ক্রমবর্ধমান হারে বেড়েই চলেছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ। প্রতি মাসেই বাড়ছে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগ। ভেঙে যাচ্ছে আগের সব বিক্রি রেকর্ড। ব্যাংকের আমানতের তুলনায় সুদহার বেশি হওয়ায় এবং নিরাপদ হওয়ায় এ খাতেই মানুষ সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন। ফলে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরের আট মাসে (জুলাই-ফেব্র“য়ারি) সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি (বিনিয়োগ) দাঁড়িয়েছে ৩৩ হাজার ২৮২ হাজার কোটি টাকা। যা পুরো অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১৩ হাজার ৬৭২ কোটি টাকা বা ৬৯ দশমিক ৭১ শতাংশ বেশি। আর আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় বিক্রি বেড়েছে ১৩ হাজার ৩৯২ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা ঋণ।

সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে উচ্চ সুদহারে সাধারণ মানুষদের মধ্যে স্বস্তি এলেও, সরকারের ঋণের বোঝা বেড়েই চলেছে। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তাদের কেউ সঞ্চয়পত্রের সুদহার কমানোর পক্ষে মত দিলেও অনেকে বলছেন, মূলত স্বল্প এবং নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরাই নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করে থাকেন। তাই এ খাতে সুদের হার না কমিয়ে মিস ইউস হচ্ছে কিনা অর্থাৎ সামর্থ্যবান মানুষরাও এ খাতে বিনিয়োগ করছে কিনা সেটা সরকার নজরদারি করতে পারেন। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যাংকের তুলনায় সুদহার বেশি হওয়ায় এবং কোনো ধরনের ঝুঁকি না থাকায় বর্তমানে সঞ্চয়পত্রে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করছেন গ্রাহকরা। আর এক্ষেত্রে সাধারণত স্বল্প ও নির্দিষ্ট আয়ের মানুষরাই এ খাতে বেশি বিনিয়োগ করে থাকেন। তাই কোনোভাবেই এর সুদহার কমানো ঠিক হবে না বলে মত দেন তিনি। এ খাত থেকে সরকারের ঋণ বেশি হলে সুদ পরিশোধের দায়ও বেশি হবে। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সরকার তো জনগণের করের টাকা থেকেই এই সুদ পরিশোধ করবে, যেটা কিনা জনগণের কল্যাণেই ব্যয় হবে। তাই সুদহার না কমিয়ে এর অপব্যবহার হচ্ছে কিনা সে বিষয়ে সরকারের নজরদারি বাড়াতে পারে।

একই বিষয়ে বিআইডিএসের গবেষণা পরিচালক জায়েদ বখত বলেন, ব্যাংকে আমানতের সুদের হার ক্রমাগত কমতে থাকায় সাধারণ মানুষ তাদের সঞ্চিত অর্থ বিনিয়োগের জন্য সঞ্চয়পত্র ছাড়া আর কোনো লাভজনক বিকল্প পাচ্ছে না। ফলে সঞ্চয়পত্রের বিক্রি অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাচ্ছে, বাড়ছে সরকারের ঋণের বোঝা। এতে সরকারের রাজস্ব বাজেটের ওপর চাপ পড়ছে। এ থেকে বেরিয়ে আসতে না পারলে বাজেট ব্যবস্থাপনা ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। আর সঞ্চয়পত্র থেকে বিপুল ঋণের চাপে সরকার বাজেট ব্যবস্থাপনায় যে ঝুঁকির মধ্যে পড়তে যাচ্ছে, তা এড়ানোর জন্য ব্যাংক ব্যবস্থা ও সঞ্চয়পত্রের সুদহারে সমন্বয় আনা দরকার। এক্ষেত্রে অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তাদের পেনশন’ এবং নারীদের জন্য পরিবার সঞ্চয়পত্র ছাড়া অন্য সব সঞ্চয়পত্রের সুদের হার দ্রুত কমানোর পক্ষে মত দেন তিনি।

অন্যদিকে, দায় বেশি হলেও সঞ্চয়পত্র থেকেই ঋণ নিতে চায় সরকার। এই অর্থবছরে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ নেয়া হবে ২৮ হাজার কোটি টাকা, আর স্বল্পমেয়াদি ঋণ ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থবছরের সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি) তফসিলি ব্যাংকগুলো থেকে সরকারের নেয়া ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ঋণাত্মক (-) ২০ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা। এ সময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নেয়া ঋণও পরিশোধ করেছে সরকার।সঞ্চয় অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, সর্বশেষ ফেব্র“য়ারি মাসে বিক্রি হয়েছে ৪ হাজার ৩৮৮ কোটি টাকার সঞ্চয়পত্র, জানুয়ারিতে এই বিক্রির পরিমাণ ছিল ৫ হাজার ৪২০ কোটি টাকা। এছাড়া চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে নিট সঞ্চয়পত্র বিক্রির পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৪৯৮ কোটি টাকা, আগস্ট মাসে নিট বিক্রি ৪ হাজার ২৯৭ কোটি টাকা, সেপ্টেম্বরে বিনিয়োগ আসে ৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা, অক্টোবরে ৪ হাজার ৩২৩ কোটি টাকা, নভেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ ৪ হাজার ৪০২ কোটি এবং ডিসেম্বর মাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ হয় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা।এদিকে চলতি ২০১৬-১৭ অর্থবছরে সরকার সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১৯ হাজার ৬১০ কোটি টাকা। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের মূল বাজেটে এই লক্ষ্য ছিল ১৫ হাজার কোটি টাকা। বিক্রি বাড়ায় সংশোধিত বাজেটে তা প্রায় দ্বিগুণ বাড়িয়ে ২৮ হাজার কোটি টাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু অর্থবছর শেষে নিট বিক্রি তার চেয়েও ৫ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকা বেড়ে ৩৩ হাজার ৬৮৮ কোটি টাকায় পৌঁছায়।

এদিকে, বিনিয়োগে মন্দার কারণে বেশ কিছুদিন ধরেই ব্যাংকগুলোতে বিপুল অংকের অর্থ পড়ে আছে, যাকে ‘অলস অর্থ’ বলা হচ্ছে। এই অলস অর্থের কারণে আমানতের সুদ হার কমিয়েই চলেছে ব্যাংকগুলো। বর্তমানে স্থায়ী আমানতের বিপরীতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো গড়ে ৬ থেকে ৭ শতাংশ হারে সুদ দিচ্ছে, যা সঞ্চয়পত্রের সুদের তুলনায় অনেক কম। ২০১৫ সালের মে মাসে সব ধরনের সঞ্চয়পত্রের সুদ গড়ে ২ শতাংশ হারে কমানোর পরও ১১ থেকে ১২ শতাংশ পর্যন্ত সুদ পাওয়া যায়। তাই সুদ হার কমিয়েও বিক্রির প্রবণতা সরকার কমাতে পারেনি।