bgp

বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের জন্য নাফ নদীর মিয়ানমারের অংশে অপেক্ষারত রোহিঙ্গাদের এই ছবি গত শুক্রবার রাতে তোলা ষ প্রথম আলোমিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনাবাহিনীর দমনপীড়নের কারণে সৃষ্ট মানবিক সংকটে বাংলাদেশ উদ্বেগ জানিয়েছে। অবিলম্বে সেখানকার নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে দেশটিকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।বুধবার দুপুরে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূত মিউ মিন সানকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তলব করে এ উদ্বেগ জানানো হয়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব (দ্বিপক্ষীয় বিষয়াবলি)কামরুল হাসানের কার্যালয়ে তাঁকে তলব করা হয়।বৈঠক শেষে বেরিয়ে কামরুল হাসান সাংবাদিকদের বলেন, ‘রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতের কাছে আমাদের উদ্বেগ তুলে ধরেছি। সেখানকার লোকজনের দেশে ফিরে যাওয়ার পথ নিশ্চিত করতে আমরা তাদের পরিস্থিতির উন্নতি ঘটাতে বলেছি। এ ব্যাপারে রাষ্ট্রদূতের হাতে একটি কূটনৈতিক পত্র দেওয়া হয়েছে।গত মাস থেকে রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা চলছে। সেখানে আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। এ হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে জঙ্গি নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যা, নারী ও শিশুদের নির্যাতন এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।

রাখাইন রাজ্েয দমন-পীড়নের ঘটনায় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশমুখী ঢলে সীমান্তে নতুন সঙ্কট তৈরির প্রেক্ষাপটে ঢাকায় মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে ডেকে উদ্বেগ জানিয়েছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।বাংলাদেশ সরকারের তলবে রাষ্ট্রদূত মিউ মিন্ট থান বুধবার দুপুরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এসে অতিরিক্ত সচিব কামরুল আহসানের সঙ্গে দেখা করেন। কামরুল আহসান পরে সাংবাদিকদের বলেন, যে পরিস্থিতি চলছে তা নিয়ে বাংলাদেশের উদ্বেগের কথা’ মিয়ানমারের রাষ্ট্রদূতকে জানানো হয়েছে।বাংলাদেশে আসা মিয়ানমারের শরণার্থীরা যাতে ফিরে যেতে পারেন, সেজন্য পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে আহ্বান জানানো হয়েছে বলে জানান তিনি।

পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক পরে সাংবাদিকদের বলেন, মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে পরে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দেওয়া হবে।গত ৯ অক্টোবর মিয়ানমারের তিনটি সীমান্ত পোস্টে ‘বিচ্ছিন্নতাবাদীদের’ হামলায় সেদেশের নয় সীমান্ত পুলিশের মৃত্যুর পর আশপাশের এলাকাগুলোয় ব্যাপক ধরপাকড় শুরু হয়। রাখাইন রাজ্যের রোহিঙ্গা-অধ্যুষিত জেলাগুলোয় শুরু হয় সেনাবাহিনীর অভিযান।মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, সেনাবাহিনীর অভিযানে রাখাইন প্রদেশে ১২শ’র বেশি ঘর জ¦ালিয়ে দেওয়া হয়েছে।এ সহিংসতায় ৮৬ জনের মৃত্যুর খবর মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করলেও নিহতদের মধ্েয ৬৯ জনকে সন্দেহভাজন বিচ্ছিন্নতাবাদী বলে দাবি করেছে তারা। মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, নিহতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি।এদিকে দমন অভিযানের মুখে পালাতে থাকা রোহিঙ্গাদের অনেকে নাফ নদী পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে ঢোকার চেষ্টা করছেন। এ প্রেক্ষাপটে সীমান্তে বাড়তি বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে।

গত কয়েক দিনে কয়েকশ রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর কথা জানিয়েছে বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এ বিষয়ে দুই দেশের সীমান্তরক্ষীদের মধ্েয বৈঠকও হয়েছে।তিন দশক ধরে ৫ লাখের বেশি রোহিঙ্গার ভার বহনকারী বাংলাদেশ সরকার নতুন করে শরণার্থী নিতে নারাজ। বারবার আহ্বান সত্ত্বেও আগের শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেওয়ার কোনো উদ্েযাগও নিচ্ছে না মিয়ানমার সরকার।মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে উদ্ভূত এই শরণার্থী সমস্যা সমাধানে মিয়ানমার সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নৃশংস হামলা অব্যাহত থাকায় আন্তর্জাতিক উদ্বেগ বাড়ছে। বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী রাজ্যটিতে জঙ্গি নিধনের নামে নির্বিচারে হত্যা, নারী ও শিশুদের নির্যাতন এবং বাড়িঘর পুড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ জানিয়েছে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ।গত মাসে সেনাবাহিনীর দমন-পীড়ন শুরুর পর আন্তর্জাতিক ত্রাণকর্মীদের রাখাইন রাজ্যে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। সামগ্রিক পরিস্থিতিতে উদ্বিগ্ন ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি প্রতিনিধিদল ইতিমধ্যে মিয়ানমার পৌঁছেছে। আজ-কালের মধ্যে প্রতিনিধিদলটি পরিস্থিতি নিয়ে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীপ্রধান মিন অং লাইংয়ের সঙ্গে দেখা করবে।

রাখাইনে দমন-পীড়ন অব্যাহত থাকায় সীমান্ত দিয়ে প্রাণ বাঁচানো লোকজন ঢুকে পড়ছে বাংলাদেশে। এমন পরিস্থিতিতে মিয়ানমারের এসব লোককে ফেরত পাঠালেও তাদের সঙ্গে বাংলাদেশ মানবিক আচরণ করছে। এদিকে বুধবার কক্সবাজারে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলের কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসানের সঙ্গে সৌজন্য আলোচনায় বসতে যাচ্ছেন মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের (বিজিপি) আঞ্চলিক কমান্ডার সন লুইন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খন্দকার ফরিদ হাসান গত সন্ধ্যায় মুঠোফোনে বলেন, গত মাসে দায়িত্ব নেওয়ার পর সন লুইনকে বাংলাদেশে আমন্ত্রণ জানানো হয়। সেই অনুযায়ী তাঁর কক্সবাজার সফরটি হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটি মূলত একটি সৌজন্য সাক্ষাৎ। যে ধরনের বৈঠক দুই পক্ষ করে থাকে, সে রকম আনুষ্ঠানিক কাঠামোর কোনো বৈঠক নয়।নিরাপত্তা পরিষদের অনানুষ্ঠানিক বৈঠক: নিউইয়র্কের একটি কূটনৈতিক সূত্র গত সোমবার এই প্রতিবেদককে জানান, নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের অন্যতম যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ১৭ নভেম্বর মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়। চীন ছাড়া স্থায়ী সদস্য ফ্রান্স, রাশিয়া ও যুক্তরাজ্য এবং অস্থায়ী সদস্যের মধ্যে জাপান, মিসর, নিউজিল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভেনেজুয়েলা ও সেনেগালের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। বৈঠকে সবাই অভিযোগ করেন, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রাখাইন রাজ্যে চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। তাদের অভিযানে নির্মমভাবে লোকজনকে হত্যার পাশাপাশি নারী ও শিশুর প্রতি চরম নিষ্ঠুর আচরণ করা হচ্ছে। রাখাইন রাজ্যে মানবিক সহায়তা বন্ধের সমালোচনা করে অবিলম্বে তা চালুর জন্য মিয়ানমারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।ওই আলোচনার পরপরই জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্র রাখাইন রাজ্যের লোকজনের নিরাপত্তা এবং মৌলিক নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করতে মিয়ানমারের সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। সেই সঙ্গে প্রাণের ভয়ে ওই অঞ্চল থেকে পালিয়ে যাওয়া লোকজনের সহায়তায় বাংলাদেশকে সীমান্ত খোলা রাখার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সংকট মেটানোর দায় মিয়ানমারের: গত অক্টোবর থেকে রাখাইন রাজ্যে যে মানবিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধানে মিয়ানমারের উদ্যোগ নেওয়া উচিত বলে মনে করেন সেখানকার কূটনৈতিক ও আন্তর্জাতিক মিশনে কর্মরত ব্যক্তিরা। যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মধ্যে এ নিয়ে মতভিন্নতা নেই। তবে মিয়ানমারে ক্ষমতার পালাবদলের পর শান্তিতে নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অং সান সু চির রাষ্ট্রকাঠামোতে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ এখনো পাকাপোক্ত হয়নি। এমন পরিস্থিতিতে রাখাইন রাজ্যের পরিস্থিতি নিয়ে তাঁর ওপর কতটা চাপ দেওয়া যায়, এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ভাবছে। কারণ, রাখাইন রাজ্যের পাশাপাশি গত কয়েক দিনে চীনের লাগোয়া শিন প্রদেশে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর সশস্ত্র নৃগোষ্ঠীগুলোর হামলা এই পরিস্থিতিতে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এই অবস্থায় মিয়ানমারে কর্মরত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ও কিছুটা কৌশলে পদক্ষেপ নিচ্ছে।এদিকে মিয়ানমারের পরিস্থিতি নিয়ে মূল্যায়নের জন্য গত রোববার পররাষ্ট্রসচিব মো. শহীদুল হকের সভাপতিত্বে এক আন্তমন্ত্রণালয় বৈঠক হয়। বৈঠকে উপস্থিত বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিরা নিজেদের অবস্থান তুলে ধরেন। সীমান্ত খোলা রাখার ব্যাপারে জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনারের মুখপাত্রের বক্তব্য নিয়ে আলোচনা হয়। তবে রোহিঙ্গাদের প্রশ্নে সরকার আগের অবস্থানেই রয়েছে। নতুন করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। তবে কেউ সেই চেষ্টা করলে মানবিক আচরণ করেই তাকে ফেরত পাঠানো হবে।সরকারের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তারা মনে করেন, দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে যেকোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা রোধে প্রস্তাবিত সীমান্ত লিয়াজোঁ দপ্তর চালু এবং নিরাপত্তা সহযোগিতা নিয়ে রূপরেখা সমঝোতা স্মারক সই হলে পরিস্থিতির উন্নতিতে দুই দেশের একসঙ্গে কাজ করার সুযোগ তৈরি হতো।