র‌্যাবের কয়েকজন ব্যক্তি জনসাধারণের সঙ্গে মিশে নারায়ণগঞ্জে আলোচিত হত্যাকান্ড ঘটিয়েছেন, এর দায় তাঁদের। তাঁরা উচ্চাভিলাষী জায়গা থেকে ঘৃণ্যতম অপরাধটি সংঘটিত করেছেন। তাঁদের দ্বারা র‌্যাবের মান-সম্মান ক্ষুণœ হলেও সার্বিকভাবে বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হয়নি। নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত এসব কথা বলেছেন। নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সংবাদ সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত প্রেস ব্রিফিংয়ে সরকারি কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী খোকন আদালতের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে রোববার দুপুরে এসব কথা জানান।

১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুনের মামলায় পাঁচ বাহিনীর সাবেক ১৬ কর্মকর্তা, সদস্যসহ ২৬ জনের মৃত্যুদন্ডের আদেশ দিয়েছেন আদালত। মৃত্যুদন্ড প্রাপ্ত আসামিদের অন্যতম হলেন সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র‌্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা।রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেছেন, একটি শৃঙ্খলিত বাহিনীর কিছুসংখ্যক দুষ্কৃতকারী, কিছুসংখ্যক রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সন্ত্রাসীর দ্বারা হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। এখানে নূর হোসেন একজন চিহ্নিত সন্ত্রাসী ও গডফাদার, অপরজন নিহত প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলাম সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন। আধিপত্য বিস্তার নিয়ে এই দুজনের দ্বন্দ্বের জের ধরে এই হত্যাকান্ড সংঘটিত হয়েছে। একজন প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামকে হত্যা করতে গিয়ে নিরীহ ছয়জন মানুষ র‌্যাব সদস্য ও নূর হোসেন বাহিনীর দ্বারা নির্মম হত্যার শিকার হয়েছেন।

আদালতের রায়ের পর্যবেক্ষণ তুলে ধরে ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, র‌্যাব একটি শৃঙ্খলিত বাহিনী। এই বাহিনীর অনেক সুনাম ও সুখ্যাতি এই দেশে আছে। সন্ত্রাসবিরোধী থেকে আরম্ভ করে জঙ্গি দমন, মাদক নির্মূলসহ বিভিন্ন অর্জন রয়েছে এই বাহিনীর। কিন্তু এদের যে কয়েকজন ব্যক্তি এই ঘটনার জন্য জনসাধারণের সঙ্গে মিশে এ হত্যাকা- ঘটিয়েছেন, এর সমস্ত দায়দায়িত্ব তাঁদের। তাঁরা উচ্চাভিলাষী জায়গা থেকে ঘৃণ্যতম অপরাধটি সংঘটিত করেছেন। তাঁদের দ্বারা র‌্যাবের মান-সম্মান ক্ষুণœ হলেও সার্বিকভাবে র‌্যাব বাহিনীর সুনাম ক্ষুণœ হয়নি। র‌্যাব জাতির একটি শৃঙ্খলিত বাহিনী, তাদের গৌরব উজ্জ্বল ভূমিকা রয়েছে। আদালত তাঁর পর্যবেক্ষণে র‌্যাবকে প্রশংসাও করেছেন। আবার তিরস্কার দিয়েছেন। যাতে করে ভবিষ্যতে র‌্যাব বাহিনীতে এই ধরনের উচ্চাভিলাষী, ঘৃণ্যতম অপরাধের সঙ্গে যুক্ত হতে পারেÑএমন ব্যক্তিদের বাহিনীতে নিয়োগ দেওয়ার জন্য সতর্ক রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।সরকারি কৌঁসুলি ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, তাঁরা আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের সময় যেসব অভিযোগ এনেছিলেন, সেই অভিযোগগুলো সন্দেহাতীতভাবে রাষ্ট্রপক্ষ প্রমাণ করেছে। যাঁরা এই হত্যাকা-ের শুরু থেকে শেষ অবধি পর্যন্ত প্রত্যক্ষভাবে জড়িত, সেই ২৬ জনকে মৃত্যুদন্ড দন্ডিত করেছেন। আর নয়জনের মধ্যে যে সাতজন অপহরণের সঙ্গে জড়িত, তাঁদের ১০ বছর করে কারাদন্ড দিয়েছেন এবং ৫০ হাজার টাকা করে জরিমানা করেছেন। দুজনকে আলামত নষ্ট ও ধ্বংস করার চেষ্টার অভিযোগে সাত বছর করে সশ্রম কারাদন্ড প্রদান এবং ২৫ হাজার টাকা করে অর্থ দন্ড করেছেন। এই রায়ের কপি উচ্চ আদালতে যাওয়ার পরে ডেথ রেফারেন্স শুনানি শেষে পর্যায়ক্রমে কার্যক্রম হবে। সেখানেও আসামিদের বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায় বহাল থাকবে বলে ওয়াজেদ আলী খোকন প্রত্যাশা করেন।সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে ওয়াজেদ আলী খোকন বলেন, র‌্যাবের যাঁরা এই ঘটনা ঘটিয়েছেন, তাঁদের তিরস্কৃত করেছেন আদালত। ওই সব পদে নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।আইনজীবী ওয়াজেদ আলী খোকন বলেছেন, সাত খুনের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় তাঁর স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে একটি মামলা এবং নিহত আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়ির চালক ইব্রাহীম হত্যার ঘটনায় তাঁর জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে অপর একটি মামলা দায়ের করেছেন।

প্যানেল মেয়র নজরুল ইসলামসহ পাঁচজনকে হত্যার ঘটনায় সেলিনা ইসলাম বিউটির মামলায় শাস্তির ঘোষণা করেছেন আদালত। অপর নিহত আইনজীবী চন্দন সরকার ও তাঁর গাড়িচালক ইব্রাহীম হত্যার মামলায় একই সাজা ঘোষণা করেছেন আদালত।আদালত রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেছেন, দুটির মামলার রায় হলেও আসামিরা সাজা ভোগ করবেন একসঙ্গে। একই দিন থেকে সাজার গণনা শুরু হবে। যাঁরা পলাতক আছেন, গ্রেপ্তারের দিন থেকে অথবা স্বেচ্ছায় আত্মসমর্থন করলে সেদিন থেকে তাঁদের সাজা গণনা শুরু হবে। প্রেস ব্রিফিং শেষে সাত খুন মামলার রায়ের কপি, জুডিশিয়াল রেকর্ড, সিডিসহ বিভিন্ন নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়েছে বলে জানান ওয়াজেদ আলী খোকন। ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল বেলা দেড়টার দিকে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ভেসে ওঠে ছয়টি লাশ। পরদিন মেলে আরেকটি লাশ। নিহত অন্যরা হলেন নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, গাড়িচালক জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম।