নারী পুরুষের সমতা, উন্নয়নে যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা । আট মার্চ বুধবার আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালিত হয়েছে। নারী পুরুষের সমতা, উন্নয়নে যাত্রা, বদলে যাবে বিশ্ব, কর্মে নতুন মাত্রা এ প্রতিপাদ্য নিয়ে এবারও নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে বিশ্ব নারী দিবস।কাজের স্বীকৃতি নেইÑএমন চারটি খাতকে নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। খাতগুলো হলো বাসাবাড়িতে গৃহপরিচারিকার কাজ, কৃষিশ্রমিক, নির্মাণশ্রমিক ও প্রবাসে শ্রমিকের কাজ। এর মধ্যে প্রথম দুটি খাতে বিপুলসংখ্যক নারী কাজ করছেন।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) এক গবেষণায় এই চারটি খাতকে নারীর জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলা হচ্ছে। বিপুলসংখ্যক নারী এখানে কাজ করলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে এখনো এই কাজগুলোর স্বীকৃতি নেই। মূলত, মালিক বা কাজদাতার ইচ্ছা-অনিচ্ছার ওপরই তাঁদের নির্ভর করতে হয়। বেতন বাদে অন্য কোনো ধরনের বৈষম্য নিয়ে আইনগত কোনো সুবিধা পান না তাঁরা। এসব ক্ষেত্রে নারীদের আয়ের অর্থনৈতিক মূল্যও সেভাবে স্বীকৃতি পায় না।একশ আট বছর আগে এ দিনটিতে পাশ্চাত্যের নারী শ্রমিকেরা সম অধিকারের দাবিতে লড়াই করে ইতিহাস গড়েছেন। তারপর থেকে দেশে দেশে নারীর পথচলা আর থেমে নেই। পাশ্চাত্যের মতো এই অঞ্চলের নারীরাও নিজেদের অধিকার আদায়ের পাশাপাশি স্বাধীনতা অর্জনেও লড়াই করেছেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এ একশ বছরের পথ পরিক্রমায় কেমন আছেন নারী সমাজ?
প্রতিবাদের ইস্যু ছিল সূচ কারখানায় যে নারী পুরুষের পাশাপাশি কাজ করেন তাদের মধ্যে নারীকে কেন একই বেতনের জন্য পুরুষের চেয়ে বেশি সময় কাজ করতে হবে? কেনই বা নারীর ভোটাধিকার নেই? নেই সমঅধিকারও? এইসব গড়মিলের হিসাব মিলাতে ১০৮ বছর আগে নিউইয়র্কের রাজপথে নামেন নারী সমাজ। নেত্রী ক্লারা জেটকিন ডেনমার্কের রাজধানী কোপেন হেগেনে ঘোষণা দেন নারী দিবস উদযাপনের।পাশ্চাত্যে এখন আর খালি চোখে নারী-পুরুষের বৈষম্য দেখা যায় না তবে, এখনও বিতর্ক ওঠে যখন একজন নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী হন। সেই পথে বাংলাদেশ বা এ অঞ্চল এগিয়েছে অনেকদূর। প্রায় সব ক্ষেত্রেই নারীর অবস্থান চোখে পড়ার মতো বলে মন্তব্য করে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম।কিন্তু, তারপরও পথে ঘাটে নারী আজো নিরাপদ নন। কর্মক্ষেত্রের পরিবেশও নয় নারীবান্ধব। আবার রাষ্ট্রে ক্ষমতা রদ-বদলের সঙ্গে সঙ্গে দলীয় দৃষ্টিকোণেও বদলে যায় নারীর ক্ষমতায়নের বিষয়টি বলে মত দেন সিডও এর সাবেক চেয়ারম্যান সালমা খান ও আয়শা খানম।তবুও ক্ষমতায়নের পথে নারী এখন কাজ করছেন ঘরের বাইরে, অর্থনীতিতেও অবদান রেখে চলেছেন জানান মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকী।এখন কেবল অপেক্ষা সেই দিনের যখন নারী আর নারী বলে বৈষম্যের শিকার হবে না-কি ঘরে কি বাইরে।এদিকে, নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ বন্ধের শপথ ও মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপনের সূচনা করা হয়।
নারী দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার রাতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে আমরাই পারি পারিবারিক নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের উদ্যোগে আয়োজিত অনুষ্ঠানের শুরুতে হয় আলোচনা, সাস্কৃতিক অনুষ্ঠান।এসময় মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি নারী নির্যাতন ও বাল্য বিবাহ বন্ধে সরকারের ভূমিকা তুলে ধরেন। মৌলবাদের হাত থেকে নারীকে রক্ষার এবং সবক্ষেত্রে নারীর অংশ গ্রহণ বাড়ানোর দাবি জানান নারী নেত্রীরা। সব শেষে মোমবাতি প্রজ্জ্বলনের পাশাপাশি নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে শপথ বাক্য পাঠ করান সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপু মনি।
সিপিডির বিশেষ ফেলো দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যবলেন, এই চারটি খাতে নারীদের বিপুলসংখ্যক উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। সিপিডি দেখতে চেয়েছে, রাষ্ট্রের অননুমোদিত খাতগুলোয় নারীর অবস্থান কেমন। গবেষণায় দেখা গেছে, এই চারটি খাত নারীদের জন্য সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ। এর মধ্যে গৃহপরিচারিকার কাজ সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। কেননা, এই খাতে যাঁরা কাজ করেন, তাঁদের ৫৩ শতাংশই কোনো না কোনো সময় শারীরিক নির্যাতনের স্বীকার হয়েছেন। এমনকি মেয়েশিশুদের ওপরও বর্বর নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। দেবপ্রিয় বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর নিরাপত্তা সবচেয়ে জরুরি। নিরাপত্তাহীনতা নারীদের অনেক ক্ষেত্রে কাজে আসার ব্যাপারে অনীহা তৈরি করে। ফলে একজন নারীকে কাজে আসার ক্ষেত্রে অনেক বেশি হিসাব-নিকাশ করতে হয়, যা পুরুষের লাগে না। এতে সমতা থাকে না।স্বীকৃতিহীন খাতগুলোতে কী ধরনের নির্যাতনের স্বীকার হন নারী, এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার, সিপিডি ও কয়েকটি বেসরকারি সংস্থার গবেষণা রয়েছে। এসব গবেষণা দেখা গেছে, এই খাতগুলোয় নারীদের নির্যাতনের ধরন এক নয়। যৌন নির্যাতনের স্বীকার যেমন হচ্ছেন, তেমনি মালিকের মারপিটের স্বীকার হচ্ছেন। একই কাজে পুরুষের তুলনায় বেতন কম দেওয়া হচ্ছে। কোনো ধরনের ছুটি নেই। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজের সময় নির্ধারণ নেই। আইনি সুবিধা পান না। দুর্ঘটনার জন্য ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না, চিকিৎসাসুবিধা নেই প্রভৃতি।
সারা দেশে গৃহপরিচারিকার কাজ করে বিপুলসংখ্যক নারী তাঁদের নিজ নিজ সংসারে অবদান রাখছেন। যদিও এ কাজের কোনো স্বীকৃতি তাঁদের নেই। আইন না থাকায় দরিদ্র ও অশিক্ষিত নারীদের এই কাজের কোনো মূল্য রাষ্ট্রীয়ভাবে দেখা যায় না।সরকারের তথ্য অনুযায়ী, কৃষি, মৎস্য ও বৃক্ষরোপণের মতো কাজগুলোয় নারীদের অংশগ্রহণ পুরুষের তুলনায় বেশি। মোট শ্রমিকের প্রায় ৬৮ শতাংশ নারী। কিন্তু এখানে তাঁরা মজুরি পান পুরুষের তুলনায় কম। শ্রম আইনে নারী-পুরুষের সমান মজুরির কথা বলা হলেও মুন্সিগঞ্জ ও মানিকগঞ্জে দেখা গেছে, প্রতিদিন কাজের জন্য একজন নারী যখন ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা পান, তখন একজন পুরুষ পান ৪০০ টাকা।একই অবস্থা নির্মাণকাজে নিয়োজিত নারীদের ক্ষেত্রেও। ঝুঁকি নিয়ে কাজ করলেও তাঁরা বেতন পান কম। চিকিৎসাসুবিধা বা দুর্ঘটনার জন্য কোনো ক্ষতিপূরণ পান না তাঁরা।শ্রম প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীর বৈষম্য নেই, তা বলার সময় আসেনি। কিন্তু এটা থাকা উচিত নয়। ইনফরমাল খাতগুলোতে নারীরা বেশি বৈষম্যের স্বীকার হচ্ছেন। সব কাজকে আইনের আওতায় আনতে পারলে এই বৈষম্য দূর হবে। তিনি আরও বলেন, নারীদের কর্মক্ষেত্রে আরও কীভাবে সুরক্ষা দেওয়া যায়, আইনের দুর্বলতা কোথায়, সেগুলো খুঁজে দেখা হচ্ছে।
এছাড়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস। নারী পুরুষ সমতা উন্নয়নের যাত্রা বদলে যাবে বিশ্ব কর্মের নতুন মাত্রা এই শ্লোগানকে সামনে রেখে নড়াইলে শোভাযাত্রা বের করা হয়। জেলা প্রশাসন ও জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের আয়োজনে পরে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। রাজবাড়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নারী দিবস উপলক্ষে শোভাযাত্রা ও আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। পটুয়াখালীতেও বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা বের করা হয়। এছাড়া নানা কর্মসূচির মধ্য দিয়ে নেত্রকোণা, যশোর, ময়মনসিংহ, কুষ্টিয়া, নাটোর, কুড়িগ্রাম, মৌলভীবাজারসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক নারী দিবস।