নির্যাতন থেকে প্রাণ বাঁচাতে মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা এখনো বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত অনুপ্রবেশের সময় কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত থেকে ১৯ জন রোহিঙ্গা ও টেকনাফে নাফ নদী থেকে রোহিঙ্গাবাহী ১১টি নৌকা ফেরৎ পাঠিয়েছে বিজিবি।মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমন-নির্যাতন থেকে বাঁচতে রোহিঙ্গারা বেশ কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় বুধবার রাত থেকে বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত কক্সবাজারের উখিয়া সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করে রোহিঙ্গারা।এ সময় তাদের ১৯ জনকে মিয়ানমারে ফেরৎ পাঠিয়ে দেয় বিজিবি। এদের মধ্যে ৯জন শিশু ও পাঁচ জন নারী রয়েছে।টেকনাফে নাফ নদীর বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় রোহিঙ্গাদের বহনকারী ১১টি নৌকা সীমান্তের জিরো পয়েন্ট থেকে ফেরত পাঠিয়ে দেয়া হয়।প্রতিটি নৌকায় ১২ থেকে ১৫ জন করে রোহিঙ্গা ছিল বলে জানিয়েছে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি)। অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সীমান্তের নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও বান্দরবানের বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় রোহিঙ্গাদের বহনকারী ১১টি নৌকা ও অন্তত ১৩০ জনকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি।বৃহস্পতিবার ভোরে উখিয়ার বালুখালী ও থাইংকালী, টেকনাফের নাফ নদী ও বান্দরবানের ঘুমধুম সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে তাদের আটক করা হয় বলে বিজিবির কর্মকর্তারা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষাবাহিনীর তিনটি নিরাপত্তা চৌকিতে ‘বিচিছন্নতাবাদীদের’ হামলা ঘটনার পর দেশটির সেনাবাহিনীর অভিযানের মুখে রোহিঙ্গারা পালিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিজিবির কক্সবাজার ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেনেন্ট কর্নেল ইমরান উল্লাহ সরকার জানান, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমারের ১৯ জন রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের চেষ্টা চালায়। এ সময় বিজিবির টহলদল তাদের ফেরত পাঠায়।বিজিবির টেকনাফ ২ ব্যাটালিয়নের উপ-অধিনায়ক মেজর আবু রাসেল সিদ্দিকী বলেন, নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে ১১টি নৌকায় করে রোহিঙ্গারা অনুপ্রবেশের চেষ্টার সময় বিজিবির টহল দলের বাধার মুখে ফেরত গেছে।প্রতিটি নৌকায় ১০ থেকে ১২ জন করে অন্তত ১১০ জন রোহিঙ্গা ছিলেন বলে জানান তিনি। গত ২১ অক্টেবর থেকে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত নাফ নদীর বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের সময় রোহিঙ্গাদের বহনকারী অন্তত ৮০টি নৌকা বিজিবি ফিরিয়ে দিয়েছে বলে রাসেল জানান।তবে তারপরও নারী ও শিশুসহ বহু রোহিঙ্গা শরণার্থী বিভিন্ন পথে বাংলাদেশে ঢুকছে বলে সংবাদমাধ্যমে আসা খবরে বলা হচ্ছে।
এদিকে,বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ-বিজিবি ও কোস্ট গার্ড সক্রিয় রয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল।বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের এক অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন।আর যারা বাংলাদেশের সীমানার ঢুকে গেছে মানবিক দিক বিবেচনা করে তাদের চিকিৎসা সেবা ও থাকতে দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।তবে শিগগিরই আলোচনার মাধ্যমে একটা সুবিধাজনক সময়ে তাদের ফেরত পাঠানোর ব্যবস্থা নেয়া হবে বলে মন্তব্য করেন মন্ত্রী।এ সময় মন্ত্রী বলেন, আন্তর্জাতিক সকল সংস্থাকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে মিয়ানমারে শান্তি বজায় রাখতে অনুরোধ জানানো হয়েছে।এসময় দেশে রোহিঙ্গা প্রবেশ বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান তুলে ধরেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।দেশে আড়াই লাখের মতো বসবাসকারী পাকিস্তানি রিফিউজি ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে আন্তর্জাতিক ফোরাতে সরকার জোরালো দাবি তুলে আসছে বলেও মন্তব্য করেন মন্ত্রী।ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর এবং সেভ দ্য চিল্ড্রেন বাংলাদেশ যৌথভাবে অগ্নি নির্বাপন, বিধ্বস্ত ভবনে অনুসন্ধান ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনাসহ প্রাথমিক চিকিৎসা বিষয়ে তিনশো জন স্বেচ্ছাসেবককে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। এসব প্রশিক্ষানার্থীদের মধ্যে সনদ বিতরণী অনুষ্ঠান আয়োজন করে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তর।
এদিকে, মিয়ানমার থেকে কমপক্ষে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে দাবি করছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা।ব্যাংককে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার মুখপাত্র ভিভিয়ান ট্যান বলেন, সেখানকার পরিস্থিতি খুবই অনিশ্চিত এবং পালিয়ে আসা শরণার্থীর প্রকৃত সংখ্যা এর চেয়ে বেশি হতে পারে।শরণার্থীরা যাতে বাংলাদেশে ঢুকতে না পারেÑ সে জন্যে সীমান্তে বাংলাদেশ তাদের নিরাপত্তা জোরদার করেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শরণার্থীদের আবার মিয়ানমারে ফেরত পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ। তারপরও কয়েক হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী বাংলাদেশে ঢুকে পড়েছে বলে বাংলাদেশ সরকারের কাছে তথ্যপ্রমাণ রয়েছে।বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম বুধবার এ বিষয়ে বেনারকে বলেন, জাতিসংঘের সংখ্যাটা ভুল বলা যাবে না। বেশ কিছু রোহিঙ্গা করেছে, সংখ্যাটি সুনির্দিষ্ট করা না গেলেও তা অনেক। পালিয়ে আসাদের মধ্যে অত্যন্ত মানবতের অবস্থার নারী, শিশু ও আহতরা রয়েছেন, যাদের মানবিক কারণে আমরা ফেরত পাঠাইনি।’
এদিকে, জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনানের দপ্তর (ওএইচসিএইচআর) বিবৃতি দিয়েছে, মিয়ানমারের রোহিঙ্গারা খুব সম্ভবত মানবতাবিরোধী অপরাধের’ শিকার। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে মিয়ানমার সরকারের আচরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের মতোই।তাদের ওপর সহিংসতার ধরণ মানবতাবিরোধী অপরাধের শামিল বলে গণ্য করার সম্ভবনা বাড়িয়ে তুলেছে।আর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় আসা রোহিঙ্গারা বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপও ব্যবহার করেছে। গানশিপ, সেনা, বিজিপি, মগ যুবকদের হামলা, নৃশংসতা আর বিভীষিকা তারা ভুলতে পারছে না।বার্তা সংস্থা এএফপি বলেছে, রাখাইন রাজ্যে সরকারি বাহিনীর নির্যাতনে প্রায় ৩০ হাজার রোহিঙ্গা মুসলিম ঘরছাড়া হয়েছে। হাজার হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশের জন্য সীমান্তে জড়ো হয়েছে। সেনাবাহিনী ওই রাজ্যে নারী ও শিশুদের ধর্ষণ করছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।এরইমধ্যে রোহিঙ্গাদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করতে এখন মিয়ানমারে রয়েছেন জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান।আগামী এক সপ্তাহ ধরে মিয়ানমারে অবস্থান করে সেখানকার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবেন তিনি।