প্রবীণ সাংবাদিক জয়নাল আবেদীনের প্রতি শেষ শ্রদ্ধা জানিয়েছেন তার সহকর্মী ও সহযোদ্ধারা। বাংলা অন্তঃপ্রাণ এ উর্দুভাষীর মরদেহ শুক্রবার সকালে জাতীয় প্রেস ক্লাবে নিয়ে আসা হলে সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে তার কফিনে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয়।এ সময় অনেকেই ঝনু ভাইকে নিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। প্রেসক্লাবের এই চেনা মানুষটিকে শেষ বিদায় জানাতে এসে কাউকে কাউকে কাঁদতেও দেখা যায়।বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় বৃহস্পতিবার রাতে মারা যান জয়নাল আবেদীন। ৮১ বছর বয়সী এ প্রবীণ সাংবাদিক লিভার সিরোসিসে ভুগছিলেন। জাতীয় প্রেসক্লাবে জয়নাল আবেদীনের জানাজায় অংশ নেন বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার সাবেক প্রধান সম্পাদক মুহাম্মদ আমানউল্লাহ, আবদুর রহীম, খন্দকার মনিরুল আলম, আবদুর রহমান খান, কামরুল ইসলাম চৌধুরী, সৈয়দ আবদাল আহমেদ, কাদের গনি চৌধুরী।
উপস্থিত ছিলেন প্রেস ক্লাবের সভাপতি মুহাম্মদ শফিকুর রহমান, সিনিয়র সহসভাপতি সাইফুল আলম, ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল, এম এ আজিজ, ওমর ফারুক, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের আবদুল হাই শিকদার, শাবান মাহমুদ, জাহাঙ্গীর আলম প্রধান, সোহেল হায়দার চৌধুরী, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক মোরসালীন নোমানী, বাংলাদেশ চলচিত্র সাংবাদিক সমিতির সভাপতি আবদুর রহমান।সাংবাদিক স্বপন সাহা, মনোজ কান্তি দে ও সুধীর কৈবর্ত্যও প্রেস ক্লাবে জয়নাল আবেদীনের কফিনে শ্রদ্ধা জানান।দুপুরে বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে আবাও জানাজার পর তাকে মিরপুরে বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে দাফন করার কথা রয়েছে।উর্দুভাষী হয়েও ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে দাঁড়িয়েছিলেন জয়নাল আবেদীন। পরিবারের সবাই পাকিস্তানে চলে গেলেও বাংলার টানে থেকে যান এ দেশেই।সাংবাদিকতার পাশাপাশি সাহিত্যকর্মেও সক্রিয় ছিলেন তিনি; জনপ্রিয় অনেক চলচ্চিত্রের কাহিনী তার লেখা। তবে সব কিছু ছাপিয়ে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণের বিষয়টিতেই গুরুত্ব ছিল তার।ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা কলেজে দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র ছিলেন জয়নাল আবেদীন। তখন ঢাকা কলেজ ক্যাম্পাস ছিল ফুলবাড়িয়ায়। বামপন্থি রাজনীতিতে যুক্ত থাকার কারণে দেয়াল লিখনে হাত পাকিয়েছিলেন তখনই; ঘনিষ্ঠরা তাকে বলতেন- ‘মাস্টার অব ওয়াল রাইটার’।বায়ান্নতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে পুরান ঢাকায় দেয়ালে দেয়ালে উর্দু ভাষায় হামারি জবান, বাংলা জবান (আমার ভাষা বাংলা ভাষা) স্লোগান লিখেছিলেন তিনি।২১ ফেব্রুয়ারির আগে পুলিশ যখন ১৪৪ ধারা জারি করে, তখন একটি বৈঠকে অনেক ভাষা সৈনিকের সঙ্গে তিনিও ছিলেন বলে কয়েকদিন আগে এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন।
একুশ সম্পর্কে তিনি বলেছিলেন, বাংলা ভাষার জন্য এরকম রক্ত দেওয়ার ঘটনা বিশ্বে আর কখনও ঘটবে না। এজন্যই সারাবিশ্ব আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ২১ ফেব্র“য়ারিকে বিলম্বে হলেও স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই রকম একটি দেশের মানুষের সঙ্গী আমি, এটাই আমার বড় ভাগ্য।আমি বাংলাদেশকে নিজের মায়ের দেশ মনে করি, বলেছিলেন তিনি।জয়নাল আবেদীনের জন্ম ১৯৩৭ সালে ভারতের উত্তর প্রদেশের রাজধানী এলাহাবাদে; শৈশব কেটেছে বিহারে, যেখানে তার বাবা মুহাম্মদ মোস্তফা ছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়ান রেলওয়ে হেড ড্রাফটসম্যান।১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর মোস্তফা পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়েতে যোগ দেন, কর্মস্থল হয় বর্তমান নীলফামারীর সৈয়দপুরে।
সৈয়দপুরের হাইস্কুল থেকে মেট্রিকুলেশন পাসের পর ঢাকা কলেজ থেকে আইকম ও বিকম পাস করেন জয়নাল আবেদীন। কলেজে থাকার সময় কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন তিনি।তার সাংবাদিকতার শুরু ১৯৫৭ সালে উর্দু দৈনিক জংয়ের মাধ্যমে। পরে তিনি মর্নিং নিউজ, বাংলাদেশ টাইমস, চলচ্চিত্র পত্রিকা চিত্রালী, ওয়াতন, সংবাদ সংস্থা এনায় কাজ করেন। সর্বশেষ জং এর বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করেছেন সাংবাদিক জগতে ঝনু ভাই হিসেবে পরিচিত জয়নাল আবেদীন।ইস্ট পাকিস্তান ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশনে প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ছিলেন তিনি। জনপ্রিয় উর্দু ছবি চকোরি, আনাড়ি, পায়েল ও ছোট সাহেবের মতো শতাধিক চলচ্চিত্র কাহিনীর রচয়িতা জয়নাল আবেদীনকে রুপালি জগতের অনেকে ‘গুরু’ বলে মানেন।পরিচালক এহতেশাম, মুস্তাফিজ, শিবলী সাদেক, অভিনেতা রহমানের সঙ্গে ছিল তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর আজিজুর রহমান পরিচালিত জনতা এক্সপ্রেস ছবির প্রযোজনাও করেন তিনি।জয়নাল আবেদীন কথাসাহিত্িযক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের উপন্যাস খোয়াবনামা’ উর্দুতে অনুবাদ করেছেন।তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন সবার বড়। দুই ভাই পাকিস্তানের করাচিতে থাকেন। একমাত্র বোন চার বছর আগে মারা যান।