রাজশাহীর তানোরে নকশায় সংযোগ সড়কের স্থান না রেখেই প্রায় আড়াই কোটি টাকা ব্যয়ে খাড়ির ওপর ছয়টি সেতু নির্মাণ কাজের প্রকল্প অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। প্রকল্পের নির্মাণ কাজ সপ্তাহ দুয়েক আগে শুরু করেছেন সংশ্লিষ্ট ঠিকাদাররা। সংযোগ সড়ক ছাড়া শুধু সেতু নির্মাণ করায় স্থানীয়দের মধ্যে ক্ষোভ ও অসন্তোষ বিরাজ করছে। তাদের বক্তব্য, সড়ক ছাড়া সেতু নির্মাণ অর্থহীন। কারণ নির্মাণাধীন এসব ‘ভূতের সেতু’ স্থানীয় মানুষের কোন কাজে আসবে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার চারটি ইউনিয়ন পরিষদ এলাকায় খাড়ির ওপর ছয়টি সেতু নির্মাণে তালিকা প্রস্তুত করে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতরে পাঠানো হয় গত বছরের আগস্টে। তালিকা মোতাবেক নকশা অনুমোদন করে গত বছরের ৫ অক্টোবর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদফতর দরপত্র আহবান করে। ছয়টি সেতু নির্মাণে ব্যয় ধরা হয় ২ কোটি ৩১ লাখ ৪৬ হাজার ৬৮৯ টাকা। এর মধ্যে উপজেলার বাঁধাইড় ইউপির গাল্লা প্রকাশনগর এলাকায় খাড়ির ওপর ৬০ ফুট দৈর্ঘের সেতু নির্মাণ কাজে ৫৬ লাখ ৮৯ হাজার ১০৬ টাকা ব্যয় ধরা হয়।
একই পরিমাণ ব্যয়ে কলমা ইউনিয়নের বলদিপাড়া মোয়াতলা খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ।
এছাড়া কলমা ইউনিয়নের বংশিধরপুর খড়খড়ি ঘাটে খাড়ির ওপর ৩০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ কাজে ২৪ লাখ ৬৮ হাজার ৯১৫ টাকা ও রামনাথপুর গুটিংপাড়া হতে চকনাকা পর্যন্ত খাড়ির ওপর ৩৪ ফুট সেতু নির্মাণ কাজে ২৭ লাখ ৯৪ হাজার ২৫৬ টাকা ব্যয় ধরা হয়। অপরদিকে উপজেলার পাঁচন্দর ইউনিয়নের বনকেশর মরাপাড়ায় খাড়ির ওপর ৪০ ফুট সেতু নির্মাণ কাজে ৩২ লাখ ৫২ হাজার ৬৫৩ টাকা ব্যয় ধরা হয়। ওই একই পরিমাণ ব্যয়ে উপজেলার সরনজাই ইউনিয়নের বিল্লি খাড়ির ওপর মুকুলের জমির নিকট সেতু নির্মাণ প্রকল্প অনুমোদন দেয় কর্তৃপক্ষ। তবে কালভার্ট আকারের এসব সেতুর নির্মাণ ব্যয় দ্বিগুণ ধরা হয়েছে বলে উপজেলা এলজিইডি বিভাগ দাবি করছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এলজিইডি’র একজন কর্মকর্তা বলেছেন, প্রকল্পের অর্থ লোপাটের জন্যই সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে দ্বিগুণ অর্থ ব্যয়ে সেতুর নামে কার্লভাট নির্মাণ করা হচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, বাঁধাইড় ইউনিয়নের গাল্লা প্রকাশনগর খাড়ির ওপর ৬০ ফুট দৈর্ঘ্যরে সেতু নির্মাণ কাজ চলছে। সেতুটি নির্মাণ শুরু হলেও সংযোগ সড়ক নেই। সেতুর মাথায় রয়েছে ধান খেত। বোধগম্য কারণে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয় একাধিক বাসিন্দা জানান, এই সেতুটির পাশে দুইশ হাত দক্ষিণে ওই একই খাড়ির ওপর সেতু ও সড়ক রয়েছে। যে পরিমাণ টাকা দিয়ে অহেতুক সেতু নির্মাণ করা হচ্ছে তা দিয়ে এলাকার ভাঙা রাস্তা মেরামত করা যেত। এর ফলে মানুষ দুর্ভোগ থেকে রক্ষা পেত। এছাড়া সংযোগ সড়ক ছাড়াই সেতু নির্মাণ অর্থহীন। তাঁদের দাবি, একটি বিশেষ গোষ্ঠি লুটপাটের জন্যই শুধুমাত্র রাজনৈতিক ক্ষমতার অপব্যবহার করে এ ধরনের প্রকল্প ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে অনুমোদন নিয়ে সেতু নির্মাণ কাজ শুরু করেছে। একই অবস্থা কলমা ইউনিয়নের বলদিপাড়া মোয়াতলা খাড়ির ওপর সেতু নির্মাণ প্রকল্পে। এই সেতুর দুই পাশে বনবিভাগের বিপুলসংখ্যক ওষুধি ও বনগাছ রয়েছে। এছাড়া পাঁচন্দর ইউনিয়নের বনকেশর মরাপাড়া হতে বানিয়াল পর্যন্ত খাড়ির ওপর ৪০ ফুট সেতুর পাশে মরাখাল ও ধান খেত। এই সেতুর স্থানে নকশায় কোন সড়ক নেই। একই ধরনের অবস্থা সরনজাই ইউনিয়নের বিল্লি খাড়ির ওপর মুকুলের জমির নিকট সেতু নির্মাণ প্রকল্পে।
উপজেলার বনকেশর গ্রামের বাসিন্দা সাজেদুল ইসলামসহ অনেকেই বলেন, ‘সড়ক ছাড়া সেতু মূল্যহীন। কারণ সড়ক না থাকলে মানুষ সেতু ব্যবহার করতে পারবেন না। জমির আইল দিয়ে কৃষক ও কৃষিশ্রমিক হাঁটেন। তাই সেতু নির্মাণ করা হলেও, তা মানুষের কাজে আসবে না।’ একই ধরনের মন্তব্য করেন উপজেলার সরনজাই গ্রামের জালাল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেতু নির্মাণের অজুহাতে সংশ্লিষ্ট অফিসের কর্মকর্তা এবং ঠিকাদাররা সরকারি অর্থ আতœসাতের চেষ্টা করছেন। এ প্রকল্প সাধারণ মানুষের কোন কাজে আসবে না।’ এ ব্যাপারে তানোর উপজেলা প্রকৌশলী আব্দুল্লাহ আল মামুন ও সংযোগ সড়ক দেখাভালের দায়িত্বে থাকা তানোর উপজেলা সহকারী প্রকৌশলীর সাথে প্রতিবেদক একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁরা কোন সদুত্তর দেননি। তবে এ প্রসঙ্গে উপজেলা নির্বাহী অফিসার মুহা: শওকাত আলী সাংবাদিকদের বলেন, ‘এসব কাজের নকশা সংশ্লিষ্ট দফতর থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়ে থাকে। তিনি কেবল মাত্র দেখভালের দায়িত্বে রয়েছেন। কোন ঠিকাদার কাজে অনিয়ম করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ তবে সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য প্রস্তুতি চলছে বলে জানান তিনি।
উল্লেখ্য; এরআগে বিগত ২০০৬ সালে চারদলীয় জোট সরকারের সময়ে তানোর উপজেলার চাঁন্দুড়িয়া ইউনিয়নের দেওতলা হামিরপুর খালের ওপর প্রায় ১৬ লাখ ১৫ হাজার ৫৫৩ টাকা ব্যয়ে সর্ম্পূণ রাজনৈতিক বিবেচনায় নির্মিত হয় একটি সেতু। নির্ধারিত সময়ে ওই সেতুটি সম্পন্ন হবার আগেই তৎকালিন সময়ের ডাক টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক উদ্বোধন তা করেন। এরপর থেকে সংযোগ সড়কের অভাবে সেতুটি দাঁড়িয়ে আছে ১০ বছর। একইভাবে ২০০৫-০৬ অর্থবছরে তানোরে শিব নদীর ওপর ২১৬ মিটার দৈর্ঘ্য একটি সেতু নির্মাণ শুরু করে এলজিইডি, যা শেষ হয় ২০১২ সালে। এর পর এ সেতুর দুই পাশে নির্মাণ করা হয় সংযোগ সড়ক। কিন্তু নির্মাণের পর তিন দফা ভেঙে পড়ে এ সংযোগ সড়ক। জানা যায়, সেতুটি নির্মাণ করা হয়েছে ভুল নকশায়। ফলে সংযোগ সড়কের কারণে সেতুটি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে এখন। এ সেতুটি কবে নাগাদ চলাচলের উপযোগী করা হবে, তাও বলতে পারছে না সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা।
মিজানুর রহমান, তানোর (রাজশাহী) প্রতিনিধি