একুশে পদকপ্রাপ্ত প্রবীণ সাংবাদিক আফতাব আহমেদ হত্যা মামলায় পাঁচজনকে ফাঁসির দন্ড দিয়েছেন আদালত। অপর একজনকে সাত বছরের কারাদন্ড দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার ঢাকার চার নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক আবদুর রহমান সরদার এই রায় দেন।ফাঁসির দন্ড পাওয়া পাঁচ আসামি হলেন বিল্লাল হোসেন কিসলু, হাবিব হাওলাদার, রাজু মুন্সি, রাসেল এবং আফতাব আহমেদের গাড়িচালক হুমায়ুন কবির মোল্লা। রাজু মুন্সি ও রাসেল পলাতক রয়েছেন। অন্য তিনজনকে রায় ঘোষণার সময় কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। অপর আসামি সবুজ খানকে সাত বছর কারাদন্ড ও ১০ হাজার টাকা অর্থদন্ডে দন্ডিত করা হয়েছে। ২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে পশ্চিম রামপুরা ওয়াপদা রোডে নিজের বাসায় খুন হন ফটো সাংবাদিক আফতাব আহমেদ (৭৮)।
তার গাড়ি চালক মো. হুমায়ুন কবীর মোল্লা এবং এ মামলার অপর চার আসামি বিল্লাল হোসেন কিসলু, হাবিব হাওলাদার, মো. রাজু মুন্সী ও মো. রাসেলকে ডাকাতি ও হত্যায় জড়িত থাকার দায়ে মৃত্যুদ- দিয়েছে আদালত। অপর আসামি মো. সবুজ খানকে সাত বছরের সশ্রম কারাদন্ড এবং ১০ হাজার টাকা জরিমানা, অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদ- দেওয়া হয়েছে রায়ে।রায়ে বলা হয়, সবুজ শুধু বাড়ি পাহারার দায়িত্বে ছিল। খুনের সঙ্গে সে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত ছিল না। তার বয়স ১৮। বয়স বিবেচনায় তাকে স্বল্পমেয়াদের শাস্তি দেওয়া হল।আসামিদের মধ্যে রাজু মুন্সী ও মো. রাসেল পলাতক। বাকি আসামিরা রায়ের সময় কাঠগড়ায় উপস্থিত ছিলেন।সাজা শুনে আসামি সবুজকে কান্নায় ভেঙে পড়তে দেখা গেলেও সর্বোচ্চ সাজার রায় পাওয়া পাঁচ আসামিকে নির্বিকার দেখা যায়।রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেন, আফতাবের মত প্রবীণ ও বিচক্ষণ সাংবাদিকের এ রকম মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় না। দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য এ ধরনের অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি।আফতাবের বড় মেয়ে আফরোজা আহমেদ বন্যা রাযের পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় বলেন, সবুজের ফাঁসি হওয়া উচিত ছিল। আর দুই পলাতক আসামিকে তাড়াতাড়ি গ্রেপ্তার করা হোক।
২০০৬ সালে একুশে পদক পাওয়া আফতাব দীর্ঘদিন ইত্তেফাকের জ্যেষ্ঠ আলোকচিত্রী হিসাবে কাজ করেন। তার গ্রামের বাড়ি রংপুরের গঙ্গাচড়ায়। ঢাকার পশ্চিম রামপুরার ৬৩ নম্বর হোল্ডিংয়ে একটি চারতলা ভবনের তৃতীয় তলার বাসায় থাকতেন তিনি। তার দুই সন্তানের মধ্যে ছেলে মনোয়ার আহমেদ থাকেন যশোরে। আর মেয়ে আফরোজা আহমেদ তার স্বামী ফারুক আহমেদের সঙ্গে থাকেন গাজীপুরে।
২০১৩ সালের ২৪ ডিসেম্বর রাতে নিজের বাসায় খুন হন ৭৮ বছর বয়সী আফতাব। পরদিন সকালে পুলিশ তার হাত-পা বাঁধা লাশ উদ্ধার করে।নিহতের শ্যালক মনোয়ার আহমদ সাগর ওই ঘটনায় রামপুরা থানায় অজ্ঞাতপরিচয় আসামিদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করেন। তদন্ত চলাকালে আফতাবের গাড়ি চালক মো. হুমায়ুন কবীরসহ পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।টাকা ও স্বর্ণালঙ্কার লুট করার সময় বাধা দেয়ার কারণেই আফতাবকে হত্যা করা হয় বলে সে সময় তদন্তকারীদের পক্ষ থেকে জানানো হয়। আসামিদের মধ্যে হাবিব, বিল্লাল ও হুমায়ুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দেন।তদন্ত শেষে পরের বছর ২৫ মার্চ আদালতে অভিযোগপত্র দেন র্যাব-৩ এর উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. আশিক ইকবাল।ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ ২০১৪ সালের ২৪ জুলাই অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে এ মামলার বিচার শুরু করেন। দন্ডবিধির ৩৯৬ ধারায় ‘ডাকাতি করতে গিয়ে হত্যার’ অভিযোগ আনা হয় ছয় আসামির বিরুদ্ধে।
আদালত রায়ে বলেছেন, কীর্তিমান এ সাংবাদিককে হত্যার দায়ে এই আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিকল্প নেই।মামলার সংক্ষিপ্ত বিবরণে জানা যায়, ২০১৩ সালের ২৫ ডিসেম্বর রামপুরায় নিজ বাসা থেকে আফতাব আহমেদের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত হুমায়ুন কবির ছিলেন আফতাব আহমেদের গাড়িচালক। হত্যার দায় স্বীকার করে হুমায়ুন কবির, হাবিব হাওলাদার ও বিল্লাল হোসেন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। ওই জবানবন্দিতে তাঁরা স্বীকার করেন, পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী আফতাব আহমেদের বাসায় ডাকাতি করার সময় তাঁকে গামছা দিয়ে বেঁধে শ্বাসরোধে তাঁরা হত্যা করেন।ফাঁসির দন্ডপ্রাপ্ত আসামি বিল্লাল হোসেন কিসলু আফতাব আহমেদের বাসার ড্রয়ার ভেঙে ৭২ হাজার টাকা লুট করেন। পরে তাঁরা বৌবাজার নামক একটি জায়গায় এই টাকা ভাগাভাগি করে নেন। রায়ে উল্লেখ করা হয়, মামলার আরেক আসামি নিজামের বিরুদ্ধে দন্ডবিধি ৩৯৬ ধারার অভিযোগ সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণিত হলেও তাঁর ঠিকানা অস্পষ্ট থাকায় তাঁকে অভিযোগপত্র থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। রায়ে আফতাব আহমেদ সম্পর্কে বলা হয়েছে, ৬৯ বছর বয়স্ক সাংবাদিক আফতাব আহমেদ দৈনিক ইত্তেফাকের প্রবীণ ফটোসাংবাদিক ছিলেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ ও পরবর্তী সময়ে অনেক দুর্লভ ছবি তোলেন। আলোকচিত্র সাংবাদিকতায় অনন্য অবদানের জন্য ২০০৬ সালে তিনি একুশে পদকে ভূষিত হন। এই ধরনের একজন খ্যাতিমান প্রবীণ সাংবাদিককে ডাকাতির জন্য নিষ্ঠুরভাবে হত্যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না। দেশে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য এই ধরনের ডাকাতিসহ খুনের মামলার আসামিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।