আবাসন সঙ্কটের কারণে জামালপুরের হরিজন সম্প্রদায়ের প্রায় একশ পরিবার এক কক্ষেই একাধিক সদস্য নিয়ে বসবাস করে আসছেন। বসবাস করা এসব বিল্ডিংগুলোর মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই, সংস্কারের কোনো উদ্যোগ না নেয়ায় মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে এখানে বাস করছে হরিজনরা।বছরের পর বছর নোংড়া পরিবেশ আর ভাঙাচোরা ঘরে এসব পরিবারের সদস্যরা মানবেতর জীবনযাপন করলেও নিরসনের উদ্যোগ নেই পৌর কর্তৃপক্ষের।
১৮৬৯ সালে জামালপুর পৌরসভা স্থাপনের পরপরই শহর পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন কাজে নিয়োজিত সুইপারদের আবাসন সমস্যা সমাধানে শহরের বজ্রাপুরে সুইপার কলোনি গড়ে তোলে পৌর কর্তৃপক্ষ। এই কলোনিতে দিন দিন জনসংখ্যা বাড়লেও গত দেড়শ বছরে বাড়েনি একটি ঘর কিংবা এক ইঞ্চি জমি।বর্তমানে কলোনিতে ৯৬টি পরিবারে প্রায় পাঁচ শতাধিক লোক বসবাস করছে। কলোনিতে রয়েছে ছোট ছোট ১৯টি সেমিপাকা ঘর ও ১৭টি রান্না ঘর। প্রতিটি ঘরে ৫ থেকে ৬টি পরিবার গাদাগাদি করে বাস করছে। তাতেও জায়গা সঙ্কুলান না হওয়ায় দিনের বেলা রান্না শেষে সেখানেই ঘুমিয়ে রাত কাটায় হরিজনরা।ভবনের ছাদ ও দেয়ালের আস্তর খসে খসে পড়ছে, যে রান্না ঘরে হরিজনরা থাকছে সেসব ঘরের টিনের চাল জালের মতো ছিদ্র হয়ে গেছে। ঝড়-বৃষ্টির দিনে কাকভেজা হয়ে পরিবারগুলোকে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয়।
একই সুরে শিল্পী ভাসপোর বলেন, কলোনির টয়লেট ব্যবহারের অনুপযোগী হয়েছে অনেক আগেই, তার উপর গোসলখানা মাত্র দুটি, যে কারণে সকাল থেকেই লাইন ধরতে হয় সবাইকে। বার বার পৌরসভায় জানানোর পরও তাদের ব্যাপারে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।হরিজনরা অসুস্থ হয়ে পড়লে স্বাস্থ্য সেবা নিতেও তাদের অবহেলার শিকার হতে হয়। সরকারি হাসপাতারে চিকিৎসা নিতে গেলে তাদেরকে অবহেলার দৃষ্টিতে দেখা হয়, আর বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা নেওয়ার পথ বন্ধ, কারণ তারা হরিজন সম্প্রদায়।
বেসরকারি হাসপাতালে হরিজনদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া হলে ভদ্র সমাজের মানুষ তাদের হাসপাতালে সেবা নিতে আসবে না, হাসপাতালের সুনাম নষ্ট হবে। প্রতি মাসে হরিজন কলোনির বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরীক্ষার কথা থাকলেও কখনোই স্বাস্থ্যকর্মীদের দেখা পায়নি হরিজনরা। শহর আর শহরবাসীকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রেখে নগর সভ্যতার কারিগর যারা তাদের জীবনে ঘটেছে ছন্দপতন। জীবন সংগ্রামের দীর্ঘ পথ পেরিয়ে ক্লান্ত হরিজনরা তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে অন্য পেশায় নিয়োজিত করার স্বপ্ন দেখলেও সেই পথও বন্ধ। সুইপারের সন্তান তাই তাদের সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে চায় না কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ঢুকতে দেওয়া হয় না হোটেল রেস্তোরাতেও।হরিজন কলোনির বাসিন্দা আলো রাণী জানায়, শ্বশুর-শাশুড়িসহ তার পরিবারের সদস্য সংখ্যা ১৩ জন। অথচ তাদের থাকার ঘর মাত্র একটি, জায়গা না হওয়ায় দিনের বেলা রান্না শেষে রাতের বেলা সেই রান্না ঘরেই ঘুমাতে হয় পুরুষদের।
সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ৮০ শতাংশ সুইপার পদে জাত সুইপারদের নিয়োগের নিয়ম থাকলেও মানছে না কোনো প্রতিষ্ঠানই। হরিজনদের অভিযোগ, কোটা অনুযায়ী তারা তো নিয়োগ পাচ্ছেই না বরং ঘুষ দিয়ে তাদের স্থান দখন করে নিচ্ছে সম্প্রদায়ের বাইরের লোকজন। ফলে হরিজন সম্প্রদায়ে বেকারের সংখ্যা দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে। কাজের অভাবে দিন কাটছে অর্ধাহারে-অনাহারে, অভাব তাদের পিছু ছাড়ছে না।স্থানীয় পৌর কাউন্সিলর জামাল পাশা জামালপুর সুইপার কলোনির দীর্ঘদিনের সমস্যার কথা স্বীকার করে জানান, আবাসন সমস্যা সমাধানের জন্য পৌর মেয়রের মাধ্যমে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে একটি আবেদন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেলেই হরিজনদের আবাসন সমস্যা সমাধানে কাজ শুরু করা হবে। জামালপুর পৌরসভার মেয়র মির্জা সাখাওয়াতুল আলম মনি জানান, হরিজন কলোনির আবাসন সমস্যা সমাধানে বিএমডিএফ প্রকল্প জমা দেওয়া হয়েছে। প্রল্পটি পাস হলেই আবাসন সমস্যা সমাধান হবে। এছাড়াও হরিজনদের শিক্ষার প্রসারে কাজ করার পরিকল্পনা রয়েছে।শুধু আশ্বাস নয়, জামালপুর শহর আর শহরবাসীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলছে, তাদের জীবনে নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে একটু সহানুভুতিসহ সহযোগিতার হাত বাড়ানোর আহ্বান জানিয়েছেন জামালপুর হরিজন কলোনির বাসিন্দারা।