ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন তাঁর এবং শেখ হাসিনার সরকার তিস্তা চুক্তির বিষয়টি দ্রুত সমাধান করতে পারবে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তিস্তা চুক্তির বিষয়টি ভারত দ্রুত সমাধান করবে।শনিবার দুপুরে নয়াদিল্লির হায়দরাবাদ হাউসে দুই প্রধানমন্ত্রীর শীর্ষ বৈঠকের পর যৌথ সংবাদ সম্মেলনে এসব কথা জানানো হয়। বাংলাদেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দুপুর পর্যন্ত দুই দেশের মধ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে ৩৪টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে। প্রতিরক্ষা, ঋণ, মহাকাশ, পারমাণবিক শক্তির শান্তিপূর্ণ ব্যবহার, তথ্যপ্রযুক্তি, বিদ্যুৎ, জ্বালানিসহ বিভিন্ন খাতে এসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে।এ ছাড়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র হিন্দি সংস্করণের মোড়ক উন্মোচন করা হয়।

যৌথ সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আজকে আমাদের দুজনের মধ্যে ফলপ্রসূ আলোচনা হয়েছে। দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিতে আমরা রাজি হয়েছি। তিস্তা চুক্তি, গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ, পানি ব্যবস্থাপনার সমস্যা সমাধানে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার প্রত্যাশা রয়েছে আমাদের।নরেন্দ্র মোদি বলেন, সহযোগিতার নতুন ক্ষেত্র দুই দেশের জনগণ বিশেষ করে তরুণদের মধ্যকার বন্ধনকে আরও জোরালো করবে। ভারত সব সময় বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে। তিনি আরও বলেন, সন্ত্রাস দমনে বাংলাদেশের জিরো টলারেন্স বা শূন্য সহনশীলতা নীতি ভারতের কাছে অনুপ্রেরণা।নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ (লাইন অব কনসেশনাল ক্রেডিট বা নমনীয় শর্তে ধারাবাহিক ঋণ) দেওয়ার ঘোষণা দেন। এর বাইরে পাঁচ শ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয় সামরিক খাতে। মোদি বলেন, এটা বাংলাদেশের চাহিদার ভিত্তিতে দেওয়া হবে।এর আগে সকালে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। সেখানে তাঁকে আনুষ্ঠানিক অভ্যর্থনা জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।

দুপুরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সম্মানে মধ্যাহ্নভোজের আয়োজন করেছেন নরেন্দ্র মোদি। বিকেলে শেখ হাসিনা দিল্লি সেনানিবাসের মানেকশ সেন্টারে মুক্তিযুদ্ধে আত্মোৎসর্গ করা ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সাত সদস্যের পরিবারের হাতে মুক্তিযুদ্ধ সম্মাননা তুলে দেবেন। তিস্তা চুক্তি শেখ হাসিনার এই সফরে না হলেও বাংলাদেশের কাক্সিক্ষত চুক্তিটির বিষয়ে নতুন আশা দেখিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।শনিবার নয়া দিল্লিতে শীর্ষ বৈঠকের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, দুই দেশের বিদ্যমান সরকারই এই জট খুলতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী।ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর হায়দ্রাবাদ হাউজে মোদীর এই ঘোষণার সময় উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও, যার কারণে দুই দেশের এই চুক্তি ঝুলে আছে ছয় বছর ধরে।তিস্তার জট কাটাতে নরেন্দ্র মোদীর উদ্যোগে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতাকে শীর্ষ বৈঠকের এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত করা হয়। খুলনা-কলকাতা বাস ও ট্রেন উদ্বোধনে তাকেও সঙ্গে রাখেন মোদী।২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সফরের সময় তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি সইয়ের কথা থাকলেও মমতার আপত্তিতে শেষ মুহূর্তে তা আটকে যায়।

এরপর মোদী ক্ষমতায় এসে এখনও তার জট খুলতে পারেননি।শনিবার মোদী বলেন, আমাদের প্রতিশ্র“তি এবং অব্যাহত প্রচেষ্টা সম্পর্কে আমি আপনাকে (শেখ হাসিনা) এবং বাংলাদেশের জনগণকে আশ্বস্ত করতে চাই।আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, আমার ও আপনার সরকারই তিস্তার পানি বণ্টন সমস্যার সমাধানে পৌঁছতে পারবে।তিস্তা চুক্তি ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ’ বলেও স্বীকার করে নেন মোদী।পশ্চিমবঙ্গ নিজেই পানি পাচ্ছে না অভিযোগ করে বাংলাদেশের সঙ্গে তিস্তা চুক্তি সম্পাদনে আপত্তি মমতার। কোনো পক্ষের ক্ষতি না করে তিস্তার সমাধানের উপায় খুঁজতে দিল্লিতে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আমলাদের মধ্যে একটি বৈঠক হয়েছে সম্প্রতি। শেখ হাসিনার সফরের আগে এই ধরনের উদ্যোগ মোদীর তৎপরতার ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

এদিকে, ইংরেজি ‘স্টেপ ডাউন’ কথাটির অর্থ কী হতে পারে? ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ‘স্টেপ ডাউন’ কথাটি বলে হাস্যরসের সৃষ্টি করেছেন অনুষ্ঠান সঞ্চালকদের একজন। শনিবার দুপুরে ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতে হায়দরাবাদ হাউসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদির যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার আগে এ ঘটনা ঘটে।নরেন্দ্র মোদি ও শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সামনে আনুষ্ঠানিক চুক্তি সই করেন। এরপর দুই নেতাকে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেওয়ার জন্য মঞ্চ থেকে একধাপ নামতে অনুরোধ করতে গিয়ে সঞ্চালকদের একজন বলে বসেন, ‘মে আই রিকোয়েস্ট দ্য টু প্রাইম মিনিস্টার্স টু নাউ প্লিজ স্টেপ ডাউন।’কথার অর্থ বুঝেই এরপর হাসতে শুরু করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী। হাসতে শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। হাসি থামতেই চায় না। প্রায় পুরো এক মিনিট ধরেই এ হাসির রেশ ছিল।

এদিকে, নয়া দিল্লিতে শীর্ষ বৈঠকে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে; এসেছে তিস্তা চুক্তি এগিয়ে আনাসহ সহযোগিতার নানা প্রতিশ্র“তিও।শনিবার ভারতের প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে শীর্ষ বৈঠকে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী দুই দেশের প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।প্রতিবেশী দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে গুরুত্বপূর্ণ যে সব ঘোষণা এসেছে-মোট ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই, এর মধ্যে দুই প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে চারটি চুক্তিপত্র বিনিময় হয়েছে। তৃতীয় লাইন অব ক্রেডিটের আওতায় বাংলাদেশকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ভারত। গত ছয় বছরে তা ৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হল।সামরিক কেনাকাটায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে ভারত।৩৬টি কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনে চুক্তি।আরও সীমান্ত হাট চালু করতে সমঝোতা স্মারক। বাংলাদেশের বিচার বিভাগের কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণে সমঝোতা স্মারক। কলকাতা-খুলনা-ঢাকা বাস চলাচল এবং খুলনা-কলকাতা ট্রেন চলাচল, রাধিকারপুর-বিরল রেললাইন উদ্বোধন।আরও ৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাংলাদেশকে দেবে ভারত। তিস্তা চুক্তির পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নরেন্দ্র মোদী বলেছেন, এই সমস্যা সমাধান একমাত্র আমাদের সরকারই পারবে। ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবসের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতিতে ভারতের সমর্থন পাওয়ার কথা জানিয়েছেন শেখ হাসিনা।দুই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদী যৌথভাবে বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনীর হিন্দি সংস্করণ উন্মোচন করেন। অনুষ্ঠানে নয়া দিল্লির পার্ক স্ট্রিট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রোড উদ্বোধন করেন তারা।