প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ দেশবাসীকে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ এবং মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহবান জানিয়ে বলেছেন, ছাত্র-ছাত্রীদের জঙ্গি, মাদকাসক্তি এবং সন্ত্রাসের পথ পরিহার করতে হবে।সন্ত্রাস জঙ্গিবাদ আমাদের পথ নয় উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ছেলে মেয়েরা লেখাপড়া শিখে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত হবে, আমরা উচ্চশিক্ষায় বৃত্তি দিচ্ছি যাতে উন্নত শিক্ষা পেতে পারে। আমরা আধুনিক প্রযুক্তি শিক্ষা দিচ্ছি, যাতে প্রযুক্তি শিক্ষা তারা নিতে পারে। কাজেই সে শিক্ষা নিতে হবে এবং সন্ত্রাস জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমগ্র জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৃহস্পতিবার ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজ মাঠে জেলা আওয়ামী লীগ আয়োজিত এক জনসভায় প্রধান অতিথির ভাষণে একথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের অভিভাবকবৃন্দ, শিক্ষক, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, ওলামা-মাশায়েখ,বিভিন্ন পেশাজীবী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনসহ সকলের কাছে আমার এই আহবান থাকবেÑ একটা ছেলে- মেয়েও যেন ঐ সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং মাদকের পথে না যায়। কোন স্কুল-কলেজের ছেলে-মেয়ের অনুপস্থিতির হিসেব নিতে হবে। বাবা-মাকে, নিজের ছেলে-মেয়ে কার সাথে মেশে, কার সাথে বন্ধুত্ব করে, কার সাথে চলাফেরা করে তা খেয়াল রাখতে হবে।তিনি বলেন, ইসলাম শান্তির ধর্ম, ইসলাম ধর্ম মানুষকে হত্যা করতে বলে নাই। ইসলাম ভ্রাতৃত্বের ধর্ম, সৌহাদ্যের ধর্ম, আমাদের নবী করিম (সা:) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন যে, যে ধর্মেরই হোক সকলকে সহযোগিতা করতে। নিরীহ মানুষকে হত্যা করা আর আত্মহননের পথ বেছে নেয়া কখনো ইসলাম সমর্থন করে না।
এর আগে অপরাহ্নে একইস্থানে প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে ২০টি প্রকল্পের উদ্বোধন এবং আরো ১২টি নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী ।প্রধানমন্ত্রী আসন্ন ২০১৯ সালের নির্বাচলে নৌকার জন্য ফরিদপুরবাসীর কাছে ভোট প্রার্থনা করে বলেন, এই এলাকায় যখনই আপনারা নৌকায় ভোট দিয়েছেন তখনই আপনাদের উন্নতি হয়েছে। কাজেই আমি আপনাদের কাছে ওয়াদা চাইÑ আগামী নির্বাচন সামনে, ২০১৯ সালে নির্বাচন হবে। … সেই নির্বাচনে আমাদের উন্নয়নের কাজ যেন অব্যাহত রাখতে পারি তার জন্য নৌকা মার্কায় আপনাদের ভোট চাই।প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিভাগকে ভেঙ্গে ফরিদপুরসহ ৫টি জেলা নিয়ে পৃথক একটি বিভাগ গঠনে সরকারের পরিকল্পনার কথা উল্লেখ করে বলেন, ইনশাল্লাহ ঢাকা বিভাগ ভেঙ্গে আমরা নতুন আরেকটা বিভাগ করবো। ফরিদপুর, মাদারীপুর, রাজবাড়ি, শরিয়তপুর, গোপালগঞ্জ নিয়ে আরেকটি বিভাগ আমরা করবো সেই পরিকল্পনাও আমাদের রয়েছে।জাতির পিতার পদাংক অনুসরণ করে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের অংশ হিসেবে তাঁর সরকার নতুন নতুন বিভাগ করে দিচ্ছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকা বিভাগ ভেঙ্গে ময়মনসিংহ বিভাগও আমরা ইতোমধ্যেই করে দিয়েছি।তিনি বলেন, আমাদের এই বিভাগ করার উদ্দেশ্য জনগণ যাতে বেশি সেবা পায়। জনগণ যাতে আরো বেশি কাজ পায় সেই সুযোগ আমরা সৃষ্টি করে দিচ্ছি। দক্ষিণাঞ্চল এবং পদ্মাপাড়ের মানুষ চিরদিন অবহেলিত ছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নির্মাণাধীন পদ্মাসেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে এই অঞ্চলের জনগণের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে ।
ফরিদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট সুবল চন্দ্র সাহা জনসভায় সভাপতিত্ব করেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্ত্রীয় যুগ্ম সম্পাদক আব্দুর রহমান সভা পরিচালনা করেন। বক্তৃতা করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এবং জাতীয় সংসদের উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ, দলের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমন্ডলীর সদস্য এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন, কাজী জাফর উল্লাহ এবং লে: কর্নেল (অব:) ফারুক খান এমপি, নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খানসহ আওয়ামী লীগ এবং এর সহযোগী সংগঠনের কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। সভায় প্রধানমন্ত্রীর জামাতা খন্দকার মাশরুর হোসেন মিতুকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রী পরিষদ সদস্যবৃন্দ, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টাবৃন্দ, জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ এবং সুধী সমাজের প্রতিনিধিবৃন্দ উপস্থিত ছিলেনপ্রধানমন্ত্রীর আগমনকে কেন্দ্র করে ফরিদপুর জেলা শহর ও সমাবেশস্থল উৎসবের নগরীতে পরিণত হয়। তোরণ, রং-বেরংয়ের ব্যানার, ফেস্টুন, প্লাকার্ড, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু এবং প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন রকম প্রতিকৃতিতে বর্ণিল হয়ে ওঠে পুরো শহর এবং সমাবেশ এলাকা। হাজার হাজার জনতা সকাল থেকে নেচে, গেয়ে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাজেন্দ্র কলেজ মাঠের সমাবেশে এসে যোগ দেয়। মিছিলে নারীদের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মত। চৈত্রের প্রচন্ড দাবদাহ অগ্রাহ্য করে দুপুরের পর পরই জনসভাস্থলটি কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে জনসমুদ্রে রূপলাভ করে। প্রধানমন্ত্রীকে এক নজর দেখার জন্য সকল বয়সের মানুষদের রাস্তার দু’ধারে, বাড়ির ছাদ বা উঁচু স্থাপনার ওপরে ঘন্টার পর ঘন্টা অপেক্ষা করতে দেখা যায়।প্রধানমন্ত্রী যেসব প্রকল্প উদ্বোধন করেন সেগুলো হচ্ছে- ফরিদপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয় নির্মাণ, ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, পল্লীকবি জসিম উদ্দীন সংগ্রহশালা, ফরিদপুর ইনস্টিটিউট অব মেরিন টেকনোলজী, শিশু একাডেমী, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের উপ-মহা পরিদর্শকের কার্যালয় নির্মাণ, জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন, আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ফরিদপুর, ফরিদপুর ৫০ মেগাওয়াট পিকিং পাওয়ার প্লান্ট, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের একাডেমিক কাম পরীক্ষা হল নির্মাণ, সদর উপজেলাধীন চর কমলাপুর খেয়াঘাট থেকে বিলমামুদপুর স্কুল সড়কে কুমার নদীর ওপর ৯৬ মিটার আরসিসি ব্রিজ নির্মাণ, ভাংগা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমপ্লেক্স ভবন নির্মাণ, মধুখালী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সকে ৩১ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নয়ন, আঞ্চলিক নির্বাচন অফিস ফরিদপুর, বিএসটিআই ভবন নির্মাণ, ভাংগা থানা ভবন নির্মাণ, মধুখালী ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন নির্মাণ, সদর উপজেলা থেকে বাখুন্ডা জিসি হয়ে রসুলপুর ভায়া চরনিখুরদি সড়ক বিসি দ্বারা উন্নয়ন শীর্ষক প্রকল্প, ফরিদপুর সদর উপজেলাধীন ডিক্রিরচর ইউনিয়নের মুন্সীডাঙ্গী কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ এবং ৩৩/১১ কেভি হারুকান্দি বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র (ক্ষমতা ২০/২৬.৬৬ এমভিএ)।এছাড়া, প্রধানমন্ত্রী কুমার নদ পুন:খনন প্রকল্প, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র আলফাডাঙ্গা, ফরিদপুর পুলিশ সুপারের কার্যালয়, পুলিশ হাসপাতাল, পুলিশ অফিসার্স মেস, সালথা টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের একাডেমিক কাম প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, চন্দ্রপাড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্র, সরকারি রাজেন্দ্র কলেজ ফরিদপুরের ছাত্রী নিবাস নির্মাণ, চীফ জুডিশ্যিয়াল ম্যাজিস্ট্রৈট আদালত নির্মাণ, ১৫০০ আসন বিশিষ্ট মাল্টিপারপাস হলরুম নির্মাণ, সালথা ফায়ার সর্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স স্টেশন, সদরপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স ষ্টেশন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।
বুধবার দুপুর সোয়া তিনটার দিকে জনসভাস্থল সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের শহর শাখার মাঠে পৌঁছে নৌকা আকৃতির বিশাল জনসভা মঞ্চে আসন নেন আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা। এ সময় সুইচ টিপে বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন করার পাশাপাশি নতুন প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন তিনি।বিকেল সোয়া চারটার দিকে বক্তব্য শুরু করেন প্রধানমন্ত্রী।এ সময় ফরিদপুরবাসীকে অবহেলিত ও বঞ্চিত উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ আপনাদের জন্য আমি অনেক উপহার নিয়ে এসেছি। এ সময় তিনি ফরিদপুরের জন্য ১৯টি প্রকল্পের উদ্বোধনের কথা একে একে উল্লেখ করেন।বিএনপি-জামায়াত এর সন্ত্রাসী কর্মকান্ডের তীব্র নিন্দা করে জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়া এয়ারকন্ডিশন রুমে বসে পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ হত্যার হুকুম দেন।প্রধানমন্ত্রী বলেন, মাত্র তিন বছরে জাতির পিতা অর্থনৈতিক মুক্তির পথে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। তারপর দীর্ঘ ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে আমরা উন্নয়নের কাজে হাত দিই।তিনি বলেন, কিন্তু বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় এসে মানুষের ভাগ্য নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে। তাদের রাজনীতি হলো পেট্রোল বোমা দিয়ে মানুষ পোড়ানো। এয়ার কন্ডিশন রুমে বসে থালেদা জিয়া হুকম দেয়। আর বিএনপি জামায়াত মানুষকে পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে মারে।বিএনপি জামায়াত জোটের সন্ত্রাসের হাত থেকে এমনকি অন্তঃসত্ত্বা নারীরাও রক্ষা পায়নি। তাদের পেট্রোল বোমার হাত থেকে রক্ষা পায়নি কোমলমতি শিশু এবং শিক্ষকরাও।প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ মানেই উন্নয়ন, আওয়ামী লীগ মানের দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নয়ন। কিন্তু বিএনপি ক্ষমতায় থাকার সময় সারের জন্য ১৮ জন কৃষককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।প্রধানমন্ত্রী এ সময় তার সরকারের নেয়া বিভিন্ন প্রকল্পের কথা উল্লেখ করে বলেন, গরীবের বন্ধু আওয়ামী লীগ। গরিবদের জন্য আওয়ামী লীগ কাজ করে যাচ্ছে।আমরা ১০ টাকায় ব্যাংক একাউন্ট খোলার ব্যবস্থা করেছি।তিনি আরও বলেন, শুধু এখানেই শেষ নয়, আমি আরও বেশ কিছু প্রকল্পের ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করে গেলাম। এগুলোর কিছু শুরু হয়ে গেছে। বাকিগুলোর কাজ খুব শিগগিরই বাস্তবায়ন হবে।তিনি বলেন, বিএনপি-জামায়াতের কাজই হলো ক্ষমতায় থেকে লুটপাট করা। এ সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের বিভিন্ন দুর্নীতি ও লুটপাটের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জিয়াউর রহমান যখন মারা যায় তখন বলা হয়েছিলো ভাঙা স্যুটকেস এবং ছেড়া গেঞ্জির কথা। কিন্তু পরে সেই ভাঙা স্যুটকেস থেকে কিভাবে এত লঞ্চ এত ইন্ডাস্ট্রি বের হলো? উপস্থিত জনতার প্রতি প্রশ্ন রাখেন প্রধানমন্ত্রী।