তামাক কোম্পানীগুলোর বিভিন্ন ধরনের প্রলোভন ও কৃষি বিভাগের উদাসীনতার কারণে লালমনিরহাটে দিন দিন বেড়ে চলেছে তামাক চাষ। আর তামাক কোম্পানীগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। তামাক চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে কোম্পানীগুলোর পক্ষ থেকে অগ্রিম দেওয়া হচ্ছে সার ও নগদ টাকা। দীর্ঘদিন যাবত তামাকের পরিবর্তে বিকল্প ফসল চাষের দাবী এখানকার কৃষকদের হলেও কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে তেমন কোন সাড়া না পাওয়ায় অনেকটা বাধ্য হয়ে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়েছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা। ফলে দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে জমির উর্বরতা। আর তামাক চাষের ফলে দেখা দিচ্ছে নানা ধরনের রোগ ব্যধি।
অনুসন্ধানে জানাগেছে, লালমনিরহাটের আদিতমারীতে ঢাকা টোব্যাকো ও ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর পক্ষ থেকে তামাক চাষের শুরতেই কোম্পানীর পক্ষ থেকে বিনামূল্যে বীজ, কীটনাশক ও বীজতলা রক্ষার জন্য সরবরাহ করা হয় পলিথিন। এমনকি কোম্পানীগুলোর পক্ষ থেকে উঠান বৈঠকও করা হয়। সেখানে কৃষকদের তামাক চাষে বিভিন্ন ধরনের পরামর্শ দিয়ে থাকেন মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা। কিন্তু এখানকার কৃষকদের দীর্ঘদিনের দাবী তামাকের বিকল্প ফসল চাষের। কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে বিকল্প ফসল চাষের তেমন কোন তৎপরতা না থাকায় অনেকটা বাধ্য হয়ে তামাক চাষ করছেন এ অঞ্চলের কৃষকরা।
সুত্র মতে, একই জমিতে একাধিকবার তামাক চাষ করায় জমির উর্বরতা হারিয়ে যাচ্ছে। আবার তামাক চাষের ফলে কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে পড়ছে নানা ধরনের রোগ ব্যধি। সারপুকুর ইউনিয়নের সবদল গ্রামের তামাক চাষী সিহাব উদ্দিন জানান, তামাক চাষে লাভ বেশী ঠিকই কিন্তু তামাক তোলার পর বাড়ির সবারই কম বেশী চিকিৎসা করাতে অনেক টাকা খরচ হয়ে যায়। তিনি তামাকের বিকল্প ফসল চাষের দাবী জানান। একই কথা বলেন, ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের নজরুল ইসলামও।
সরেজমিন ঘুরে কথা বলে জানাগেছে, তামাক চাষের জন্য ঢাকা টোব্যাকোর পক্ষ থেকে একর প্রতি এক বস্তা এসওপি ও ২ বস্তা টিএসপি সার অগ্রিম দেয়া হচ্ছে। কিন্তু এ সারের দাম এখনও নির্ধারণ করা হয়নি কোম্পানীর পক্ষ থেকে। কৃষকদের দাবী, তামাক বিক্রি করার সময় তারা ইচ্ছে মত দাম জোরপূর্বক আদায় করে থাকেন। আর এ নিয়ম দীর্ঘদিন যাবত চলে আসছে। কেউ প্রতিবাদ করলে তার কার্ডটি বাতিল করা হবে বলে তারা দাবী করেন। তবে কোনভাবেই তারা নাম প্রকাশ করতে রাজি হননি।
এদিকে এলাকার কতিপয় দালালচক্র রয়েছে। এদের প্রশ্রয়ে কোম্পানীগুলোর কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন এখানকার কৃষকরা। উপজেলা সদরের বুড়িরবাজারে রয়েছে এ সিন্ডিকেট। প্রতিদিন সকাল হলে কোম্পানীর মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এখানে এসে বসে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করেন। এরপর ছুটে চলেন বিভিন্ন গ্রামে। শুধু তাই নয়, এ সিন্ডিকেটে নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এলাকা নিরীহ কয়েক শতাধিক কৃষক।
শুধু ঢাকা টোব্যাকো কোম্পানীই নয়, বিট্রিশ আমেরিকান টোব্যাকোর পক্ষ থেকে তামাক চাষের জন্য কৃষকদের ব্যাংকের মাধ্যমে এক থেকে দেড় হাজার টাকা করে অগ্রিম দেয়া হচ্ছে। আবার এ টাকা থেকে বাধ্যতামূলক ৫শ টাকা করে ব্যাংকে গচ্ছিত রাখতে হচ্ছে কৃষকদের।
ঢাকা টোব্যাকোতে সার নিতে আসা মহিষখোচা ইউনিয়নের বারঘড়িয়া গ্রামের রফিকুল ইসলাম, ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের নজরুল ইসলাম, সারপুকুর মসুরদৈলজোড় গ্রামের মহেন্দ্র নাথ রায় জানান, একর প্রতি ৩ বস্তা করে অগ্রিম সার দেয়া হচ্ছে। ঢাকা ট্যোবাকো থেকে ২ বস্তা আর সাপ্টিবাড়ি থেকে এক বস্তা সার নিতে হচ্ছে। তারা দাবী করেন, অনেকটা নিরুপায় হয়ে তামাক চাষ করতে হচ্ছে তাদের। তারা তামাকের বিকল্প ফষল চাষে সরকারের প্রতি জোর দাবী জানান। সেই সাথে কৃষি বিভাগকে বিকল্প ফসল চাষে এগিয়ে আশারও আহবান জানান তারা।
একটি সূত্র মতে, গত বছরের তুলনায় এবছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ করা হচ্ছে। গত বছর তামাক চাষে কৃষকরা লাভবান হওয়ায় এবছর রেকর্ড পরিমাণ জমিতে তামাক চাষ হবে বলে জানাগেছে। তবে কৃষি বিভাগ কৃষকের এ তথ্য মানতে নারাজ। তবে কি পরিমাণ জমিতে এবছর তামাকের চাষাবাদ করা হবে সেই তথ্য তারা জানাতে পারেননি।
আদিতমারীতে অবস্থিত ঢাকা ট্যোবাকো কোম্পানীর ডিপোতে কয়েক দফা যোগাযোগ করেও সংবাদকর্মী পরিচয় জানার পর কোন কর্মকর্তা কথা বলতে রাজি হননি। আদিতমারী উপজেলা কৃষি অফিসার বিপ্লব কুমার মোহন্ত জানান, তামাকের বিকল্প ফষল চাষের জন্য কৃষকদের বিভিন্ন মিটিং সভায় বলা হয়ে থাকে। এছাড়াও তামাকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরা হয়ে থাকে কৃষকদের মাঝে। তিনি দাবী করেন, যে পরিমাণ তামাক চাষে খরচ হয়, সমপরিমাণ অর্থ খরচ করলে অন্যান্য ফসলে লাভবান হতে পারবেন এখানকার কৃষকরা। দিন দিন তামাক চাষ বেড়ে চলেছে এ এলাকায়, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, তামাক চাষ বেড়ে চলেছে নয়, দিন দিন কমে যাচ্ছে।
মোঃ ইউনুস আলী, লালমনিরহাট পপ্রতিনিধি