নাম তার ইমদাদুল হক সোহাগ। তিনি বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষর (এনটিআরসিএ) ঢাকা অফিসের ডাটা এন্ট্রি অপারেটর। এখন সাময়িকভাব বরখাস্ত। বাড়ি ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার তৈলকুপ গ্রামে। পিতা আব্দুল মতিন বিশ্বাস পাতা ছিলেন গাছের চারা বিক্রেতা। বাজারে বাজারে ভ্যানে করে গাছের চারা বিক্রি করে বেড়াতেন। অথচ নিম্নবিত্ত পরিবারের ছেলে সোহাগ হোসেন মাত্র ৭ বছরে কোটিপতি হয়ে এলাকাবাসিকে চমকে দিয়েছেন। সোহাগ এখন প্রাডো গাড়িতে ঘুরে বেড়ান। হাটে হাটে নার্সারীর চারা বিক্রেতা আব্দুল মতিন ছেলের কারণে এখন এলাকায় পাতা মিয়া নামে পরিচিত পেয়েছেন।
উপজেলায় কোন অনুষ্ঠান হলে প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধি সবাই পাতা মিয়াকে আমন্ত্রন জানিয়ে থাকেন। নিজ গ্রাম তৈলকুপে ২০ লাখ টাকা ব্যায় করে দুই কিলোমিটার পাকা রাস্তা পাকা করেছেন। গত ২০ জুন পাতা মিয়ার ব্যক্তিগত টাকায় নির্মিত গাজীপাড়া ইউসুফ আলী সড়কের শুভ উদ্ভোধন করেন স্থানীয় সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজিম আনার। কালীগঞ্জের নলডাঙ্গায় ২২ বিঘা জমিার উপর করেছেন রিসোর্ট সেন্টার। নলডাঙ্গা নদীর ধারে ও মাঠে একবারে কিনেছেন ১৮ ঘিা জমি। যশোরের খাজুরা রোডে চার বিঘা জমি কিনেছেন সোহাগ। একই শহরে রয়েছে ৭ তলা বাড়ি। ঝিনাইদহ কালীগঞ্জ সড়কের নৃশিংহপুরে কায়েক কোটি টাকা দিয়ে তেল পাম্প করেছেন।
ছালাভরা এলাকায় রয়েছে ইটভাটা। এ ছাড়া দক্ষিনাঞ্চলে রয়েছে নামে বেনামে কোটি কোটি টাকার জমি। ঢাকার শ্যামলীতে ফ্ল্যাট থাকার পরও ধানমন্ডিতে আড়াই কোটি টাকা দিয়ে আরেকটি ফ্ল্যাট কিনেছেন সোহাগ। ঈশ্বরদীর মসু–ড়ি পাড়ায় সোহাগ তার শ্বশুর আব্দুস সাত্তার মৃত্যু বরণ করলে শ্বাশুড়ি মিলি সাত্তারের কাছ থেকে জমি নিয়ে ৮ কাঠার উপর স্ত্রীর নামে ৭ তালা দৃষ্টি নন্দন আলীশান বাড়ি তৈরী করে দিয়েছেন। কালীগঞ্জের খয়েরতলায় ৬০ শতক জমি কিনেছেন তিনি। এলাকাবাসি তার এই টাকার উৎস সম্পর্কে জানেন না। সোহাগের কারণে তার পিতার রাতারাতি ধনকুবের হওয়ার ঘটনায় জনমনে নানা প্রশ্ন জন্মেছে। প্রশ্ন উঠেছে কি তার ব্যবসা ? কোথায় পাচ্ছেন কাড়ি কাড়ি টাকা ?
অনুসন্ধান করে জানা গেছে, ২০০১ সালের দিকে কালীগঞ্জ উপজেলার তৎকালীন নির্বাহী কর্মকর্তা সুশেন চন্দ্র রায়ের কাছে গাছের চারা বিক্রির সুত্র ধরে পরিচয় হয় আজকের ধনকুবের ইমদাদুল হক সোহাগের পিতা আব্দুল মতিনের। ইউএনও সুশেন চন্দ্র কালীগঞ্জ উপজেলা চত্বরে বণায়ন করার দায়িত্ব দেন সোহাগের পিতাকে। আব্দুল মতিনের কাজে খুশি হন সুশেন চন্দ্র। এক সময় ইউএনও সুশেন চন্দ্র রায় এনটিআরসিএ তে বদলী হন। বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) তে নিয়োগ কিজ্ঞপ্তি দিলে সুশেন চন্দ্র আব্দুল মতিনের ভবঘুরে ছেলে সোহাগ হোসেনকে তৃতীয় শ্রেনীর পদ মর্যাদায় ডাটা এন্ট্রি অপারেটর পদে চাকরী দেন।
২০০৯ সালের সেপ্টম্বর মাসে যোগদান করেন সোহাগ। চাকরী পাওয়ার পর থেকেই সোহাগের পিতা ফুলেফেপে উঠতে থাকেন। কয়েক বছরে তিনি কোটিপতি বনে যান। প্রাপ্ত তথ্যে জানা গেছে, সারা দেশের শিক্ষক নিবন্ধনের ফলাফল প্রকাশ তৈরী করে তা ওয়েবসাইটে দেওয়ার কাজটি করতেন সোহাগ। এ পর্যন্ত সোহাগ ১১টি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষার কাজ নিজ হাতে করেছেন। মোটা অংকের টাকা নিয়ে অকৃতকার্য শিক্ষকদের পাশ করানোর অনৈতিক কাজটি করতেন সোহাগ। শিক্ষক প্রতি ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা নিয়ে সোহাগ ফলাফল সিট তৈরী করে ওয়েব সাইটে দিতেন। আর এ ভাবেই তিনি রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়েছেন। সোহাগের কাছে শিক্ষক নিবন্ধন করতে দেওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন শিক্ষক জানান, প্রতিটি শিক্ষক নিবন্ধন থেকে তার আয় ৫/৬ কোটি টাকার উপরে।
গত ১১ টি শিক্ষক নিবন্ধন থেকে সোহাগ ৫০ কোটি টাকার উপরে আয় করেছেন। দুই বছর আগেও সোহাগ নিবন্ধন করার নামে ঝিনাইদহসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের ১৩’শ শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এর মধ্যে ঝিনাইদহের ৫৯৮ জন শিক্ষক রয়েছে। কথিত আছে ঝিনাইদহ শহরের ওরাকল কোচিং সেন্টারের মালিক বিপুল ভট্রাচার্য ৭৬ জন শিক্ষক, কাজল ও শামসুল ইসলাম ৩৬ জন, কোটচাঁদপুরের রাম প্রসাদ ৫৬ জন, ঝিনাইদহের সুপার শরিফুল ইসলাম ৭০ জন, কালীগঞ্জ শহরের ফরিদ ২৫০ জন এবং জলিল হুজুর ১১০ জন শিক্ষককে নিবন্ধন করানোর জন্য সোহাগের কাছে টাকা দিয়েছেন। যশোর আব্দুর রাজ্জাক কলেজের জিয়া নামে এক শিক্ষক দিয়েছেন প্রায় ৫ কোটি টাকার উপরে। তবে চাকরী থেকে বরখাস্ত থাকায় ২০১৫ সালে শিক্ষন নিবন্ধনের প্রথম ফলাফলটি করার পর থেকে সোহাগের মিশন ব্যার্থ হয়েছে।
এদিকে সোহাগের কাছ থেকে টাকা ফেরৎ নিতে এজেন্টরা প্রতিনিয়ত তার তৈলকুপ গ্রামে জড়ো হচ্ছেন। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, সোহাগের কাছে দেশের বড় বড় ১০ জন এজেন্ট সরাসরি টাকা দিতের শিক্ষক নিবন্ধন করার জন্য। এছাড়া দেশের বিভিন্ন প্রন্তের শাতাধিক শিক্ষক নিবন্ধন করার জন্য টাকা দিয়েছেন। এ সব টাকা কালীগঞ্জের একটি ইটভাটায় লগ্নি করা হয়েছে বলেও কথিত আছে। সপ্তাহ ব্যাপী কালীগঞ্জের তৈলকুপ গ্রামে অনুসন্ধান করে জানা গেছে, নিবন্ধন না হওয়া শিক্ষক ও এজেন্টরা তার গ্রামের বাড়িতে সোহাগ, তার পিতা আব্দুল মতিন পাতা, চাচা জয়নুদ্দীন মেম্বর ও ময়নুদ্দীনের কাছে ধর্না দিচ্ছেন।
এক মাদ্রাসা শিক্ষক পরিচয় গোপন করে জানান, তিনি কোটি টাকার উপরে সোহাগকে দিয়েছেন। এখন তিনি আরে ২১ লাখ টাকা পাবেন। তিনি আরো জানান, তার মতো কালীগঞ্জের শামছুল ইসলাম, বিপুল, রামপ্রসাদ, মোশাররফসহ বহু শিক্ষক টাকার জন্য ধর্না দিচ্ছেন। কিন্তু টাকা না দিয়ে দিনের পর দিন ঘুরাচ্ছেন। এখন যশোর শহরের বাসটার্মিনালের পাশের জমি বিক্রি করে টাকা দিবেন বলে সর্বশেষ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে তিনি ব্যাংকের থেকে ঋন নিয়ে যশোর আব্দুর রাজ্জাক কলেজের এক শিক্ষককে টাকা দিয়েছেন বলে কথিত আছে। সোহাগ ও তার বাবা জমি বিক্রি বা ব্যাংক থেকে ঋন নিয়ে শিক্ষক নিবন্ধনের টাকা ফেরৎ দেবার পথ খুজছেন বলেও নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই শিক্ষক জানান।
ঝিনাইদহ সদর উপজেলার আড়মুখ গ্রামের এক শিক্ষক জানান, তিনিও ৮ লাখ টাকা পাবেন। কিন্তু তাকে টাকা না দিয়ে হয়রানী করা হচ্ছে। মাগুরার শ্রীপুর উপজেলার কোটবাগ গ্রামের আব্দুর রাজ্জাক ও আলাউদ্দীন নামে দুই শিক্ষক নলডাঙ্গা বাজারে বাজারে দেখা হলে জানান, তারাও প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা পাবেন। নলডাঙ্গা ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের হারুন এক সময় সচ্ছল মানুষ ছিলেন। তিনি সোহাগের বাবা পাতা মিয়ার কাছে একজন শিক্ষকের জন্য টাকা দেন। পরে পাতা মিয়া অস্বীকার করলে তার ভিটেবাড়ি বিক্রি করে ওই শিক্ষকের টাকা পরিশোধ করেন।
হারুন এখন হাটে হাটে সুপারি বিক্রি করে বেড়ান। কালীগঞ্জের জামালা ইউনিয়ন ভুমি অফিস সুত্রে বলা হয়েছে, ৪/৫ বছর আগেও তার ৭/৮ বিঘা জমি ছিল। এখন তার সম্পদের হিসাব নেই। ঝিনাইদহ ইসলামী ব্যাংক থেকে সোহাগের পিতা দুই কোটি টাকার জমি মডগেইজ রেখে ৪৫ লাখ টাকা ঋন নিয়েছেন। ্এখন প্রশ্ন উঠেছে সামান্য গাছের চারা বিক্রেতা পাতা মিয়া ফিলিং স্টেশনের জন্য এই দুই কোটি টাকা কোথায় পেলান ? সোহাগের কর্মকান্ড নিয়ে নিজ গ্রাম বা এলাকার কেও মুখ খুলতে সাহস পায়নি। সবাই তার ক্যাডার বাহিনীর ভয়ে তটস্থ থাকেন। তৈলকুপ গ্রামের এক বাসিন্দা আক্ষেপ করে বলেন, এতো দিন পুকুর চুরি, সাগর চুরির গল্প শুনেছি। কিন্তু সোহাগ ও তার বাবার মহাসাগর চুরির গল্প যেন কল্প কাহিনীকেও হার মানায়।
এ বিষয়ে নলডাঙ্গা ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মলীগের সাধারণ সম্পাদক রবিউল ইসলাম রবি জানান, সোহাগ বহু শিক্ষকের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন বলে শুনেছি। আমার কাছে এমন বহু শিক্ষক অভিযোগও করেছেন। আমি তাদের টাকা আদায় করে দিতে পারতাম, কিন্তু শিক্ষকরা অভিযোগ দিয়ে আর শক্ত হয়ে দাড়িয়ে থাকতে পারেনি। কালীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামীলীগ সম্মেলন প্রস্তুত কমিটির যুগ্ম আহবায়ক মতিয়ার রহমান মতি বলেন, সবার মতো আমারও সেই একই প্রশ্ন কি ভাবে পাতা মিয়া ও তার ছেলে এতো অঢেল সম্পদের মালিক হলো? কি তাদের আয় ইনকাম এটা তদন্ত হওয়া দরকার আছে।
বিষয়টি নিয়ে বেসরকারী শিক্ষক নিবন্ধন ও প্রত্যায়ন কর্তৃপক্ষ (এনটিআরসিএ) এর চেয়ারম্যান এ এমএম আজাহারের সাথে কথা বলতে তার অফিসের ল্যান্ড টেলিফোনে ফোন করা হলে ইমদাদুল হক সোহাগকে নিয়ে কেও কথা বলতে রাজি হয়নি। এ ব্যাপারে ইমদাদুল হক সোহাগ তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, তার কাছে কেও টাকা পাবে না। শিক্ষক নিবন্ধনের নামে তিনি কোন টাকা নেন নি।
স্টাফ রিপোর্টার,ঝিনাইদহ