খুলনায় শিশু রাকিব হাওলাদার হত্যা মামলায় দুই আসামি শরীফ মোটরসের মালিক ওমর শরীফ ও তাঁর সহযোগী মিন্টুর মৃত্যুদন্ড পরিবর্তন করে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেন সেলিম ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এই রায় ঘোষণা করেন।রায়ে দুই আসামিকে ৫০ হাজার টাকা করে অর্থদন্ড দিয়েছেন আদালত।জরিমানার এই অর্থ রাকিবের পরিবারকে দিতে হবে। অন্যথায় দুই আসামিকে আরও দুই বছর করে কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।আদালত বলেছেন, আসামিদের মধ্যে রাকিবকে বাঁচানোর প্রবণতা দেখা গেছে। তাঁরা রাকিবকে নিয়ে হাসপাতালে গেছেন। আসামিদের বিরুদ্ধে অতীতে কোনো ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড পাওয়া যায়নি।
এসব দিক বিবেচনা ও নথি পর্যালোচনা করে দুই আসামির মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায় দেন হাইকোর্ট। ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদন্ড অনুমোদন) এবং আসামিদের আপিল ও জেল আপিল খারিজ করে এই রায় দেওয়া হয়। বিচারক বলেন, আমরা চেষ্টা করেছি, দুই পক্ষের তথ্য-প্রমাণ বিচার করে যথার্থ রায় দেওয়ার। যারা অফেন্ডার, তাদের মধ্যে ভিকটিমকে বাঁচানোর একটা চেষ্টা ছিল। এটা তথ্য প্রমাণে এসেছে।রায়ে বলা হয়, জরিমানার অর্থ রাকিবের পরিবারকে দিতে হবে। তা না হলে দুই আসামিকে আরও দুই বছর করে কারাদন্ড ভোগ করতে হবে।তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় রাকিবের বাবা নূরুল আলম হাওলাদার এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করেছেন। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার কথা বলেছেন তিনি।
আসামিপক্ষের আইনজীবীরাও আপিল করবেন বলে জানিয়েছেন। তাদের ভাষায়, হাই কোর্টের রায়ে তারা আংশিক ন্যায়বিচার পেয়েছেন।১২ বছর বয়সী রাকিব এক সময় খুলনা নগরীর টুটপাড়া কবরখানা মোড়ে শরীফের মোটর ওয়ার্কশপে কাজ করত। কাজ ছেড়ে দেওয়ায় ক্ষিপ্ত হয়ে ২০১৫ সালের ৩ অগাস্ট তাকে হত্যা করেন শরীফ ও তার দূর সম্পর্কের চাচা মিন্টু। ওই ওয়ার্কশপে আটকে মোটরসাইকেলে হাওয়া দেওয়ার কমপ্রেসারের মাধ্যমে মলদ্বারে বাতাস ঢোকানো হলে রাকিবের পেটের ভেতরের নাড়ি, মলদ্বার, মুত্রথলি ফেটে রক্তক্ষরণে তার মৃত্যু হয়।বর্বর ওই ঘটনায় সারা দেশে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালত ওই বছরই ১৮ নভেম্বর শরীফ মোটর্সের মালিক ওমর শরীফ ও মিন্টুর ফাঁসির রায় দেয়।বিচারিক আদালতের সেই মৃত্যুদন্ডাদেশের অনুমোদন এবং আসামিদের করা আপিলের শুনানি শেষে মঙ্গলবার হাই কোর্ট দুই আসামির সাজা কমানোর সিদ্ধান্ত জানায়।রায়ের পর এ আদালতের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল জহিরুল হক জহির বলেন, ঘটনার পর আসামিরা রাকিবকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলেন, তাকে হাসপাতালে নিয়ে গেছিলেন। এসব বিবেচনায় আদালত দুই আসামির সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন দিয়েছেন।এই রায়ে সন্তুষ্ট কি না জানতে চাইলে রাষ্ট্রের এই আইন কর্মকর্তা বলেন, এটা সন্তুষ্টি-অসন্তুষ্টির বিষয় না। রায়ের কপি পেলে বিচার বিশ্লেষণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেব।
রাকিবের পরিবারের পক্ষে হাই কোর্টে এ মামলা লড়েন বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার অ্যাডভোকেট সালমা সুলতানা।রায়ের পর তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পায়ুপথে বাতাস ঢোকালে যে কোনো মানুষের মৃত্যু হবে এটা কমন সেন্সের বিষয়। তারা দেখেছে যে রাকিবের পেট ফুলে যাচ্ছিল।আদালত একদিকে বলেছেন, এটা নিষ্ঠুর-অমানবিক; আবার অন্যদিকে বলেছেন, আসামিরা রাকিবকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিল। আদালতের এমন বক্তব্য সাংঘর্ষিক। আমরা এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।আসামি শরীফের আইনজীবী গোলাম মো. চৌধুরী আলাল রায়ের পর সাংবাদিকদের বলেন, আমরা আংশিক ন্যায়বিচার পেয়েছি। এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করব।এর ব্যাখ্যায় তিনি বলেন, রাকিবের মৃত্যু ছিল অনিচ্ছাকৃত, তাকে হত্যার কোনো পরিকল্পনা ছিল না। ঘটনার পর আসামিরা পালানোর চেষ্টা করেনি, ভিকটিমকে হাসপাতালে নিয়ে গেছে, রক্ত দিয়েছে।শরীফের মা বিউটি বেগমকেও এ মামলার অভিযোগপত্রে আসামি করা হয়েছিল। তবে অপরাধে জড়িত থাকার প্রমাণ না পাওয়ায় তাকে খালাস দেয় জজ আদালত।আসামিদের ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর গত ২৯ মার্চ হাইকোর্টে শুনানি শেষ হয়। এরপর রায় ঘোষণার জন্য ৪ এপ্রিল (আজ) তারিখ ধার্য করেছিলেন আদালত।২০১৫ সালের ৮ নভেম্বর বিচারিক আদালতের রায়ে এই মামলায় ওমর শরীফ ও তাঁর সহযোগী মিন্টুকে মৃত্যুদন্ডাদেশ দেওয়া হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। পাশাপাশি আসামিদের মৃত্যুদন্ড অনুমোদন (ডেথ রেফারেন্স) শুনানির জন্য হাইকোর্টে আসে।বিচারিক আদালতের রায় ঘোষণার ১৪ মাসের মাথায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উচ্চ আদালতে ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিলের ওপর গত ১০ জানুয়ারি শুনানি শুরু হয়। আজ রায় ঘোষণা করা হলো।
২০১৫ সালের ৩ আগস্ট বিকেলে খুলনার টুটপাড়ায় শরীফ মোটরস নামে এক মোটরসাইকেলের গ্যারেজে মলদ্বারে কম্প্রেশার মেশিনের মাধ্যমে বাতাস ঢুকিয়ে রাকিবকে হত্যা করা হয়। পরের দিন রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম বাদী হয়ে গ্যারেজ মালিক শরীফ, শরীফের সহযোগী মিন্টু ও মা বিউটি বেগমের বিরুদ্ধে সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলার ৯৬ দিনে বিচারপ্রক্রিয়া শেষে একই বছরের ৮ নভেম্বর রায় দেন খুলনা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক।বিচারিক আদালতের রায়সহ মামলার নথিপত্র ওই বছরের ১০ নভেম্বর হাইকোর্টে এসে পৌঁছে এবং ডেথ রেফারেন্স হিসেবে নথিভুক্ত হয়। প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত হয় ও হাইকোর্টের সংশ্লিষ্ট বেঞ্চে শুনানির জন্য আসে।
এদিকে, ছোট বাড়িটির সামনের ছোট গলিপথে বেশ খানিকটা জটলা। সেই জটলা ঠেলে বাড়ির ভেতরে ঢুকতেই দেখা গেল, বুক চাপড়ে আহাজারি করছেন রাকিবের মা লাকি বেগম। ঘরের মধ্যে চলা টিভির স্ক্রলে দেখানো হচ্ছে, শিশু রাকিব হত্যা মামলার দুই আসামির মৃত্যুদন্ডের পরিবর্তে যাবজ্জীবন কারাদন্ডের রায়ের খবর।এই খবর শুনে মা কখনো নির্বাক। আবার কখনো মূর্ছা যাচ্ছিলেন। মাঝে মাঝে বলছিলেন, বাবা, তোর যারা মারি ফেলিল, তারা বুধায় পার পায়ে গেল রে। কাঁদছেন রাকিবের বাবা মো. নুরুল আলম ও বোন রিমি।কান্নাজড়িত কণ্ঠে বাবা নুরুল আলম বলেন, আমার ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসির দাবিতে মানুষ মানববন্ধন করেছে। নিম্ন আদালতে ফাঁসির রায়ের পর সবাই খুশি হয়েছিল। কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, রায় বহাল রাখা গেল না। আমরা গরিব বলে কী বিচারটা এমন হলো!বাবা বলেন, তিনি সন্তানের স্মৃতি এখনো ভুলতে পারেন না। বৃহস্পতিবার এলে কেউ বলে না, বাবা, জামাকাপড়গুলো ধুয়ে দাও। গত বছর যখন ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসির রায় হয়েছিল, তখন থেকে আল্লাহর কাছে চাইছিলেনÑএই রায়ই যেন বহাল থাকে। আক্ষেপ করে বলেন, ‘তা আর হলো কই?হতাশার পাশাপাশি পরিবারের নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কিত বাবা নুরুল আলম। তিনি বলেন, জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৫ শতক খাস জমি পেয়েছি। ইচ্ছে ছিল হাইকোর্টের রায়ের পর মেয়েটাকে নিয়ে ওই জায়গায় একটা ঘর বানিয়ে থাকতে পারব। কিন্তু দুদিন পর তো ওরা বের হয়ে আসবে। আমার মেয়েটা বড় হচ্ছে। আমাদের জীবনের গ্যারান্টি দেবে কে? দুপুরবেলা বাড়ি থেকে জ্যান্ত ছেলে গেল, লাশ হয়ে ফিরল। ওদের ওপর কোনো বিশ্বাস আছে!এই রায়ের বিরুদ্ধে আইনি লড়াইয়ে যাওয়ার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, আইনজীবীর সঙ্গে কথা হয়েছে। আমরা এই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাব। এখনো আশা ছাড়িনি। সুপ্রিম কোর্ট ফাঁসির রায় বহাল রাখবে বলে বিশ্বাস করি। রাকিবের ছোট বোন রিমি আক্তার কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘আমার ভাইকে যারা মেরেছে, তাদের ফাঁসি বদলে সাজা কমানো হয়েছে। এটা ভীষণ কষ্টের। কাদঁতে কাদঁতে বারবার মূর্ছা যাচ্ছিলেন রাকিবের মা লাকী বেগম। রাকিব হত্যা মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থার খুলনার সমন্বয়ক মোমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আদালত এই রায়ের পর্যবেক্ষণে বারবার বলেছেন রাকিব হত্যা মামলা একটি নৃশংস ঘটনা। গত ১০০ বছরের ইতিহাসে এমনটা হয়নি। এই ঘটনায় আদালত নিন্দা জানিয়েছেন। একই সঙ্গে মানবিক দিক বিবেচনায় আসামিদের মৃত্যুদ- কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। এই রায়ে আমরা অসন্তুষ্ট। এই রায় একটি পরস্পরবিরোধী (কন্ট্রাডিক্টরি) রায়। এই রায়ে আমরা সংক্ষুব্ধ হয়ে মৃত্যুদন্ড বহাল রাখার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টে রিভিউ করব।এই রায়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন খুলনার অনেক সাধারণ মানুষ। এমনই একজন খুলনার টুটপাড়া এলাকার গোলাপ হোসেন। তিনি বলেন, উচ্চ আদালতের রায়ে আমরা হতাশ হয়েছি। আমরা সবাই চেয়েছিলাম রাকিব হত্যার মতো পৈশাচিক ঘটনার হোতাদের ফাঁসি বহাল থাকুক।