১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নতুন বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী আর ভারতীয় মিত্রবাহিনীর কাছে ৯৩ হাজার পাকিস্তানি সৈন্যসহ আত্মসমর্পণ করেন পাকিস্তানের জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান ‘টাইগার’ নিয়াজি। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে মুক্তিযুদ্ধ শেষ হলেও সব কাজ তখনো শেষ হয়ে যায়নি। নিয়াজি ও তার বাহিনীর আত্মসমর্পণের ঠিক একদিন পরই একটি অত্যন্ত জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ মিশন এসে পড়ে ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা মেজর অশোক তারার কাঁধে- বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে বাঁচানোর মিশন।

কিছুদিন আগেই ‘গঙ্গাসাগরের যুদ্ধে’ বীর চক্র সম্মাননা পাওয়া ২৯ বছর বয়সী তারাকে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে নির্দেশ দেয়া হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্ত্রী এবং পরিবারকে উদ্ধার করতে হবে, যাদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধুর ২৪ বছর বয়সী কন্যা শেখ হাসিনা আর তার মেয়ে পুতুল ও ছেলে জয়। পুরো পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছিল ধানমণ্ডি আঠারো নম্বরের একটি সুরক্ষিত বাড়িতে, যেখানে পাহাড়া দিচ্ছিল গুলি করতে সদাপ্রস্তুত ডজনখানেক পাকিস্তানে সেনা সদস্য। বাড়িটি বিমানবন্দর থেকে মাত্র মিনিট বিশেকের দূরত্বে।

গোপন মিশন ছিল বলে তারার সঙ্গে ছিল মাত্র তিনজন সহযোগী সেনা। ওই চারজন মিলে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশল এবং উপস্থিত বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে কোনো পক্ষের একফোঁটা রক্তও না ঝরিয়ে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সবাইকে সেদিন নিরাপদে উদ্ধার করে আনেন। ১৭ ডিসেম্বরের সেই উপকারের জন্য আজও অশোক তারার কাছে কৃতজ্ঞ বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রীর জীবন রক্ষাকারী এখন অবসরপ্রাপ্ত কর্নেল তারা। ওই ঘটনার ৪৬ বছর পর শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফরে তার আবার দেখা হলো প্রাণ বাঁচানো সেই বীর যোদ্ধার সঙ্গে। এবারের ভারত সফরে শনিবার দিল্লি সেনানিবাসের মানেকশ সেন্টারে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়া মিত্রবাহিনীর বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন শেখ হাসিনা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন অশোক তারা। সেখানেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ মোদি এবং অশোক তারাকে একসঙ্গে দেখা যায়।

শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার পর টাইমস অব ইন্ডিয়াকে সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা আবেগাপ্লুত হয়ে বলেন, ‘শেখ হাসিনাজি আমাকে এবং আমার স্ত্রী আভাকে দেখে খুব খুশি হয়েছেন। তিনি মোদিজিকে বলেছেন, আমি তাকে এবং তার পরিবারকে কোনো নিরস্ত্র অবস্থায় একা উদ্ধার করেছি।’

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ভারত অংশ নিয়ে ১৩ দিনে ৩ হাজার ৮৪৩ জন সৈন্য হারানোর মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা ত্বরান্বিত করে। তবে তাদের মধ্যে অশোক তারা এমন একজন মানুষ, যার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু পরিবারের একটি বিশেষ ব্যক্তিগত সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, সেই ১৭ ডিসেম্বরের মধ্য দিয়ে।

কী হয়েছিল সেদিন
১৯৭১ সালের দিনটি ছিল শীতকাল। তারা এবং তার তিন সহযোগী সেনা গাড়িতে করে ধানমণ্ডি যাচ্ছিলেন। কিন্তু যে বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে আটকে রাখা হয়েছে, তার একটু আগেই একটা জটলা তাদের থামতে বাধ্য করে। সামনে একটি পোড়া গাড়ি, ভেতরে চালকের আসনে একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। উপস্থিত লোকজন জানালো, এলাকার অবস্থা ভালো না। এই অবস্থায় সামনে এগোনো খুবই বিপজ্জনক।

এমন পরিস্থিতিতে ধানমণ্ডি আঠারো নম্বর বাড়িটির সামনে উপস্থিত পাকিস্তানি সেনাদের তাক করা রাইফেলের সামনেই অশোক তারা নিজের অস্ত্র গাড়িতেই সঙ্গীদের কাছে রেখে একা বেরিয়ে বাড়িটির দিকে এগোতে থাকলেন। বঙ্গবন্ধুর পুরো পরিবারকে যে কোনো আকস্মিক পরিস্থিতিতে হত্যার নির্দেশনা পাওয়া পাকিস্তানি সেনাদলটি তাকে সতর্ক করে, আর কাছে গেলেই গুলি করা হবে।

উচ্চপদস্থদের সঙ্গে সম্পূর্ণ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় ছিল ডজনখানেক সদস্যের সেই সেনাদল। এমনিতেই তারা আছে অনেকটা দিশেহারা অবস্থায়। পরিস্থিতি বিবেচনা করে পাঞ্জাবি আর হিন্দি মিলিয়ে মেজর দলটিকে বোঝাতে চেষ্টা করলেন, যেন তারা অস্ত্র নামিয়ে ফেলে।

‘পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যে আত্মসমর্পণ করেছে, ঢাকায় তাদের ক্ষমতার পতন হয়েছে এবং যুদ্ধ যে আক্ষরিক অর্থেই শেষ – এ ব্যাপারে তাদের কোনো ধারণাই ছিল না,’ বলেন অশোক তারা, ‘আমি তাদের বললাম, যদি এটা সত্যি না হতো, তবে একজন ভারতীয় সেনা কর্মকর্তা তাদের সামনে অস্ত্র ছাড়া দাঁড়িয়ে থাকতে পারত না।’ নিজের কথার প্রমাণ হিসেবে মাথার ওপর উড়তে থাকা কয়েকটি ভারতীয় হেলিকপ্টারও দেখিয়ে দিলেন তিনি।

মেজর অশোক তারা ওই পাকিস্তানি সেনাদের নিশ্চয়তা দিলেন, এখন আত্মসমর্পণ করলে তাদেরকে নিরাপদে পরিবারের কাছে ফেরত পাঠানো হবে। অবশেষে দায়িত্বরত সেনাদলটি নরম হয়ে আসে। তারার কথা শুনে বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে অবরোধ থেকে নিরাপদে বের হতে দেয়া হয়।

১৯৬৩ সালে ইন্ডিয়ান আর্মির ফরটিন গার্ডস বাহিনীতে কমিশন হন অশোক তারা এবং ১৯৯৪ সালে তিনি কর্নেল মর্যাদা নিয়ে অবসর গ্রহণ করেন। অশোক তারার কৌশলে সেই দিন উদ্ধার পাওয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১২ সালের জুনে তাকে ‘ফ্রেন্ড অব বাংলাদেশ’ পদকে ভূষিত করেন।