উচ্চ আদালেতের আদেশে রাজধানীর ধানমন্ডির ছয় নম্বর রোডে অবস্থিত শতকোটি টাকা মূল্যের একটি জমির মালিকানা সরকারেরই থেকে গেলো। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগ মঙ্গলবার সরকারের আপিল আবেদন মঞ্জুর করে এ আদেশ দেন। সেই সাথে বাড়ির মালিকানা দাবিদার এক পুলিশ কর্মকর্তাসহ দুইজনের প্রত্যেককে দুইশ টাকা করে জরিমানা করেছেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

জরিমানার দণ্ড পাওয়া ওই দুই ব্যক্তি হলেন পুলিশ পরিদর্শক মো. শাহিন ও প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেন। আদালতের আদেশের পর জরিমানার টাকা তারা আদালতে জমা দেন। আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। বিবাদী পক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাডভোকেট প্রবীর নিয়োগী ও শাহ মুনির শরীফ।

ধানমন্ডির ছয় নম্বর রোডের ৪০ নম্বর বাড়িটির মালিক হাকিম এস এ আলী ১৯৭১ সালে ভারতে চলে যান। সরকার বাড়িটিকে পরিত্যক্ত বাড়ি ঘোষণা করে। পরে বাড়িটি তৎকালীন সিরাজগঞ্জের এমপি সৈয়দ হায়দার আলীকে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি থেকে মাসিক ৭শ টাকা ভাড়া পরিশোধের শর্তে পূর্ত মন্ত্রণালয় বরাদ্দ দেন। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালে পূর্ত মন্ত্রণালয় বাড়িটি ফেরত নিয়ে মিসেস নাজমা মজিদকে বরাদ্দ দেন। নাজমা মজিদই নিয়মিত ভাড়া পরিশোধ করে বসবাস করে আসছেন বলে সরকারের কাগজপত্রে উল্লেখ আছে।

এ বিষয়ে ১৯৮২ সালে হোসেনে আরা বেগম বাদী হয়ে ঢাকার সাব জজ আদালতে একটি মামলা করেন। মামলায় মরহুম সাইফুল মূলক হাকিম সৈয়দ মোহাম্মদ সাদিকের স্ত্রী ফাতেমা বেগমকে প্রথম বিবাদী করা হয়। এছাড়া সম্পত্তিটির মূল মালিক হাকিম এস এ আলীকে মৃত দেখিয়ে তার উত্তরাধিকার হিসেবে মোছা: নাজনীন বেগম, মোছা: রানা আলী, ও ফারজানা আলী হাকিমকে দেখানো হয়। কিন্তু বাস্তবে হাকিম এস এ আলীর কোন উত্তরাধিকার না থাকায় বিবাদীরা মামলাটি প্রতিদ্বন্দ্বীতা করেনি। এনিয়ে পরবর্তীতে একাধিক মামলা হয়। সর্বশেষ মোয়াজ্জেম হোসেন পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: শাহিনের নামে একটি পাওয়ার অব অ্যাটর্নি (আম-মোক্তারনাম) তৈরি করেন। এই আম-মোক্তারনামায় বাড়িটির মূল মালিক হাকিম এস এ আলীকে মৃত দেখিয়ে তার স্ত্রী মোছা: নাজনীন বেগম ও কন্যা মোছা: রানা আলী ও ফারজানা আলী হাকিমকে উত্তরাধিকার দেখানো হয়।

হাকিম এস এ আলীর উত্তরাধিকার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে থাকেন উল্লেখ করে বাড়িটির মালিকানা পুলিশ ইন্সপেক্টর মো: শাহিনকে দেখানো হয়। মামলায় নিম্ন আদালত ২০০০ সালের ২ মে বাদীপক্ষে রায় দেয়। এ রায়ের বিরুদ্ধে সরকার হাইকোর্টে আপিল করে। হাইকোর্ট সরকারের আবেদন খারিজ করে ২০০৫ সালে রায় দেন। এরপর সরকার হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার অনুমতি চেয়ে (লিভ টু আপিল) আবেদন করে আপিল বিভাগে। আপিল বিভাগ এবারও সরকারের আবেদন খারিজ করে দেন।

এরপর সরকার রিভিউ আবেদন করে। আদালত ২০১১ সালের ২৯ এপ্রিল রিভিউ আবেদন গ্রহণ করেন এবং আপিল করার অনুমতি দেন। এরপর সরকার আপিল করে। এ আপিলের ওপর শুনানিকালে আম-মোক্তারনামা নিয়ে আদালত পুলিশ কর্মকর্তা মো. শাহীন ও তার আত্মীয় প্রকৌশলী মোয়াজ্জেম হোসেনকে তলব করেন। ওই দুই ব্যক্তি আদালতে হাজির হন। প্রথমেই আদালত মো. শাহীনের বক্তব্য জানতে চান। আদালতের প্রশ্নের কোনো জবাব দিতে পারছিলেন না এ পুলিশ কর্মকর্তা। তিনি আদালতের প্রশ্নের জবাবে মূল মালিককে চেনেন না এবং তার নামও জানেন না বলে জানান।

তিনি বলেন, তার আত্মীয় মোয়াজ্জেম হোসেনই তার নামে (মো. শাহিন) আম-মোক্তারনামা (পাওয়ার অব অ্যাটর্নি) করে এনেছেন। এরপর আদালত মোয়াজ্জেম হোসেনের বক্তব্য জানতে চান। মোয়াজ্জেম হোসেন জানান, প্রথম আম-মোক্তারনামা যার নামে ছিল তিনি মারা গেছেন। কিন্তু তার আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে পরিচয় থাকার সুবাদে তিনি ভারতে যেয়ে আম-মোক্তারনামা করে আনেন। শুনানিতে ওই দুইজনের বক্তব্যে মিল না থাকায় এবং সঠিক উত্তর দিতে না পারায় আদালত তাৎক্ষণিকভাবে তাদেরকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। এ আদেশে আদালত কক্ষে পুলিশ উপস্থিত হয়ে ওই দুই ব্যক্তিকে নিয়ে যেতে চাইলে তারা আদালতের কাছে জোড় হাত করে ক্ষমা চাইতে থাকেন।

এক পর্যায়ে আদালত বলেন, কোনো ক্ষমা নেই। আপনি শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য। এভাবে এতবড় জালিয়াতি আপনি করতে পারেন না। আর কতজনের সর্বনাশ করবেন আপনারা। রাষ্ট্রের আর কত ক্ষতি করবেন? এরপর আদালত তাদের প্রক্যেতকে দুইশ টাকা করে জরিমানা করেন। আদালত বলেন, এরপর যদি আর কোনো প্রতারণা করেন তাহলে শাস্তি পেতে হবে।

আদালতের এ আদেশের পর ওই দুই ব্যক্তি রেজিস্টার কার্যালয়ে উপস্থিত হয়ে জরিমানার টাকা জমা দিয়ে কারাগারে যাওয়া থেকে রক্ষা পান। এরপর তারা আদালত এলাকা ত্যাগ করেন। আদালতের আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, ভুয়া পাওয়ার অব অ্যাটর্নি নিয়ে পরিত্যক্ত বাড়ীটি আত্মসাত করার চেষ্টা করছিল। আদালত প্রতারকদের চিহ্নিত করেছেন ও তাদের জরিমানা করেছেন। তিনি আরো বলেন, আদালত বলেছেন পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দিয়ে যারা সম্পদ ছাড়িয়ে নেয় তাদের বেশির ভাগই ভূয়া।