এরশাদ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম, আসসালামু আলাইকুম।

আপনারা আমার শুভেচ্ছা গ্রহণ করবেন। আজ আমরা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য এই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছি। আপনারা জানেন- ইতোমধ্যে আমাদের বর্তমান নির্বাচন কমিশনের মেয়াদ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। যথাসময়ে নতুন নির্বাচন কমিশন গঠনের সময় এসে গেছে। স্মরণ করে দেখুন- ’৯০ পরবর্তী সময়ে যতগুলো নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়েছে- তার কোনো নির্বাচন কমিশনই বিতর্কমুক্ত ছিলনা। এবারও যে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে- তা নিয়ে গঠনের আগেই বিতর্ক শুরু হয়ে গেছে। এখন যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে- এবং তার জন্য যে পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন নিয়োগ করা হয়- তাতে বিতর্কমুক্ত নির্বাচন হওয়া বা বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠন করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্তত: বিগত ৫টি নির্বাচনের অভিজ্ঞতা সে কথাই বলে। এখন এই পদ্ধতি এবং এই ব্যবস্থায় আগামীতেও অন্তত: মোটামুটি বিতর্কমুক্ত নির্বাচন আমরা আশা করতে পারিনা। এই সংকট থেকে মুক্তির জন্যই আমরা নির্বাচন কমিশন গঠনের সুনির্দিষ্ট কিছু নীতিমালা এবং নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য এই সম্মেলনের আয়োজন করেছি।

প্রাথমিকভাবে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে আস্থা প্রতিষ্ঠা করার প্রথম ধাপ হচ্ছে- স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেয়া। যদি যথাযথ আইনি কাঠামো এবং তার সঠিক বাস্তবায়নের মাধ্যমে যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন পেশাদার ও নিরপেক্ষ ব্যাক্তিবর্গকে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায়- তাহলেই বিতর্কমুক্ত নির্বাচন কমিশন গঠিত হতে পারে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যেসব পদ্ধতিতে নির্বাচন কমিশন গঠন করা হয়- তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ৮টি পদ্ধতির কথা আপনাদের কাছে উপস্থাপন করতে চাই। যেমনঃ

১. উন্মুক্ত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে নিয়োগ
২. অনুসন্ধান কমিটির মাধ্যমে নিয়োগ
৩. সংসদ বা আইন সভার মাধ্যমে নিয়োগ
৪. নির্বাহী প্রধানের মাধ্যমে নিয়োগ (যেমন- প্রধানমন্ত্রীর মাধ্যমে)
৫. রাষ্ট্রপ্রধানের মাধ্যমে নিয়োগ (যেমন- রাজা/রানী/রাষ্ট্রপতি/গভর্নরের মাধ্যমে)
৬. বিচার বিভাগের মাধ্যমে নিয়োগ (যেমন- জুডিসিয়াল সার্ভিস কমিশনের মাধ্যমে)
৭. রাজনৈতিক দলের মাধ্যমে নিয়োগ এবং
৮. একাধিক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে নিয়োগ।

নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আমি কয়েকটি দেশের উদাহরণ আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। যেমন

ভারতঃ ভারতের সংবিধানের ৩২৪(২) অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করা আছেঃ “The appointment of the Chief Election Commissioner and other Election Commissioners shall, subject to the provisions of any law made in that behalf by parliament, be made by the president”. বিভিন্ন সময়ে সরকার কর্তৃক গঠিত বিভিন্ন কমিটি কমপক্ষে তিনবার প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য ফর্মূলা সুপারিশ করলেও ভারতে এতদ্বসংক্রান্ত কোনো আইন নেই। নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য দেশটির আইন মন্ত্রণালয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ফাইল পাঠায় এবং প্রধানমন্ত্রী ঐ ফাইলে রাষ্ট্রপতির বিবেচনার জন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার/নির্বাচন কমিশনারদের নাম প্রস্তাব করেন। সাধারণতঃ রাষ্ট্রপতি প্রস্তাবিত নাম অনুমোদন করেন।

দক্ষিণ আফ্রিকাঃ একজন প্রধানসহ মোট ৫জন সদস্য নিয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার নির্বাচন কমিশন গঠিত হয়। অবশ্যই এই ৫ জনের একজন হবেন বিচারপতি- যাকে প্রেসিডেন্ট সরাসরি নিয়োগ দিয়ে থাকেন। অন্য ৪ জন সদস্য নিয়োগের ক্ষেত্রে ৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি রয়েছে; কমিটির প্রধান হচ্ছেন- সাংবিধানিক আদালতের সভাপতি, অন্য সদস্যবৃন্দ হচ্ছেন- মানবাধিকার কমিশন, জেন্ডার ইকুয়ালিটি ও পাবলিক প্রটেকটরের একজন করে প্রতিনিধি। এ কমিটি কমপক্ষে ৮ জনের একটি তালিকা প্রণয়ন করে Committee of National Assembly on the recruitment of EMB Commissioners এর কাছে পাঠায়। পরে আইন সভায় তর্ক-বিতর্কের পর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের মতামতের ভিত্তিতে ৪ জনের তালিকা তৈরি করে নিয়োগের জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হয়।

কানাডাঃ কানাডায় শুধুমাত্র একজন নির্বাচন কমিশনার থাকেন। তাকে বলা হয় প্রধান নির্বাচনী কর্মকর্তা। ১৯২০ সালে ডোমিনিকান ইলেকশন এ্যাক্ট অনুসারে সিইও নিয়োগের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কানাডার হাউজ অব কমন্স কর্তৃক তিনি ১০ বছরের জন্য নিয়োগ লাভ করেন।

আমেরিকাঃ আমেরিকায় কোনো কেন্দ্রীয় নির্বাচন কমিশন নেই। প্রত্যেক রাজ্যে ভিন্ন ভিন্ন নির্বাচন কমিশন আছে।

এখন আসা যাক আমাদের দেশে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রক্রিয়ার কথায়। বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশন গঠন প্রশ্নে আইনি কাঠামোতে অনেকটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বাংলাদেশ সংবিধানের ১১৮(১) অনুচ্ছেদে- “উক্ত বিষয়ে প্রণীত কোন আইনের বিধানাবলী সাপেক্ষে রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন” কথাটি বলা থাকলেও প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগের কোন যোগ্যতা অথবা নিয়োগ প্রক্রিয়া নিয়ে সংবিধানে কোন কিছু বলা নেই। সংবিধানে উল্লেখ থাকলেও আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংসদ এ ব্যাপারে কোন আইন প্রণয়ন করেনি। আবার সংবিধানের ৪৮(৩) অনুচ্ছেদে বলা আছে “এই সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) দফা অনুসারে কেবল প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের (১) দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন”। এই অনুচ্ছেদে আরো বলা আছে- “তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোন পরামর্শ দান করিয়াছেন কিনা এবং করিয়া থাকিলে কি পরামর্শ দান করিয়াছেন, কোন আদালত সেই সম্পর্কে কোন প্রশ্নের তদন্ত করিতে পারিবে না।” সংবিধানের এই ধারাগুলো বিশ্লেষণ থেকে দেখা যায় ঃ

ক. সংবিধানে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সংক্রান্ত আইন প্রণয়নের কথা বলা থাকলেও বাংলাদেশে এতদ্বসংক্রান্ত কোনো আইন নেই।
খ. রাষ্ট্রপতি- প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশনার নিয়োগের জন্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত;
গ. নিয়োগ প্রক্রিয়া কেমন হবে- অর্থাৎ অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হবে কী-না, উন্মুক্ত বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে কী-না, রাজনৈতিক দলের আলাপ-আলোচনা করে কী-না এ বিষয়ে কোনো নীতিমালা/প্রবিধান/গেজেট নেই;
ঘ. কমিশনারদের যোগ্যতা সংক্রান্ত কোনো নীতিমালা/প্রবিধান/গেজেট নেই;
ঙ. সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগের জন্য প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ গ্রহণ করবেন এবং সে বিষয়ে কোনো আদালত কোনো তদন্ত করতে পারবে না।
সংবিধানের উপরোক্ত বিধানের কারণে বাংলাদেশে মূলত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের সিদ্ধান্তে (solo discretion) প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং অন্যান্য নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়।

আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থাটি চলে আসছে ১৯৩৫ সালের বৃটিশ ভারতের আইন অনুসারে। এই আইনের পরিবর্তন করা প্রয়োজন। নির্বাচন কমিশন গঠনের ব্যাপারে আমাদের প্রস্তাব হচ্ছে-

এক. সংবিধান অনুসারে প্রধান নির্বাচন কমিশনার এবং নির্বাচন কমিশন নিয়োগ সংক্রান্ত একটি আইনি কাঠামো প্রণয়ন করতে হইবে।
দুই. সেখানে নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাখার বিধান রাখতে হবে।
তিন. নির্বাচন কমিশনের আলাদা সচিবালয় থাকতে হবে
চার. বর্তমান সংসদেই এই আইন পাশ করতে হবে
পাঁচ. নির্বাচন কমিশনারদের যেসব যোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা বিবেচনা করতে হবে- তার মধ্যে থাকবেঃ
১. নিরপেক্ষতা (Impartiality)
২. ব্যাক্তিগত একাগ্রতা ও সততা (Personal integrity and fairness)
৩. ন্যুনতম ও সর্বোচ্চ বয়স (Minimum and maximum age)
৪. পেশাগত যোগ্যতা (Professional qualifications)
৫. নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে জ্ঞান (Knowledge of electoral issues)
৬. শারীরিক ও মানসিক সুস্থ্যতা (Physically and mentally healthy)
৭. রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় নয় (Not politically active)
৮. অন্য অফিসে নিয়োগে বিধি-নিষেধ (Bans on holding other office)
৯. চারিত্রিক স্বচ্ছতা (Character requirement)

যদিও আমাদের দেশে নিরপেক্ষ প্রার্থী পাওয়া খুব কঠিন ব্যাপার। নিরপেক্ষ বিবেচনা করা হলেও কার্যত তাকে আর নিরপেক্ষ হিসেবে পাওয়া যায়না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- ভারতের প্রধান নির্বাচন কমিশনার মিঃ টি.এন. সেসন সুষ্ঠু নির্বাচন পরিচালনা করে সমাদৃত হয়েছিলেন। তারপরও বিরোধী দল তাঁকে নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি করেছিল। মিঃ সেসন এখন বিজিপিতে যোগদান করেছেন। তবে নির্বাচন কমিশনের নিয়োগ প্রক্রিয়াকে যদি আমরা একটি আইনি কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে পারি – তাহলেই কেবল কমিশন নিয়োগ বিতর্কমুক্ত হতে পারে।

এবার আসা যাক নির্বাচন পদ্ধতি প্রসঙ্গে। আমরা চলমান নির্বাচন পদ্ধতির পরিবর্তন চাই। নির্বাচন পদ্ধতির সংস্কার ছাড়া সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন আশা করা যায়না। তার কারণ বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হচ্ছে তাতে হাজার চেষ্টা করেও কোনো নির্বাচনকে বিতর্কের বাইরে রাখা যাচ্ছে না। সাধারণত বলা হয় যারা নির্বাচনে হেরে যান, তারাই নির্বাচনের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন, নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ করেন কিংবা নির্বাচনকে ভোট ডাকাতি বা ভোট চুরির নির্বাচন বলে অভিহিত করেন। এ ধরণের অভিযোগের মধ্যে মোটেই যে সত্যতা থাকে না তাও নয়। শুধু যারা বিজয়ী হন কেবলমাত্র তারাই যে নির্বাচনে কারচুপি করেন সে কথাও ঠিক নয়। নির্বাচনে কারচুপি করার পরেও কোনো পক্ষ হেরে যেতে পারে। সুতরাং নির্বাচনে যাতে কারচুপি হতে না পারে অথবা নির্বাচনে কারচুপি করার মতো পরিবেশ যাতে না থাকে, সেই পদ্ধতি আমরা উদ্ভাবন করতে পারি।

বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতি পরিবর্তন সম্ভব কিনাঃ
বর্তমান পদ্ধতিতে দল প্রার্থীকে মনোনয়ন দেয়। রিটার্নিং অফিসারের কাছে প্রার্থীর মনোনয়নপত্র বৈধ বিবেচিত হলে প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। ভোটারগণ প্রার্থীকে সরাসরি ভোট প্রদাণ করেন। এ ক্ষেত্রে জনগণ শুধুমাত্র সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, মন্ত্রী, হুইপ ইত্যাদি পদের নির্বাচনে ভোটারদের কোনো হাত নেই। এটা দলীয় ব্যাপার।

বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতির সমস্যাঃ
বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় তাতে অন্ততঃ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সুষ্ঠু নির্বাচনের ব্যবস্থা করা খুবই দুরূহ ব্যাপার। এই পদ্ধতিতে মাস্তান, কালো টাকার মালিক, অর্থ ও বিত্তের জোরে রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ ব্যক্তিদের দলীয় মনোনয়ন কিংবা নির্বাচনে জিতে আসার সুযোগ রয়ে গেছে। সৎ-বিজ্ঞ, ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা জনপ্রতিনিধি হিসেবে জনসেবা ও দেশসেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। নির্বাচনে হয় অর্থের দাপট নতুবা মাস্তানের দাপট জয়ী হয়। সততা-যোগ্যতা হয় পরাস্ত। সংসদে ব্যবসায়ীদের আধিক্য দেখা যায়। এই হার এখন ৬০/৬৫ ভাগে পৌঁছে গেছে।

নির্বাচনের পরে কী ঘটে? কোটি কোটি টাকা খরচ করে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এসে নির্বাচনী ব্যয়ের হিসাব দাখিল করা হয় নির্বাচন কমিশনের নির্ধারিত অংকের টাকার মধ্যে। অর্থাৎ মিথ্যা দিয়ে শুরু হয় একজন জনপ্রতিনিধির ‘পবিত্র’ যাত্রা। অর্থ আর পেশী শক্তির ফাঁক-ফোকর দিয়ে হয়তো কিছু রাজনীতিক ও অভিজ্ঞ নেতা নির্বাচনে জিতে আসেন। তাদের কারণেই হয়তো সরকার চলতে পারে।

সমস্যা থেকে উত্তরণের উপায়ঃ
সংসদীয় সরকার পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থাই হচ্ছে দলীয় শাসন। আর গণতান্ত্রিক শাসনের মূল কথা হচ্ছে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ব্যবস্থা। কিন্তু বর্তমান নির্বাচন পদ্ধতিতে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার মধ্যেও দেখা যায় অনেক সময় সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন থাকে না। যেমন ১৯৯১ সালের সংসদে ক্ষমতাসীন সরকার মোট কাস্টিং ভোটের মাত্র ৩০ দশমিক ৮১ ভাগ ভোট পেয়ে আসন আধিক্যের কারণে জামায়াতের সমর্থনে সরকার গঠন করতে পেরেছিলো। শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সেই সমর্থন সরকারের প্রতি থাকেনি। তখন আওয়ামী লীগের জোট প্রায় ৩৪ শতাংশ ভোট পেয়েও বিরোধী দলের আসনে গেলো। এক পর্যায়ে ৩০ ভাগ ভোটারের রায় পাওয়া সরকার ৭০ ভাগ ভোটারের প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলোর তীব্র আন্দোলনের মুখেও তার মেয়াদ পূর্ণ করেই ক্ষমতা ছেড়েছে। তবে সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় সরকার গঠনে এ ধরনের অবস্থা সৃষ্টি হতে পারে। এই প্রচলিত ব্যবস্থাই যে সর্বোত্তম তা আমরা মেনে নিতে পারি না। এটা তো ধর্মগ্রন্থ নয় যে, পরিবর্তন বা সংস্কার করা যাবে না। নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের মাধ্যমেই সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব এবং সেটা নিশ্চিত করতে পারলেই সমস্যা থেকে উত্তরণ ঘটানো যেতে পারে।

নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কারের সুনির্দিষ্ট প্রস্তাবঃ

ভোটের আনুপাতিক হারে আসন বন্টন-
সংসদীয় সরকার ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনার পদ্ধতি যখন দলীয় শাসন ব্যবস্থা সে ক্ষেত্রে নির্বাচনও শুধু দলের ভিত্তিতে হতে পারে। অর্থাৎ ভোটারগণ দলকে ভোট দেবেন। সরাসরি প্রার্থীকে নয়। প্রত্যেক দল প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে আনুপাতিক হারে সংসদীয় আসনের সদস্য পাবে। তবে সদস্য পাবার ক্ষেত্রে কোনো রাজনৈতিক দলের কাস্টিং ভোটের মধ্যে ন্যূনতম ভোট পাবার সীমা থাকবে। প্রত্যেক দল নির্বাচনে তাদের প্রার্থী প্যানেল তৈরী করে নির্বাচন কমিশনে জমা দেবে। রাজনৈতিক দলগুলো নিজস্ব ইশতেহার ঘোষণার মতো প্রার্থী তালিকা তৈরী করে দেশবাসীর সামনে উপস্থাপন করবে। তারপর দেশে বিদ্যমান তিনশ’ আসনেই দলগুলো নিজস্ব প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে। যে দল বেশী ভোট পাবে স্বাভাবিকভাবেই সে দল বেশী সংসদ সদস্য লাভ করবে। সে ক্ষেত্রে দলগুলো কেবলমাত্র তাদের প্যানেল থেকে ক্রমিক অনুসারে অথবা দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে প্রার্থী মনোনীত করবে। যদি কোনো দল কাস্টিং ভোটের ৫০ ভাগ পেয়ে যায় তাহলে তারা ১৫০ আসন পাবে। আবার যদি কোনো দল মোট কাস্টিং ভোটের ১ শতাংশ ভোট লাভ করে তাহলে ৩ জন সংসদ সদস্য পাবে। ওই দল তাদের প্যানেল থেকে এই ৩ জন প্রার্থীকে মনোনীত করে দেবে। প্রাপ্ত ভোটের ভগ্নাংশের সুবিধা পাবে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত রাজনৈতিক দল। অবশ্য সংসদীয় আসনের ভিত্তিতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কারণ অনেকে স্বতন্ত্রভাবেও নির্বাচন করতে পারেন। সেক্ষেত্রে উক্ত আসনের মোট কাস্টিং ভোটের ৫০ শতাংশের চেয়ে অন্ততঃ এক ভোট বেশী পেলেই স্বতন্ত্র সদস্য নির্বাচিত হতে পারবেন।

এই পদ্ধতিতে নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে উপ-নির্বাচনের প্রয়োজন হবে না। কোনো দলের সংসদ সদস্য পদত্যাগ করলে বা মৃত্যুবরণ করলে উক্ত দলের প্যানেল থেকেই দল শূন্য আসনে প্রার্থী মনোনীত করবে।

বর্তমান বিশ্বে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পরিচালিত দেশ সমূহের মধ্যে বেলজিয়াম, ডেনমার্ক, নেদারল্যান্ড, সুইডেন, গ্রীস, ফিনল্যান্ড, লুক্সেমবার্গ, নরওয়ে, আয়ারল্যান্ড, ইসরাইল, ফ্রান্স, জাপান ও জার্মানিতে প্রাপ্ত ভোটের ভিত্তিতে সমানুপাতিক হারে প্রতিনিধি নির্বাচিত করার বিধান রয়েছে। আমি এখানে খুব সংক্ষিপ্তভাবে আমার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করলাম।

বর্তমানে দ্বৈত পন্থায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ঃ
আমি জাতীয় নির্বাচনে যে সংস্কারে কথা বলছি- এই পদ্ধতিতে আংশিকভাবে আমাদের দেশেও নির্বাচন হচ্ছে। তা হলো সংরক্ষিত মহিলা আসনের নির্বাচন। সংরক্ষিত মহিলা আসনে সরাসরি নির্বাচন হয় না। বিগত আমলে শুধু সংখ্যাগরিষ্ঠ বা সরকারী দল মহিলা সদস্য পেয়েছে। তারা দলের মনোনয়নে সংসদ সদস্য হয়েছেন। এখন সংসদে প্রতিনিধিত্বকারী সকল দল আনুপাতিক হারে মহিলা সদস্য পাচ্ছে। জনগণ সরাসরি মহিলা সদস্য নির্বাচিত করতে পারেনি বলে তারা কোনো অভিযোগ বা প্রতিবাদ জানাতে যায়নি। দল যাকে মনোনীত করে দিয়েছে জনগণ তাকেই মেনে নিয়েছে। তাহলে আমরা দেখতে পাচ্ছি একই সংসদে দুই পদ্ধতিতে নির্বাচিত সংসদ সদস্য সমান মর্যাদা, সমান সুযোগ-সুবিধা নিয়ে প্রতিনিধিত্ব করছেন।

জনগণ দলীয় সিদ্ধান্তই মেনে নেয়ঃ
আমার প্রস্তাবিত নির্বাচন পদ্ধতি সংস্কার ব্যবস্থায় দলের পক্ষে জনগণের রায় দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিদ্যমান পদ্ধতিতে জাতীয় নির্বাচনে জনগণ শুধুমাত্র সরাসরি ভোট প্রদাণ করে একজন সংসদ সদস্য নির্বাচন করতে পারে। জনগণের হাতে আর কোনো দায়িত্ব থাকে না। দলীয় সিদ্ধান্তে রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে প্রধানমন্ত্রী-স্পীকার-ডেপুটি স্পীকার-মন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী-হুইপ নির্বাচিত হন। এমনকি নির্বাচনে জামানত হারানোর মতো প্রার্থীকেও দল মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত করে। জনগণ দলের এসব সিদ্ধান্ত মেনে নেয়। সুতরাং দল জনগণের রায় পাবার পর সংসদ সদস্য মনোনিত করে দিলেও তারা সে সিদ্ধান্ত মেনে নেবে।

পরিশেষে বলতে চাই বর্তমানে জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার মতো যেসব রাজনৈতিক দল আছে তার নেতৃত্বের মধ্যে সম্ভবত বয়সে আমিই প্রবীণ। তবে প্রাচীন ধ্যান-ধারণা আগলে রাখার পক্ষপাতী আমি নই। সে কারণেই দেশ ও জাতিকে নতুন কিছু দেবার চেষ্টা করি। সমস্যা সৃষ্টি হলেই সমাধানের পথ খোঁজা হয়। আমি উপলব্ধি করেছি বর্তমানে যে পদ্ধতিতে নির্বাচন হচ্ছে তাতে সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও বিতর্কহীনভাবে নির্বাচন হওয়া অসম্ভব। দিন দিন পরিস্থিতি খারাপের দিকে যাচ্ছে।

আমি সমস্যাবলীর কথা উপলব্ধি করে একটা সংস্কারের প্রস্তাব উত্থাপন করলাম। দেশের বিজ্ঞ মহল, সকল রাজনৈতিক দল এটা ভেবে দেখতে পারে। আমি মনে করি, আমার প্রস্তাবের কথা সবাই বিবেচনা করে এ ব্যাপারে একটা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে। এতে নির্বাচনে কালো টাকার ছড়াছড়ি বন্ধ হবে, পেশীশক্তির দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটবে। লাভবান হবেন সত্যিকারের সৎ, অভিজ্ঞ ও ত্যাগী রাজনীতিবিদরা। লাভবান হবেন যারা দলের জন্য কাজ করেন এমন নিবেদিত নেতাকর্মীরা। আমার নতুন সংস্কার প্রস্তাবটি এসেছে একটি বিরাজমান সমস্যা থেকে মুক্তি চেতনার আলোকে। সকল মহল যদি এই প্রস্তাবকে মুক্ত মনে গ্রহণ করে তাহলে হয়তো আশার আলো দেখতে পাবো।

॥ খোদা হাফেজ ॥

হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ
চেয়ারম্যান-জাতীয় পার্টি