সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুই চালকের সাজার প্রতিবাদে সারা দেশে পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে ভোগান্তিতে পড়েছে সাধারণ মানুষ।ঢাকার গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো গাড়ি ছেড়ে যাচ্ছে না। শহরতলীর বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচলে বাধা দেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে। গাড়ি না পেয়ে রাস্তায় নাকাল হতে হচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন রুটের যাত্রীরাদেরও।খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, দিনাজপুর, সিরাজগঞ্জ, ময়মননিংহ ও সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিনিধিরা পরিবহন ধর্মঘটে সব ধরনের যাত্রী ও পণ্যবাহী যান চলাচল বন্ধ থাকার খবর জানিয়েছেন।এদিকে ধর্মঘটের কারণে যশোরের বেনাপোল স্থলবন্দরে কয়েকশ পণ্যবাহী ট্রাক আটকে পড়ায় ব্যবসায়ীরাও বিপাকে পড়েছেন। বাস না থাকায় চাপ বেড়েছে ছোট যানবাহন ও ট্রেনে।
সারা দেশে মঙ্গলবার সকাল থেকে হঠাৎ করেই ধর্মঘট শুরু করেছেন পরিবহনশ্রমিকেরা। ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে গতকাল সোমবার এক চালকের মৃত্যুদন্ডাদেশ দেন আদালত। এরই প্রতিবাদে এই কর্মসূচি।২০০৩ সালের ২০ জুন সাভারের ঝাউচার এলাকায় ট্রাকচাপায় নিহত হন খোদেজা বেগম (৩৮)। এ ঘটনায় তাঁর স্বামী নুরু গাজী সাভার থানায় ট্রাকচালক মীর হোসেন ও তাঁর সহকারী ইনতাজ আলীর বিরুদ্ধে মামলা করেন। ট্রাকচালক মীর হোসেনের বাড়িও সাভারের ঝাউচর এলাকায়। ১৩ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ শেষে গতকাল ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ প্রদীপ কুমার রায় চালক মীর হোসেনের মৃত্যুদন্ড এবং তাঁর সহকারীকে খালাস দেন। এরই প্রতিবাদে কর্মবিরতি পালন করছেন পরিবহনশ্রমিকেরা।
মানিকগঞ্জে সড়ক দুর্ঘটনায় চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ, সাংবাদিক মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহত হওয়ার ঘটনায় বাসচালক জামির হোসেনকে যাবজ্জীবন কারাদন্ডাদেশ দেওয়ার প্রতিবাদে গত রোববার থেকে শুরু করে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট চালান শ্রমিকেরা। যাত্রীদের দুই দিনের দুর্ভোগের পর যান চলাচল যখন স্বাভাবিক হওয়ার পথে, তখন থেকে পরিবহনশ্রমিকেরা আবার নতুন কর্মসূচি শুরু করেছেন। নতুন করে আবার দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।সকাল সাতটা থেকে এই কর্মবিরতি শুরু হয়। এ সময় ট্রাকশ্রমিকেরা কয়েকটি গাড়ি ভাঙচুর করেন। এতে দূরপাল্লার যাত্রীসহ স্থানীয় যাত্রীরাও দুর্ভোগে পড়েছেন।
ঢাকা ও ঢাকার বাইরে থেকে পাঠানো আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক, প্রতিনিধি ও আঞ্চলিক অফিসের খবর:
সরেজমিনে দেখা গেছে, সকাল থেকেই রাজধানীর গাবতলী আন্তজেলা বাস টার্মিনালের সামনে গরুর হাট ক্রসিংয়ে ও দারুস সালামে সড়কে ব্যারিকেড দিয়ে অবরোধ করে রেখেছেন পরিবহনশ্রমিকেরা। দু-একটা প্রাইভেট কার ও লেগুনা ছাড়া আর কোনো গাড়ি চলাচল করছে না। রাজধানী থেকে সাভার ও মানিকগঞ্জ সড়কে যান চলাচল একদম বন্ধ। রাস্তাঘাটে হাজারো যাত্রী গাড়ির অপেক্ষায়। কিন্তু ঢাকা থেকে কোনো গাড়ি বের না হওয়ায় এবং ঢাকায় কোনো গাড়ি ঢুকতে না পারায় চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন তাঁরা।গাবতলী এলাকার দায়িত্বরত ট্রাফিক বিভাগের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, প্রথমে ট্রাফিক বিভাগের পক্ষ থেকে ট্রাকশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলার পর পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছিল। কিন্তু সকাল নয়টার পর থেকে আবার তাঁরা অবরোধ শুরু করে ভাঙচুর চালান। ঢাকা মহানগর ট্রাফিক বিভাগের (পশ্চিম) উপকমিশনার লিটন কুমার সাহা বলেন, পরিবহনশ্রমিকদের অবরোধের কারণে কোনো যান চলাচল করতে পারছে না। এতে যাত্রীরা দুর্ভোগে পড়েছেন।
বাংলাদেশ আন্তজেলা ট্রাক চালক শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি তাজুল ইসলাম বলেন, আমাদের দাবি বাসচালক জামির হোসেনের যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সড়ক দুর্ঘটনার দায়ে এক ট্রাকচালকের মৃত্যুদন্ড প্রত্যাহার করতে হবে। এই দাবি না মানা পর্যন্ত অবরোধ কর্মসূচি চলবে। পাশাপাশি সারা দেশে ধর্মঘটও চলবে। ধর্মঘটের অংশ হিসেবে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ থাকবে। তবে অ্যাম্বুলেন্স ও সংবাদপত্রবাহী যান চলাচল করবে। পণ্যবাহী কোনো ট্রাক চলাচল করবে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, চালক-শ্রমিকেরাই তো ট্রাক চালাবে না। মানিকগঞ্জে তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীরসহ পাঁচজন নিহতের ঘটনায় জামির হোসেন নামের এক বাস চালকের যাবজ্জীবন সাজা হওয়ায় খুলনা বিভাগের ১০ জেলায় দুই দিন পরিবহন ধর্মঘট চলার পর সোমবার প্রশাসনের আশ্বাসে কর্মসূচি প্রত্যাহারের ঘোষণা এলেও পরে শ্রমিক নেতারা কর্মসূচি বহাল রাখার কথা বলেন।এর মধ্যে ঢাকার সাভারে ট্রাকচাপা দিয়ে এক নারীকে হত্যার দায়ে সোমবার ঢাকার আদালতে ট্রাকচালক মীর হোসেনের ফাঁসির রায় হলে রাতে পরিবহন শ্রমিক নেতারা অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতির কর্মসূচি দেন।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্লাহ মঙ্গলবার সকালে বলেন, এক বাসচালকের যাবজ্জীবন সাজার রায় আসার পর শ্রমিকরা ক্ষুব্ধ হয়েছিল। কয়েক দিন ধর্মঘট পালনের পর গত রাতে আমরা আলোচনায় বসে সমস্যার প্রায় সমাধান করে ফেলেছিলাম। পরে শোনা গেল সাভারে এক দুর্ঘটনার মামলায় ঢাকার ৫ নম্বর জজ কোর্টে এক ট্রাকচালকের ফাঁসির রায় হয়েছে।বিক্ষুব্ধ শ্রমিকরা এখন অনির্দিষ্টকালের কর্মবিরতিতে গেছে। আমরা বিষয়টি নিয়ে সরকারের সঙ্গে আবার আলোচনায় বসব।এস আলম পরিবহনের ঢাকা অঞ্চলের ইনচার্জ মোহাম্মদ মঞ্জুর মোরশেদ বলেন, পরিবহন শ্রমিকরা ধর্মঘট ডেকেছে, সারাদেশে যান চলাচল বন্ধ। আমরা অসহায়ের মতো এর সঙ্গে আছি। পক্ষেও নাই বিপক্ষেও নাই।তিনি বলেন, এর আগে কখনও এমন সাজা হয়নি। সে কারণে শ্রমিকরা ক্ষিপ্ত। আলোচনার মাধ্যমে এই অচলাবস্থার একটা সমাধান জরুরি।চালকরা রাজি না হওয়ায় সকাল থেকে কোনো গাড়ি চলছে না বলে জানান ইউনিক পরিবহনের মহাব্যবস্থাপক আবদুল হক।আমি কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলেছি। কিন্তু কেউ গাড়ি চালাতে রাজি নয়। এ কারণে গাড়ি বন্ধ।চট্টগ্রাম থেকে কুড়িগ্রাম রুটের সৌখিন পরিবহনের চালক মাসুদুর রহমান হিরণ বলেন, এই রুটে সোমবার থেকেই বাস চলাচল বন্ধ।
বিশ বছর ধরে গাড়ি চালাই। রাস্তায় যদি একটা সাপও পড়ে, তার পরও আমরা সেটাকে বাঁচাতে চাই। কিন্তু এভাবে সাজা দিলে আমরা গাড়ি চালাতে পারব না। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।সকালে ঢাকার সায়েদাবাদে গিয়ে আমাদের নিজস্ব প্রতিবেদক দেখতে পান, বিভিন্ন রুটের গাড়ি ঠায় দাঁড়িয়ে আছে টার্মিনালের ভেতরে। বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরাও সেখানে বাসের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে। অনেকে বাসায় ফিরে গেলেও জরুরি প্রয়োজন থাকায় কেউ কেউ অন্য বাহনের আশায় অপেক্ষা করছেন।সিলেটের পাথর ব্যবসায়ী মো. আলী নেওয়াজ তার স্ত্রী ও ভাতিজিকে নিয়ে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছিলেন। কিন্তু বাস না ছাড়ায় বিপাকে পড়েছেন তিনি।সকাল ৯ টায় আসছি, কোনো লোকাল বাস পেলেই চলে যেতাম, কিন্তু কিছুই পাচ্ছি না। ঢাকায় কোনো থাকার জায়গাও নাই। সোহরাওয়ার্দী কলেজের শিক্ষার্থী আরিফ কুমিল্লা যাওয়ার জন্য সকাল সাড়ে ৭টায় সায়েদাবাদ টার্মিনালে আসেন। কিন্তু বেলা সাড়ে ১২টায়ও গাড়ি পাননি তিনি। বেলা ১১টার দিকে গাজীপুর থেকে আসা বলাকা পরিবহনের একটি বাসকে মহাখালীতে ঘুরিয়ে দেওয়া হয়। ওই বাসের চালক জানান, মহাখালী টার্মিনালের সামনে দিয়ে যেতে দিচ্ছে না।আমাদের যাইতে তো কোনো সমস্যা নাই। কিন্তু টার্মিনালের সামনে দিয়া যাইতে দেয় না।
কুড়িল বাসস্ট্যান্ডে প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পর বাসে উঠেছিলেন মতিঝিলের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আসাদুল হক। মহাখালীতে নামিয়ে দেওয়ায় বিরক্ত তিনিও।ভাই, অনেক সময় দাঁড়াইয়া বাসে উঠতে পারছি। কিন্তু এরপর আবার এইখানে আইসা নামাইয়া দিল। কিভাবে যাই বলেন?গাবতলী থেকেও কোনো বাস ছাড়ছে না। চালকদের কর্মবিরতির কারণে হানিফ পরিবহনের সব বাস বন্ধ রয়েছে বলে জানান হানিফ পরিবহনের মহাব্যবস্থাক মো. মোশাররফ হোসেন।তিনি বলেন, চালকরা গাড়ি চালাচ্ছে না। আমাদের সব বাস টার্মিনালে। কোনো বাস ছাড়তে পারছি না।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ছেলের চিকিৎসা শেষে বাড়ি ফিরতে এসে গাবতলীতে আটকা পড়েন খুলনার হান্নান খান।সকাল ৬টা থেকে কাউন্টারের সামনে অপেক্ষা করেও কোনো গাড়ি না পাওয়ায় ২টার দিকে ট্যাক্সি ভাড়া করে পাটুরিয়া ফেরিঘাটের পথ ধরেন তিনি; সঙ্গে ছিলেন তার স্ত্রী, বাবা ও মা।হান্নান বলেন, ১৭ দিন ছেলের চিকিৎসা শেষে এখন বাড়ি যাচ্ছি। ধর্মঘট না কর্মবিরতি কিসের কারণে যেন বাস যাচ্ছে না। হাসপাতালে থাকার সময় যেসব কাপড়চোপড় ছিল সেগুলোও সাথে আছে। সকাল থেকে কিভাবে যে সময় পার করছি, আপনাকে বোঝাতে পারব না।
মায়ের অসুস্থতার খবরে আর মেয়ের এসএসসি পরীক্ষার কারণে বাড়ি যাচ্ছিলেন রিকশাচালক আবদুল আজিজ। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে বেলা দেড়টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও সাতক্ষীরার গাড়ি পাননি তিনি।বাড়ির ঝামেলার খবর হুইন্যা বাড়ি যাইতেছিলাম। সকাল থেকে অপেক্ষা করতেছি, মালিক সমিতি বলে হরতাল ডাকছে, কখন গাড়ি ছাড়বে তার ঠিক নাই। অপেক্ষায় আছি, আল্লায় যেভাবে নিয়া যায় যামু।গাবতলীতে ফরিদপুর, পিরোজপুর, বরিশালসহ বিভিন্ন রুটে চলা গোল্ডেন লাইন পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার শেখ আলমগীর হোসেন বলেন, কোম্পানি অর্ডার করছে বাস বন্ধ রাখার, কোনো গাড়ি বাইর হয় নাই আজকে। আমাদের দুই-আড়াইশ গাড়ি বসা।এই কর্মবিরতি পূর্বনির্ধারিত কোনো কর্মসূচি নয় বলে দাবি করেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং ঢাকা জেলা বাস মিনিবাস সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল হক সদু। তার ভাষ্য, শ্রমিকরা অন্য যানবাহন চলাচলে কোনো বাধা দিচ্ছে না।আমার জানামতে কোনো সংগঠন এ ধর্মঘট পালন করে নাই। ড্রাইভাররা কর্মবিরতি করেছে। এখন কেউ যদি গাড়ি না চালায়, আমরা তো জোর করতে পারি না। সবারই তো এটা করার গণতান্ত্রিক অধিকার আছে।
কেরানীগঞ্জ: সকালে পরিবহনশ্রমিকেরা ঢাকা থেকে মাওয়াগামী বাস চলাচলে বাধা দেওয়ায় এই রুটে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ আছে। এ ছাড়া সকাল নয়টার দিকে পুরান ঢাকার রাইসাহেব বাজার ও বংশাল এলাকায় পরিবহনশ্রমিকেরা যান চলাচলে বাধা দেন। এ কারণে সদরঘাট-গুলিস্তান রোডে যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। সকাল সাড়ে নয়টার দিকে রাজধানীর কমলাপুর এলাকা, মুগদা ও সায়েদাবাদ এলাকা থেকেও কোনো বাস ছেড়ে যায়নি।মুগদা থেকে মতিঝিলগামী বাহন পরিবহনের যাত্রী কাওছার আহমেদ বলেন, সকাল সাড়ে নয়টার দিকে তিনি বাসে করে মতিঝিল যাচ্ছিলেন। বাসটি কমলাপুর রেলস্টেশনের দিকে পৌঁছালে পরিবহনশ্রমিকেরা বাধা দিয়ে যাত্রীদের নামিয়ে দেন। এতে তিনিসহ ওই বাসের যাত্রীরা চরম দুর্ভোগে পড়েছেন। ঢাকা থেকে মাওয়াগামী গাঙচিল পরিবহনের চালক সিরাজ উদ্দিন মিয়া বলেন, গুলিস্তান থেকে মাওয়া যাওয়ার পথে বাসশ্রমিকেরা বাধা দেন। এ কারণে পথে যাত্রীরা বাস থেকে নেমে যান।
নারায়ণগঞ্জ: সকাল থেকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ রুটে বাস চলাচল বন্ধ করে দিয়েছেন পরিবহনশ্রমিকেরা। এ ছাড়া ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে। নগরের বাস টার্মিনাল এলাকায় বিভিন্ন বাস পার্কিং করে রাখা হয়েছে। ১ নম্বর রেলগেট এলাকার বিভিন্ন বাস কাউন্টারগুলো তালা বন্ধ রয়েছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করে যানবাহন মিলছে না। ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা।বাসের জন্য অপেক্ষমাণ যাত্রী জোবায়ের হোসেন ও আহম্মেদুল করিম বলেন, হঠাৎ করে পূর্ব ঘোষণা ছাড়া বাস চলাচল বন্ধ করে দেওয়ায় তারা ভোগান্তিতে পড়েছেন। কিন্তু তাঁদের ঢাকা যাওয়া জরুরি। বাসের জন্য অপেক্ষমাণ নারী জ্যোৎস্না বেগম বলেন, তিনি স্বামী ও ছয় বছরের মেয়েসহ গ্রামের বাড়ি সিরাজগঞ্জ যাবেন। বাস কাউন্টারে এসে দেখেন ধর্মঘট। আজ বাড়িতে যেতে না পারলে আবার অফিস থেকে ছুটি নেওয়া যাবে না।নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক পুলিশের সার্জেন্ট মো. শরফুদ্দিন ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তবে ধর্মঘট ডাকা বেশ কয়েকজন বাসচালক নিজেদের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলেন, চালকেরা তো ইচ্ছে করে দুর্ঘটনা ঘটান না।
চট্টগ্রাম: ধর্মঘটের কারণে চট্টগ্রাম থেকে বিভিন্ন যাত্রাপথে দূরপাল্লার বাস, মিনিবাস, হিউম্যান হলার ও ট্রাক চলাচল বন্ধ রয়েছে। নগরের অক্সিজেন মোড় ও বহদ্দারহাট বাস টার্মিনাল থেকে সকাল থেকে কোনো দূরপাল্লার গাড়ি ছাড়েনি। যানবাহনের অভাবে রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়েছিলেন বিভিন্ন গন্তব্যের যাত্রীরা।চট্টগ্রাম থেকে সকালে চকরিয়ার গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হন তরুণ ছলা মং। নগরের বহদ্দারহাট টার্মিনালে গিয়ে জানতে পারেন গাড়ি চলছে না। তখন তিনি আবার ফেরত আসেন।অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) দেবদাস ভট্টাচার্য বলেন, পরিবহন ধর্মঘট শান্তিপূর্ণভাবে চলছে। কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি।
রাজশাহী : সকাল থেকে রাজশাহীতে বাস ধর্মঘট চলছে। রাজশাহী জেলা মোটর শ্রমিক ইউনিয়ন এ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে। রাজশাহী থেকে আজ সকালে কোনো রুটে বাস ছেড়ে যায়নি।রাজশাহী শ্রমিক ইউনিয়নের সহদপ্তর সম্পাদক মেরাজুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাই না আমাদের হাতে একটা পিঁপড়াও মরুক। দুর্ঘটনা দুর্ঘটনাই। কিন্তু ওই সড়ক দুর্ঘটনার মামলায় চালক জামিরের যাবজ্জীবন কারাদ- হয়েছে। আমরা এই রায়ের প্রতিবাদ ও নিন্দা জানাই। আমরা জামিরের মুক্তি চাই। মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন চলবে।
মাদারীপুর : মাদারীপুরে পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে পরিবহনশ্রমিক সংগঠনগুলো। গতকাল সোমবার সকাল ছয়টা থেকে শুরু হওয়া এ ধর্মঘট এখনো চলমান রয়েছে। এতে মাদারীপুর জেলা ও উপজেলায় বাস-ট্রাকসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। এ ধর্মঘটের কারণে বরিশাল, খুলনা, চট্টগ্রাম ও ঢাকা বিভাগের সঙ্গে সড়কপথে সব ধরনের যোগাযোগব্যবস্থা বন্ধ রয়েছে।এ ধর্মঘটের কারণে ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। অনেককে রিকশা, ইজিবাইক বা বিকল্প যানবাহনে করে গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে দেখা গেছে। এ সুযোগে বাড়তি ভাড়া আদায় করছেন রিকশা ও ইজিবাইকের চালকেরা। এসএসসি পরীক্ষার্থী রফিকুল জানায়, পরীক্ষা দিতে যাব কিন্তু কোনো গাড়ি পাচ্ছি না। সময়মতো পরীক্ষার কেন্দ্রে যাওয়াটা জরুরি। তার ওপরে বাড়তি ভাড়া আরেকটা বোঝা মনে হচ্ছে।মাদারীপুর সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জিয়াউর মোর্শেদ বলেন, সকালে পরিবহনশ্রমিকেরা রাস্তা অবরোধ করে টায়ার জ¦ালিয়ে ধর্মঘট শুরু করেছেন।মাদারীপুর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সহসভাপতি ফাইজুল শরিফ বলেন, আমাদের দাবি না মেনে নিলে শ্রমিকেরা আরও কঠোর আন্দোলনের ডাক দেবেন। জামির হোসেনের মুক্তি দিলে ধর্মঘট প্রত্যাহার করা হবে।
চুয়াডাঙ্গা : চুয়াডাঙ্গায় সড়ক পরিবহনশ্রমিকদের ডাকে অনির্দিষ্টকালের পরিবহন ধর্মঘট আজও চলছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহনশ্রমিক ফেডারেশনের ধর্মঘটের সপ্তম দিনে আজ চুয়াডাঙ্গা জেলা থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ পথে কোনো যান চলাচল করেনি।সাতক্ষীরা : পরিবহন ধর্মঘটের কারণে সাতক্ষীরার ভোমরা বন্দরের স্বাভাবিক কার্যক্রম প্রায় অচল হয়ে পড়েছে। বন্দরে পাঁচ শতাধিক ট্রাক আটকে রয়েছে।সাতক্ষীরা ভোমরা কাস্টমসের যুগ্ম কমিশনার কাজী ফরিদউদ্দিন বলেন, ধর্মঘটের কারণে পাঁচ শতাধিক পণ্যবাহী ট্রাক আটকে রয়েছে বন্দর এলাকায়। এতে প্রতিদিন প্রায় দেড় কোটি টাকার রাজস্ব ক্ষতি হচ্ছে।সাতক্ষীরা বাস টার্মিনালে খুলনা যাওয়ার জন্য অপেক্ষমাণ সদর উপজেলার পায়রাডাঙ্গা গ্রামের মোনায়েম সরদার ও আবদুর রশিদ বলেন, ভিসা নিতে তাঁরা খুলনা যাবেন। কিন্তু পরিবহন ধর্মঘটের কারণে তাঁরা ভোগান্তিতে পড়েছেন।বাংলাদেশ শ্রমিক ফেডারেশনের সাতক্ষীরা জেলা শাখার যুগ্ম সম্পাদক শাহিনুল ইসলাম বলেন, কেন্দ্র থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের কোনো নির্দেশনা না পাওয়ায় আজও ধর্মঘট চলছে। সাতক্ষীরা জেলা বাসা ও মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি আবু আহমেদ বলেন, ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও শ্রমিকদের বিরোধের কারণে কোনো ধরনের যান চলাচল করছে না।বরিশাল : সকাল থেকে দূরপাল্লা ও অভ্যন্তরীণ রুটে বাস চলাচল বন্ধ রাখা হয়েছে। মাইক্রোবাস চলাচলও বন্ধ রয়েছে। এতে দুর্ভোগে পড়েছেন যাত্রীরা।
সিরাজগঞ্জ: জেলার কেন্দ্রীয় এম এ মতিন বাস টার্মিনাল হয়ে জেলার কোথাও যাত্রীবাহী কোচ চলাচল করছে না। সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ রয়েছে। নগরবাড়ি-বগুড়া মহাসড়কের উল্লাপাড়া রেলস্টেশন এলাকায় শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে সব ধরনের ট্রাক চলাচল বন্ধ করে দেয়। এ সময় ক্ষুব্ধ শ্রমিকেরা কয়েকটি ট্রাক ভাঙচুর করে। ঢাকা-বগুড়া, বনপাড়া-হাটিকুমরুল মহাসড়কে দু একটি প্রাইভেটকার ও মাইক্রোবাস ছাড়া কোনো যানবাহন চলাচল করেনি।জেলা মোটরশ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আনসার আলী জানান, আমাদের দাবি না মানা পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।
চাঁদপুর : চাঁদপুর থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেটসহ অন্তত ২০টি রুটে সব ধরনের যাত্রীবাহী বাস চলাচল বন্ধ রয়েছে।চাঁদপুরের পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার বলেন, ধর্মঘটের কারণে সড়ক পথের যাত্রীদের কিছুটা সমস্যা হলেও চাঁদপুর থেকে রেলপথ ও নৌ পথে চলাচল সুবিধা থাকায় যাত্রীদের তেমন দুর্ভোগে পড়তে হচ্ছে না।নান্দাইল (ময়মনসিংহ) : ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাসড়কে সব ধরনের যানবাহন চলাচলে শ্রমিকেরা বাধা সৃষ্টি করছেন বলে ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। সড়কজুড়ে একধরনের অরাজকতা চললেও প্রশাসন কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন যাত্রীরা।
মহাসড়কের নান্দাইল চৌরাস্তা, নান্দাইল বাসস্ট্যান্ড ও কানুরামপুর এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, লাঠি হাতে নিয়ে শ্রমিকেরা অবস্থান নিয়ে সব ধরনের যানবাহন আটকাচ্ছেন। উৎপল কুমার দাস নামে এক যাত্রী বলেন, বাস না থাকায় ৫০ কিলোমিটার রাস্তা চরম দুর্ভোগ সহ্য করে শিশুসহ পরিবারের সদস্যদের নিয়ে ময়মনসিংহ থেকে নান্দাইলে এসেছেন। এমন অরাজকতা চললেও কেউ কিছু বলছেন না।
কুষ্টিয়া: আলমডাঙ্গা উপজেলার হারদি গ্রাম থেকে ফাতেমা খাতুন (৩২) সোমবার বিকালে ট্রেনে করে এসেছিলেন জেলা সদর হাসপাতালে চিকিৎসক দেখাতে। মঙ্গলবার বিকালে আবার ট্রেন আসার অপেক্ষায় বসে আছেন স্টেশনে।তিনি বলেন, “যত দুর্ভোগ আমাগে ঘাড়ে আইসে পড়ে। কুষ্টিয়া-আলমডাঙ্গায় চলে একটি মাত্র ট্রেন। তাও বিকেল সাড়ে ৪টায়। কাইল বিয়ালে আইছি। আইজ বিয়ালের জন্যি স্টেশনে বইষে রইছি।সদর উপজেলার গট্টিয়া গ্রামের কাঁচামাল বিক্রেতা ইউসুফ আলী বিকল্প পরিবহন স্যালো ইঞ্জিনচালিত ভটভটিতে সবজি বোঝাই করে ধর্মঘটের আওতামুক্ত ঈশ্বরদী যাচ্ছিলেন।
কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগ শেষ বর্ষের ছাত্র আকিমুল ইসলাম রাজবাড়ির বহরপুর গ্রামের বাড়ি যাবেন। বাস বন্ধ থাকায় সকাল থেকে অপেক্ষা করে আছেন বিকল্প পথ ট্রেনের আশায়। কিন্তু মাত্রাতিরিক্ত ভিড়। ট্রেনে তিলধারণের জায়গা নেই। বেলা ১১টার ট্রেনে উঠতে পারেননি। বসে আছেন বিকেলের ট্রেন ধরতে।তিনি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বলেন, নাগরিক জীবনের সর্বশেষ আশ্রয়স্থল বিচার বিভাগ। বিচারের রায়ে সংশ্লিষ্ট পক্ষ ক্ষুব্ধ হতেই পারে। তার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় অনেক পথ খোলা আছে। সেই পথে না গিয়ে এভাবে ধর্মঘটে জনজীবনকে জিম্মি করে বিচারের রায় বদলে দেওয়ার চেষ্টা কোনোভাবেই সমাধানের পথ হতে পারে না।
ঝিনাইদহ:আবদুর রশিদ চাকরি করে ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলায় সহকারী কৃষি কর্মকর্তা পদে।তিনি তার ভোগান্তির কথা বললেন ।মাগুরা থেকে প্রথমে মাহেন্দ্র করে হাটগোপালপুর আসি। সেখান থেকে ইজিবাইকে ঝিনাইদহ শহর, তারপর আরেক ইজিবাইকে শৈলকুপা।এভাবে আসতে তার অন্যদিনের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি খরচ হয়েছে বলে জানালেন।এমনিতে বাসে লাগে ৪০ টাকা। আজ খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ টাকা।তবে ইজিবাইককেও লাঠিসোটা নিয়ে পরিবহন শ্রমিকরা বাধা দিচ্ছেন জেলার বিভিন্ন জায়াগায়। ঝিনাইদহ শহরের আরাবপুর বাসস্ট্যান্ড ও বাস টার্মিনালে গিয়ে কোনো ধরনের যান দেখা যায়নি।
দিনাজপুর: সকাল ১০টায় দিনাজপুর কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে ছবি তুলতে গেল শ্রমিকরা তেড়ে আসেন। তারা ছবি তুলতে বাধা দেন। এ সময় কয়েকজন শ্রমিক চিৎকার করে বলতে থাকেন, সাংবাদিকদের লেখালেখির কারণে চালকদের সাজা হয়েছে। যশোর রেলস্টেশন: পথে বারখাদায় ধর্মঘট বাস্তবায়নকারীরা ট্রলি উল্টে দিলে রাস্তার পাশে খাদে পড়ে যান বলে অভিযোগ করেন।তিনি বলেন, আর্থিক ক্ষতির মুখে পরবর্তীতে মালামাল কেনাবেচার মূলধনই শেষ হয়ে গেল।
সিলেট: মেয়েকে দেখতে এসে আটকা পড়েছেন বগুড়ার আফসানা বেগম। তার মেয়ে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়েন।তিনি বলেন, দুশ্চিন্তাটা বিশেষত এ কারণে যে কবে ধর্মঘট শেষ হবে তা কেউ বলতে পারছেন না। চরম ভোগান্তিতে পড়েছি।ধর্মঘটের কারণে তিনি টার্মিনাল থেকে আবার মেয়ের কাছে ফিরে যাচ্ছেন।আফসানা রেগে বলেন, “কথায় কথায় ধর্মঘট ডাকার অভ্যাস হয়েছে বাঙালির।সিলেট নগরীতে যান চলাচল স্বাভাবিক থাকলেও কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার কোনো যান ছেড়ে যায়নি। তবে বিচ্ছিন্নভাবে কিছু অটোরিকশা ও হালকা যান চলাচল করতে দেখা গেছে।কদমতলী কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল, হুমায়ুন রশিদ চত্বর ও চ-ীপুল এলাকায় পিকেটিং করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।সিলেট জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি সেলিম আহমদ ফলিক জানান, সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দুই চালকের সাজার প্রতিবাদে কেন্দ্রঘোষিত কর্মসূচি পালন করা হচ্ছে। বিষয়টির সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত ধর্মঘট চলবে।বেনাপোল: বাসচালক আব্দুল খালেক ও রতন মিয়া জানান, আদালতের দেওয়া বাসচালকের যাবজ্জীবন কারাকান্ডবাতিল না করা পর্যন্ত পরিবহন ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে।কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক জহির রায়হান বলেন, বিষয়টি নিয়ে সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে আলাপ-আলোচনা চলছে। খুব শিগগিরই সমাধান হবে বলে আশা করছি।