আততায়ীর গুলিতে নিহত আওয়ামী লীগদলীয় সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজায় অংশ নিয়ে বর্বর এ হত্যাকান্ডের তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছেন সরকার ও বিরোধীদলীয় সংসদ সদস্যরা। তারা মন্ত্রীদের মতো এমপিদেরও ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়েছেন। সোমবার সকালে জাতীয় সংসদ ভবনের দণি প্লাজায় লিটনের জানাজায় অংশ নিয়ে এ দাবি জানান সংসদ সদস্যরা। জানাজা শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লিটনের মরদেহে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণের মাধ্যমে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। শোকার্ত শেখ হাসিনা প্রথমে সরকারপ্রধান হিসেবে ও পরে দলীয় নেতাদের নিয়ে দলীয় প্রধান হিসেবে মরদেহে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন। পরে তিনি নিহতের পরিবারের সদস্যদের সান্ত¡না দেন। এ সময় পুরো দণি প্লাজাজুড়ে এক শোকাবহ পরিবেশের সৃষ্টি হয়।
প্রধানমন্ত্রী ছাড়াও শ্রদ্ধা নিবেদন করেন রাষ্ট্রপতির পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল সারোয়ার হোসেন, স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, ডেপুটি স্পিকার মো. ফজলে রাব্বী মিয়া, হুইপদের সঙ্গে নিয়ে চিফ হুইপ আ স ম ফিরোজ, জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষে বিরোধীদলীয় হুইপ মো. নূরুল ইসলাম ওমরসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। এ সময় উপস্থিত ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, গৃহায়ণ ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, সড়ক পরিবহনমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, রেলমন্ত্রী মুজিবুল হক, নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, বস্ত্র প্রতিমন্ত্রী মির্জা আজম, সংসদ সদস্য মাহাবুব-উল আলম হানিফ, জাহাঙ্গীর কবির নানক, বি এম মোজাম্মেল হক, শামীম ওসমানসহ আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মী এবং সংসদ সচিবালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।এ সময় সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানান গাইবান্ধা থেকে নির্বাচিত সংসদ সদস্য ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়া। জাতীয় সংসদ ভবনে সোমবার গাইবান্ধা-১ আসনের সংসদ সদস্য মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের জানাজা শেষে একই জেলার আরেক আসনের এই সাংসদ সাংবাদিকদের একথা জানান।ফজলে রাব্বী বলেন, আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে সব সংসদ সদস্যের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার কথা জানিয়েছি। প্রধানমন্ত্রী নিশ্চয় আমাদের সঙ্গে একমত পোষণ করে এমপিদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তার ব্যবস্থা করবেন।খ্রিস্টীয় বছরের শেষ দিন সন্ধ্যা রাতে গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে মতাসীন দলের সাংসদ লিটনকে তার বাড়ির বৈঠকখানায় ঢুকে গুলি করে পালিয়ে যায় আততায়ীরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু ঘটে।
এর আগে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে বিরোধী দলে থাকার সময় গুলি করে ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যকে হত্যা করা হয়।২০০৪ সালের ৭ মে গাজীপুরের টঙ্গীর নোয়াগাঁও এম এ মজিদ মিয়া উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে এক জনসভায় এলোপাতাড়ি গুলি চালিয়ে শ্রমিক নেতা ও গাজীপুরের সাংসদ আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা করা হয়।পরের বছরই ২৭ জানুয়ারি হবিগঞ্জ সদরের বৈদ্যের বাজারে ঈদপরবর্তী এক জনসভা শেষে বের হওয়ার পথে গ্রেনেড হামলায় নিহত হন আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এ এম এস কিবরিয়াকে।
দুটি হত্যাকান্ডের মামলায় প্রধানত বিএনপি নেতাদের আসামি করা হয়। এর মধ্যে আহসান উল্লাহ মাস্টারকে হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত পেরিয়ে হাই কোর্টের রায়ে বিএনপি নেতা নুরুল ইসলাম সরকারসহ ছয়জনের মৃত্যুদন্ড বহাল রয়েছে।অন্যদিকে কিবরিয়া হত্যার ঘটনায় অভিযোগপত্রভুক্ত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, দলটির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সাবেক রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সিলেট সিটি কর্পোরেশনের সাময়িক বরখাস্ত হওয়া মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী, হবিগঞ্জের পৌরসভার সাময়িক বরখাস্তকৃ হওয়া মেয়র ও জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জি কে গউছ ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ মোট ৩২ জনের বিচার চলছে।লিটনকে কারা মেরেছে, সেই বিষয়ে এখনও স্পষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। লিটনের বোন রোববার রাতে অজ্ঞাতনামা পাঁচজনকে আসামি করে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন।
আওয়ামী লীগের নেতারা এই হত্যাকা-ের পেছনে জামায়াতে ইসলামীর হাত রয়েছে বলে সন্দেহ করলেও দলটি তা অস্বীকার করে পাল্টা অভিযোগ করেছে, প্রকৃত খুনিদের আড়াল করতেই তাদের উপর দোষ চাপানো হচ্ছে। সোমবার সংসদ ভবনের জানাজার আগে গাইবান্ধা- ৫ আসনের সংসদ সদস্য ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, অপরিণত বয়সে লিটনের মৃত্যু হয়েছে। এটা জামাত-শিবিরের চক্রান্ত।
গোলাম আজমকে সুন্দরগঞ্জের মাটিতে নামতে দেয়নি লিটন। এই দোষের শিকার হল লিটন।সংসদ সদস্যদের নিরাপত্তায় গানম্যানের ব্যবস্থা করা হবে কি না এই প্রশ্নের জবাবে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুব-উল-আলম হানিফ সাংবাদিকদের বলেন, জনপ্রতিনিধিদের তাদের নির্বাচনী এলাকায় যেতে হয়। বিভিন্নভাবে জনগণের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে হয়। এজন্য জনপ্রতিনিধিদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এমপিরা নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছেন। অনেকেই ব্যক্তিগত নিরাপত্তা চেয়ে আবেবদনও করেছেন। কেউ কেউ নিরাপত্তা রী নিয়েছেন। কিন্তু সব সদস্যদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।এতে এমপিরা জনবিচিছন্ন হয়ে পড়বেন কিনা- জানাতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা নিরাপত্তা নিয়ে চলছি না? মন্ত্রীরাও তো চলছেন। নিরাপত্তা সবার আগে। এমপি লিটন হত্যাকা-ের নিন্দা জানিয়ে তিনি বলেন, আমি এটাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখছি না। এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকান্ড। আমার ঘরে ঢুকে সন্ত্রাসীরা হত্যা করে পালিয়ে যাবে, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাজ কি?হত্যাকান্ডের সঙ্গে জামাত-শিবির জড়িত দাবি করে ডেপুটি স্পিকার বলেন, তিনি (লিটন) ছিলেন স্পষ্টভাষী, যে কারণে জামায়াত-শিবির তাঁকে ভয় পেত। একসময় গোলাম আজম সুন্দরগঞ্জে জনসভা করতে চেয়েছিল, কিন্তু এমপি লিটন করতে দেননি। এমনিক চেষ্টা করেও গোলাম আজম সেখানে পা রাখতে পারেনি। সেখান থেকেই তাঁর প্রতি একটা আক্রোশের শুরু। দ্রুত ঘটনার সঙ্গে জড়িতরা গ্রেপ্তার হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। জানাজা শেষে লিটনের কর্মময় জীবনের স্মৃতিচারণ করেন সরকারদলীয় সংসদ সদস্য মাহাবুব-উল আলম হানিফ ও বিরোধীদলীয় সদস্য নূরুল ইসলাম ওমর। তাঁরাও সংসদ সদস্যদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দাবি জানান।
এ সময় তীব্র ােভ প্রকাশ করেন এমপি লিটনের ভগ্নিপতি আনন্দ গ্র“পের চেয়ারম্যান ড. আবদুল্লাহেল বারী। তিনি বলেন, জামায়াত-শিবির ও জঙ্গিগোষ্ঠী এ ঘটনা ঘটিয়েছে। এই মোল্লা ও উগ্রবাদীদের অস্তিত্ব মুছে ফেলতে প্রয়োজনে আনন্দ গ্র“পের সব সম্পত্তি ব্যবহার করা হবে। জানাজা পরিচালনা করেন জাতীয় সংসদ সচিবালয় মসজিদের পেশ ইমাম মাওলানা মো. নূরুল ইসলাম।
জানাজা শেষে মরহুমের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে মোনাজাত করা হয়। সকাল ১০টায় জানাজার জন্য লিটনের মরদেহ দণি প্লাজায় আনা হয়। জানাজা শেষে সুন্দরগঞ্জ পাঠানোর জন্য কফিন বিমানবন্দরে নেওয়া হয়।গত শনিবার গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জে বাড়িতে ঢুকে লিটনকে গুলি করে পালিয়ে যায় দুর্বৃত্তরা। রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু ঘটে।রংপুর থেকে হেলিকপ্টারে করে রোববার লিটনের লাশ আনা হয় ঢাকায়। হাসপাতালের হিমঘর থেকে সোমবার সকালে কফিন নেওয়া হয় সংসদ ভবনের দণি প্লাজায়। লিটন হত্যাকান্ডের প্রতিবাদে গত দুদিন ধরে সুন্দরগঞ্জে হরতাল চলছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ডাকে। লিটনকে কারা মেরেছে, সেই বিষয়ে এখনও স্পষ্ট তথ্য জানাতে পারেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সন্দেহভাজন ১৮ জনকে আটক করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।লিটনের বোন রোববার রাতে সুন্দরগঞ্জ থানায় একটি মামলা করেছেন। তাতে অজ্ঞাতনামা পাঁচজনকে আসামি করা হয়েছে।