আজ ১১ ডিসেম্বর ২০১৬, রবিবার, সকাল ১১টায় জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআইপি লাউঞ্জে গণসংহতি আন্দোলন কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির উদ্যোগে ‘মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক এক গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জননেতা জোনায়েদ সাকির সভাপতিত্বে উক্ত গোলটেবিল বৈঠকে নির্বাহী সমন্বয়কারী আবদুস সালাম গণসংহতি আন্দোলনের লিখিত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। গোলটেবিল বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক, বিশিষ্ট কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্কসবাদী)-এর নেতা শুভ্রাংশু চক্রবর্তী, অধ্যাপক স্বপন আদনান, নৃবিজ্ঞানী প্রশান্ত ত্রিপুরা, অধ্যাপক তানজিমউদ্দীন খান, গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টির সাধারণ সম্পাদক মোশরেফা মিশু, বাংলাদেশের ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগের সাধারণ সম্পাদক মোশাররফ হোসেন নান্নু, লেখক-শিল্পী অরূপ রাহীসহ বিশিষ্ট নাগরিক ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ।
সৈয়দ আবুল মকসুদ মিয়ানমারে জাতিগত সহিংসতার চিত্র তুলে ধরে বলেন, অং সান সুকীর নীরবতা গণহত্যাকে অনুমোদন করার সামিল। প্রতিবেশী হিসেবে বাংলাদেশের মানবিক দায়িত্ব রোহিঙ্গাদের রক্ষায় ব্যবস্থা নিতে মিয়ানমারকে চাপ প্রদান করা। বাংলাদেশ এই দায়িত্ব পালন না করলে একাত্তরের শরণার্থীদের প্রতি অবমাননা হবে।
অধ্যাপক আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেন, শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় না দিলে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবেই রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। ফলে তাদেরকে সনাক্ত করা ও ফেরত পাঠানো আরও কঠিন হবে।
অধ্যাপক স্বপন আদনান বলেন, রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুরা একদিকে অবৈধ অনুপ্রবেশকারী হিসেবে হয়রানির শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে তাদেরকে সস্তায় শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করছে মাছব্যবসায়ী, কাঠব্যবসায়ী ও মাদক চোরাকারবারীরা।
অধ্যাপক তানজিম উদ্দীন খান বলেন, অভিবাসন একটা বাস্তবতা। কয়েকশত বছর ধরে যারা মিয়ানমারে বাস করছেন, তাদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়ার কোন যুক্তি থাকতে পারে না।
অধ্যাপক প্রশান্ত ত্রিপুরা তার বক্তব্যে উদ্বাস্তু হিসেবে ভারতে যেতে বাধ্য হবার স্মৃতিচারণ করে বলেন, নাগরিকত্বহীন রোহিঙ্গাদের পরিস্থিতির অভিজ্ঞতা পার্বত্য চট্টগ্রামের জাতিগোষ্ঠীগুলোর রয়েছে। অরূপর রাহী বলেন, প্রতিটি জাতির তার নিজের পরিচয়েই বাস করার, নাগরিকের অধিকার পাবার অধিকার রয়েছে। রোহিঙ্গাদের এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না। সভাপতির বক্তব্যে জোনায়েদ সাকি বলেন, মিয়ানমারের রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুদের রক্ষায় গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো নিশ্চুপ থাকলে এই গণহত্যা বন্ধ হবে না। বরং মৌলবাদী শক্তিগুলো এই সুযোগ গ্রহণ করবে, দেশের মাঝে সাম্প্রদায়িক অস্থিরতা যেমন সৃষ্টি হবে, সীমান্তেও স্থায়ী নৈরাজ্য হিসেবে এটা থেকে যাবে। বাংলাদেশের কর্তব্য জাতিসংঘ, প্রতিবেশী দেশসমূহও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাকে নিয়ে একটা সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা। বাংলাদেশ সরকারকে এই উদ্যোগ গ্রহণে বাধ্য করা গণতান্ত্রিক আন্দোলনের কর্তব্য।
* গণসংহতি আন্দোলনের গোলটেবিলে উত্থাপিত লিখিত প্রস্তাব নিচে যুক্ত করা হয়েছে।
গোলটেবিল আলোচনা
১১ ডিসেম্বর ২০১৬, ভিআইপ লাউঞ্জ জাতীয় প্রেসক্লাব
মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর গণহত্যা ও বাংলাদেশের করণীয়
১. রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন/আরাকান রাজ্যের অধিবাসী গত ৬০০ বছর ধরে। তারা রোসেঙ্গে নামক স্থানে বসবাস করত বলেই তাদের নাম রোসিঙ্গা থেকে রোহিঙ্গা হয়েছে। রোহিঙ্গারা নানাভাবে বিভিন্ন নিপীড়নের শিকার আগেও হলেও ১৭৮৪ সালে বর্মীদেও আরাকান দখলের পর থেকে তাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চলে আসছে তীব্র মাত্রায়। এতদিনেও যে রোহিঙ্গারা তাদের নাগরিকত্ব পায়নি সেটাই আসলে তাদের ওপর জাতিগত নিপীড়নের একটা সুস্পষ্ট উদাহরণ। সারা বিশ্বেরই তাদের জাতিগত অধিকার ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া জরুরি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের অধিবাসী এবং সেখানকার নাগরিক। তাদের সেখানে নিজ ধর্ম, সংস্কৃতি, জীবন যাপন পদ্ধতি অনুসরণ করে বাঁচার পূর্ণ অধিকার আছে এবং তার পক্ষে বাংলাদেশসহ সারা দুনিয়ার সোচ্চার অবস্থান নেওয়া দরকার।
২. রোহিঙ্গা জাতিগোষ্ঠীর ওপর বর্তমানে যে গণহত্যা চলছে সেটা সুস্পষ্টভাবে সাম্প্রদায়িক গণহত্যা। সেখানে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পাইকারিভাবে উচ্ছেদ করা হচ্ছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হচ্ছে, মেরে ফেলা হচ্ছে, নারীদের ধর্ষণ করা হচ্ছে। মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী সরাসরি এই গণহত্যা পরিচালনা করছে। এই গণহত্যা বন্ধ করতে অবিলম্বে আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক বিভিন্ন রাষ্ট্র শক্তির রাজনৈতিক ও ক’টনৈতিক জোরদার ভুমিকা ও হস্তক্ষেপ জরুরি। রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত করতে যে উচ্ছেদ অভিযান চলছে তাকে কোনোক্রমেই সফল হতে দেয়া যাবে না।
৩. বাংলাদেশের জন্য এই সমস্যা কেবলমাত্র কোনো নৈতিক/মানবিক ভূমিকা রাখায় নয়। বরং রোহিঙ্গারা মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত হয়ে বাংলাদেশেই আসছে শরণার্থী হিসেবে, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের এখানে সুনির্দিষ্ট ভূমিকা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাও প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের প্রায় ১ কোটি মানুষ ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় নিয়েছিল। সেসময় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলাদেশের বাঙালিরা আসলে হিন্দুয়ানি সংস্কৃতির অনুসারী ও ভারতীয় এ-রকম কথা বলে তাদের ভারতেই থেকে যাবার প্রস্তাব দিয়েছিল। একইভাবে বর্তমানে মিয়ানমারের শাসকগোষ্ঠীও রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশী হিসেবে বাংলাদেশেই স্থায়ী হবার প্রস্তাব দিচ্ছে। ১৯৭১ সালে ভারত রাষ্ট্রের শক্ত ভূমিকার কারণে তারা এ বিষয়ে এগোতে পারে নি। তারা শরণার্থীদের গ্রহণ করেছে কিন্তু সেটা যে সাময়িক ব্যবস্থা তা মনে করিয়ে দিতে ভোলে নি এবং আন্তর্জাতিকভাবে প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। বর্তমানে বাংলাদেশ রাষ্ট্র এক্ষেত্রে তার কাক্সিক্ষত ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। এক্ষেত্রে আমরা নিম্নোক্ত ব্যবস্থাবলীর প্রস্তাব করছিÑ
ক. মিয়ানমারে সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত আক্রমণের কারণে মানবিক বিপর্যয়ের শিকার রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর গণহত্যার বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী মতামত গড়ে তুলতে এবং অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধ করতে বাংলাদেশকে বলিষ্ঠ ভূমিকা নিতে হবে। প্রয়োজনে মিয়ানমারে কী ঘটছে তা তদন্ত করার জন্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার রক্ষায় সক্রিয় প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তা নিয়ে এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ও বিশেসজ্ঞ ব্যক্তিদেও নিয়ে একটি কমিশন গঠন করা এবং ঘটনাবলী অনুসন্ধান করে এ বিষয়ে প্রতিবেদন আন্তর্জাতিক সকল ফোরামে উত্থাপন করা।
খ. রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে পাইকারীভাবে জঙ্গি, চোর, ডাকাত ইত্যাদি নানাভাবে চিিহ্নত করার হীন সাম্প্রদায়িক ও জাতিবিদ্বেষমূলক প্রচার বন্ধ কওে শরণার্থী হিসাবে যারা প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে এদেশে আসছে তাদের যথাযথ সরকারি নজরদারির অধীনে এখানে সাময়িকভাবে মানবিক আশ্রয় প্রদান করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহায়তার আহ্বান জানাতে হবে।
গ. সকল আন্তর্জাতিক আইন ও প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাধ্যমে মিয়ানমারের রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে তাদের নিজস্ব আবাসস্থলে ফিরিয়ে নেয়া এবং তাদের নাগরিকত্ব ও গণতান্ত্রিক অধিকারের নিশ্চয়তা বিধানে মিয়ানমারকে বাধ্য করতে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দফতরকে কার্যকর ও সক্রিয় ভ’মিকা গ্রহণ করতে হবে।
৪. বর্তমানে আমরা দেখতে পাচ্ছি সরকারের নীতি হচ্ছে শরণার্থী গ্রহণ না করা। কিন্তু নানাভাবে শরণার্থীরা বাংলাদেশ ঢুকে পড়ছে। ইতিমধ্যেই এই দফায় প্রায় ১০০০০ শরণার্থী বাংলাদেশেম ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থা আসলে বিপজ্জনক। কেননা যদি রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী সরকারের শরণার্থী গ্রহণের নীতির মধ্য দিয়ে প্রবেশ করতো তাহলে তারা সরকারের তদারকি ও নজরদারির মধ্যে থাকতো। এখন তারা তা থাকছে না। ফলে তারা সহজেই বিভিণœ স্বার্থান্বেষী মহলের সহজ শিকারে পরিণত হয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকা-ের হাতিয়ার হতে পারে। এমতাবস্থায় তাদের বাংলাদেশে আগমন একটা সুনির্দিষ্ট নীতির মাধ্যমে হওয়া জরুরি। আরেকটি বিষয় খুবই লক্ষণীয়Ñরোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ধর্মীয় পরিচয়ের দিক থেকে মুসলমান। ফলে বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের ভেতর ধর্ম পরিচয়ের দিক থেকে তাদের প্রতি সহানুভূতি থাকাও স্বাভাবিক। সে কারণেই রোহিঙ্গা ইস্যুকে সরকার যথাযথভাবে মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে তাকে ব্যবহার করে যেকোনো সাম্প্রদায়িক শক্তি তা দেশের সাম্প্রদায়িক পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর ক্ষেত্রে ব্যবহার করতে পারে।
এমতাবস্থায় রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সমস্যাকে জরুরি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা আবশ্যক। আশা করি আপনারা সকলে আমাদের এই প্রাথমিক প্রস্তাবের ওপর আলোচনার মাধ্যমে একে পূর্ণাঙ্গ করতে এবং এই সমস্যা সমাধানের জন্য একটা নির্দেশনা আকারে তাকে তৈরি করতে এই আলোচনায় সক্রিয় অংশগ্রহণ করবেন।