ঢাকার মোহাম্মদপুরে পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় হামলার অন্যতম পরিকল্পনাকারী জঙ্গি নেতা মারজানের সঙ্গে নিহত হয়েছেন উত্তরাঞ্চলের আর এক শীর্ষ জঙ্গি সাদ্দাম। জাপানি নাগরিক ওসি কুনিও হত্যাকাণ্ডসহ বেশ কয়েকটি হত্যার ঘটনার মূল নায়ক সাদ্দাম। সে মোট ১০টি মামলার আসামি। কিলিং মিশনের জঙ্গিরা যে অস্ত্র ব্যবহার করতো সেগুলো সাদ্দামের হেফাজতে রাথা হতো বলে জানান পুলিশ কর্মকর্তারা।
কে এই সাদ্দাম
২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার সারাই ইউনিয়নের আলুটারী গ্রামে জাপানি নাগরিক ওসি কুনিওকে হত্যার মাধ্যমে কিলিং মিশন শুরুর ঘোষণা দেয় নব্য জেএমবি। এই হত্যাকাণ্ডের মূল নায়ক হিসেবে উল্লেখ করা হয় সাদ্দামকে। ওই হত্যাকাণ্ডে দায়ের করা মামলায় চার্জশিটভুক্ত আসামিও ছিল সে। তার বিরুদ্ধে আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানাও জারি রয়েছে।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, সাদ্দাম নব্য জেএমবির উত্তরাঞ্চলের অন্যতম শীর্ষ জঙ্গি। উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলে নব্য জেএমবি যে সব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তার বেশিরভাগের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল সে। সাদ্দাম জঙ্গিদের কাছে বেশ কয়েকটি নামে পরিচিত ছিল। জাপানি নাগরিক হত্যা মামলার চার্জশিটে তার ৪টি নাম দেওয়া হয়েছে। আসল নাম সাদ্দাম হোসেন ছাড়াও রাহুল, চঞ্চল, সবুজ ও রবি নামেও পরিচিতি ছিল জঙ্গিদের কাছে। সে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নাম ব্যবহার করতো। চার্জশিট অনুয়ায়ী, সাদ্দামের বাবার নাম আলম মিয়া ওরফে জোলা, মায়ের নাম সুফিয়া বেগম। বাড়ি কুড়িগ্রাম জেলার রাজারহাট উপজেলার চর বিদ্যানন্দ গ্রামের দোতলা মসজিদের কাছে।
ভয়ঙ্কর জঙ্গি ছিল সাদ্দাম!
জাপানি নাগরিক ওসি কুনিও হত্যা মামলার চার্জশিটে পুলিশ উল্লেখ করেছে, ওই ঘটনায় গ্রেফতার হওয়া ও কিলিং মিশনে অংশ নেওয়া জঙ্গি মাসুদ রানা আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছিল, জেএমবির মূল উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ইসলামকে প্রতিষ্ঠিত করা। যারা ‘ইসলাম ও শরিয়তবিরোধী কাজ’ করতো তাদের ‘সঠিক পথে’ আসার জন্য বলা হতো। না হলে তাদের দলীয় নির্দেশে হত্যা করা হতো। বিদেশি নাগরিক হত্যার মাধ্যমে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য তাদের প্রতি হাইকমান্ডের নির্দেশ ছিল। দেশকে অস্থিতিশীল করতে পারলে দেশের অর্থনীতি ভেঙে পড়বে এবং তখন দেশে ‘ইসলামিক অভ্যুত্থান’ করা সহজ হবে মনে করেই তারা বিদেশি নাগরিকদের হত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এরই অংশ হিসেবে জঙ্গি সাদ্দাম জাপানি নাগরিককে হত্যার পরিকল্পনা করে। সে তার কয়েক সহযোগীকে সঙ্গে নিয়ে হত্যার ৮/১০ দিন আগে থেকে ওসি কুনিও’র গতিবিধি ও চলাচলের উপর নজরদারি শুরু করে।
এমনকি ওসি কুনিওকে হত্যার ৩ দিন আগে ২০১৫ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর তার বাড়ির সামনে একটি চায়ের দোকানে অবস্থান নিয়েও গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে সাদ্দামের নেতৃত্বে জঙ্গিরা। এরপর ঘটনার আগের দিন জঙ্গি সাদ্দাম তার সহযোগী জঙ্গি মাসুদ রানাকে নগরীর মাহিগঞ্জ এলাকার সাতমাথা এলাকায় আসতে বলে। পরের দিন ২০১৫ সালের ৩ অক্টোবর সাদ্দামের নির্দ্দেশ ও পরিকল্পনা অনুযায়ী জঙ্গি বাইক হাসান, মাসুদ রানা ও বিজয় মোটরসাইকেলে করে আলুটারী গ্রামে ওসি কুনিওকে গুলি করে হত্যা করে।
পুলিশের দাখিল করা চার্জশিট পর্যবেক্ষণ করে জানা যায় জাপানি নাগরিককে হত্যার এক মাস আগে থেকে জঙ্গি সাদ্দামের নেতৃত্বে নগরীর নুরপুর এলাকায় বাসা ভাড়া নিয়ে সেখানে অবস্থান করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে। পুলিশের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান জঙ্গি সাদ্দাম উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির শীর্ষ নেতা। কিলিং মিশনের জঙ্গিরা যে অস্ত্র ব্যবহার করতো সেগুলো সাদ্দামের হেফাজতে রাখতো। তাকে উত্তরাঞ্চলের নব্য জেএমবির সামরিক কমান্ডার বলে পুলিশ মনে করতো।
এ ছাড়াও ২০১৫ সালের ১০ নভেম্বর রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার টেপামধূপুর গ্রামে আওয়ামী লীগ নেতা ও স্থানীয় মাজারের খাদেম রহমত আলী হত্যা মামলারও চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিল সাদ্দাম। ওই ঘটনার মূল পরিকল্পনাকারী ছিল সে। জাপানি নাগরিক হত্যা ঘটনার পর জঙ্গি মাসুদ রানা আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেওয়ার সময় পুলিশ সাদ্দামের নাম জানতে পারে।
সাদ্দামকে ধরার করার জন্য পুলিশ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়েও তাকে গ্রেফতার করতে পারেনি। তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুলিশের শীর্ষ স্থানীয় এক কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গি সাদ্দাম জেএমবির প্রথম সারির নেতা ছিলেন। দেশে সাম্প্রতিককালে জেএমবি যতগুলো কিলিং অপারেশন পরিচালনা করেছে তার বেশিরভাগেরই মূল পরিকল্পনাকারী ও অস্ত্রের যোগানদাতা ছিল সে। সাদ্দাম পঞ্চগড়ে মন্দিরের পুরোহিত হত্যাসহ রংপুর বিভাগে বিভিন্ন কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশ নিয়েছে। ফলে সাদ্দাম নিহত হওয়ার ঘটনা পুলিশের জঙ্গিবিরোধী অভিযানে একটা বড় সাফল্য বলেই মনে করছেন তারা।’
রাজধানীর মোহম্মদপুরে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত সাদ্দাম হোসেন ওরফে রাহুল ছিল উত্তরবঙ্গের নব্য জেএমবির প্রধান। ১০টি মামলার আসামি ছিল সাদ্দাম। এর মধ্যে পাঁচটি মামলার চার্জশিটভুক্ত আসামি ছিল সে। মামলাগুলো হলো, রংপুরে ওসিও কুনিও, রহমত আলী খাদেম, বাহাই রুহুল আমিন, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জ মঠের প্রধান এবং কুড়িগ্রাম হোসেন আলী হত্যা মামলার।
ওই পাঁচটি মামলা ছাড়াও গাইবান্ধার ডাক্তার দিপ্তী, সাঘাটের রাব্বি হত্যা, গোবিন্দগঞ্জের তরুণ দত্ত হত্যা, নীলফারীর কারবালার খাদেম হত্যা চেষ্টা ও দিনাজপুরের চিরিরবন্দরের ডাক্তার বিরনদ্র হত্যার চেষ্টা মামলার আসামি ছিল সাদ্দাম।
দেবীগঞ্জ থানার ওসি সুকুমার মোহন্ত জানিয়েছেন, সাদ্দামের বাড়ি কুড়িগ্রামের রাজারহাট থানার চর বিদ্যানন্দ গ্রামে। তার বাবার নাম পাচু আলম ও মা জোবেদা খাতুন। যদিও কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেছেন, সাদ্দামের বাড়ি গাইবান্ধায়।