁসি কার্যকরের অপেক্ষা। হান্নানের মত বিপুলকেও রাখা হয়েছে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে। আর দেলোয়ার হোসেন রিপন আছেন সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে।নিয়ম অনুযায়ী, মৃত্যুদন্ড কার্যকরের আগে আসামির সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যদের সাক্ষাতের সুযোগ দেওয়া হয়। সে অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষের ডাক পাওয়ার পর মঙ্গলবার বিকালে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারে রিপনের সঙ্গে দেখা করেন তার মা-বাবাসহ পরিবারের সদস্যরা। কাশিমপুর কারাগার কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, মঙ্গলবার মুফতি হান্নানের সঙ্গে বিপুলের পরিবারের সদস্যদেরও সাক্ষাতের জন্য খবর পাঠানো হয়। সে অনুযায়ী মুফতি হান্নানের পরিবারের সদস্যরা গোপালগঞ্জের কোটালিপাড়া থেকে গাজীপুরে এসে দেখা করে গেলেও চাঁদপুর থেকে বিপুলের পরিবারের কেউ বুধবার সকাল পর্যন্ত এসে পৌঁছাননি। জেলসুপার মিজানুর রহমান জানান, হান্নানের ভাই, স্ত্রী ও দুই মেয়ে ভোরে কাশিমপুরে পৌঁছানোর পর সকাল সাড়ে ৬টার দিকে তারা কারাগারে প্রবেশ করেন এবং ৭টা ১০ এ হান্নানের সঙ্গে সাক্ষাত করেন।সকাল ৮টার পর কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে হান্নানের বড় ভাই আলি উজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, উনি সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন।ৃ বলেছেন, তাকে মিথ্যা মামলায় জড়িত করে এ অবস্থায় দাঁড় করানো হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে যেটা হয়েছে সেটাই মেনে নিতে হবে।বড় ভাই জানান, তাদের মা অসুস্থ থাকায় আসতে পারেননি। হান্নান মায়ের সঙ্গে কথা বলার ইচ্ছা প্রকাশ করায় কারা কর্তৃপক্ষ তার মোবাইল নম্বর রেখে দিয়েছে। তারা বলেছে, কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সম্ভব হলে কথা বলার সুযোগ দেওয়া হবে।

সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজার প্রাঙ্গণে ২০০৪ সালের ২১ মে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরী গ্রেনেড হামলার মুখে পড়েন। এতে তিন পুলিশ সদস্য নিহত হন; আনোয়ার চৌধুরী ও সিলেটের জেলা প্রশাসকসহ অন্তত ৪০ জন আহত হন।ওই ঘটনায় সিলেটের দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল ২০০৮ সালের ২৩ ডিসেম্বর হুজি নেতা মুফতি হান্নান, বিপুল ও রিপনকে মৃত্যুদন্ড এবং মহিবুল্লাহ ও আবু জান্দালকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেন।২০১৬ সালের ১১ ফেব্র“য়ারি হাই কোর্ট তিন আসামির মৃত্যুদ- এবং দুইজনের যাবজ্জীবন দন্ড বহাল রাখে।এ মামলার চূড়ান্ত রায়ে আপিল বিভাগ গত বছরের ৭ ডিসেম্বর তিন আসামির সর্বোচ্চ সাজার সিদ্ধান্ত বহাল রাখে।গত ৬ মার্চ একটি মামলার শুনানি শেষে মুফতি হান্নান ও তার সহযোগীদের আদালত থেকে কাশিমপুর কারাগারে ফিরিয়ে নেওয়ার পথে টঙ্গীতে প্রিজন ভ্যানে হামলা চালিয়ে তাদের ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হয়।আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত তিন আসামি রায় পুনর্বিবেচনার (রিভিউ) আবেদন করেন। তাদের আবেদন গত ১৯ মার্চ সর্বোচ্চ আদালতে খারিজ হয়ে যায়। ফলে চূড়ান্ত বিচারেও ফাঁসির রায় বহাল থাকে।

প্রাণ বাঁচানোর শেষ চেষ্টায় সাংবিধানিক অধিকারের সুযোগ নিয়ে রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়েছিলেন তিন জঙ্গি। তাদের সেই আবেদন নাকচ হয়ে গেছে বলে ৯ এপ্রিল সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।সব আইনি প্রক্রিয়া শেষে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ এ মামলার তিন আসামির প্রাণভিক্ষার আবেদন নাকচ করার পর কারা কর্তৃপক্ষ তাদের ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি নিয়েছে।কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র সুপার মো. মিজানুর রহমান বলেন, কারাগারে জল্লাদ ও ফাঁসির মঞ্চসহ সব কিছু প্রস্তুত আছে। সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ছগির মিয়াও বলেছেন, দন্ড কার্যকরে আমরা প্রস্তত আছি। উচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত ও সব প্রক্রিয়া শেষ হলেই ফাঁসি কার্যকর করা হবে।তবে কখন এই তিন আসামির ফাঁসি কার্যকর করা হবে সে বিষয়ে নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারেননি।গাজীপুরের পুলিশ সুপার মো. হারুন উর রশিদ বলেন, রায় যেহেতু হয়েছে। কার্যকর এক সময় না এক সময় হবেই। সেটাকে (রায়) কেন্দ্র করে আমাদের একটু বাড়তি নিরাপত্তা ব্যাবস্থা নেওয়া হয়েছে, গাজীপুরের প্রতিটি জায়গায় অভিযান পরিচালনা করছি।কারাগারের আশপাশে পোশাকধারী পুলিশের পাশাপাশি বহু সংখ্যক সাদা পোশাকের পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ রয়েছে বলে জানান তিনি।