hasina-ivy-osman

সেলিনাহায়াৎআইভীওস্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান।নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচন উপলক্ষে দুই পক্ষের মতপার্থক্য নিরসন নিয়ে আলোচনার সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই বারবার বিতর্কে জড়িয়েছেন মেয়র পদে মনোনয়ন পাওয়া সেলিনা হায়াৎ আইভী ও স্থানীয় সাংসদ শামীম ওসমান।মঙ্গলবার রাতে প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন গণভবনে বৈঠকের সময় একজন আরেকজনের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ দেন। অভিযোগ খন্ডনের সময় একে অপরের প্রতি আঙুল উঁচিয়েও কথা বলেন তাঁরা। তাঁদের এই আচরণে বিরক্ত হন প্রধানমন্ত্রী। বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও নারায়ণগঞ্জের একাধিক নেতার সূত্রে এসব কথা জানা গেছে।গণভবনে অনুষ্ঠিত বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের দুজন নেতা বলেন, বৈঠকের শুরুতে নারায়ণগঞ্জের রাজনীতিতে ওসমান পরিবারের অবদানের কথা তুলে ধরেন শামীম ওসমান। এরপর বিভিন্ন পর্যায়ে তাঁর ও দলের অবদান, নিজের ওপর নির্যাতন ও দমন-নিপীড়নের কথা উল্লেখ করেন শামীম।

বৈঠকের একপর্যায়ে আইভীকে মনোনয়ন দেওয়ার বিরোধিতা করে শামীম ওসমান বলেন, ‘আইভী জয় বাংলা স্লোগানকে অপমান করেছেন। আপনাকে (প্রধানমন্ত্রী) গালিগালাজ করেছেন। এ বিষয়ে পত্রিকার কপি দেখানোরও চেষ্টা করেন তিনি। ঠিক এই সময়ে আইভী বলেন, তিনি বলেছেন যে জয় বাংলা আওয়ামী লীগের দলীয় স্লোগান না। এটা সর্বজনীন এবং সব মানুষের। তখন প্রধানমন্ত্রীও বলেন, তিনিও বিভিন্ন সময়ে বলেছেন জয় বাংলা সর্বজনীন স্লোগান।দলীয় প্রধানকে কখনো গালি দেননি উল্লেখ করে বৈঠকে আইভী বলেন, শেখ হাসিনার আশীর্বাদ নিয়ে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। দলীয় প্রধানকে গালি দেওয়ার বিষয়টি প্রমাণ করতে পারলে তিনি নির্বাচন করবেন না। এই অপবাদ তিনি বহন করতে পারবেন না। এ সময় তাঁদের দুজনকে থামতে বলেন প্রধানমন্ত্রী।শামীম ওসমান আবার বলেন, আইভী নারায়ণগঞ্জের নিহত মেধাবী ছাত্র ত্বকীর বাবা রফিউর রাব্বীর সঙ্গে চলাফেরা করেন। যিনি সব সময় সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তখন আইভী বলেন, তিনি নারায়ণগঞ্জে ত্বকী হত্যার প্রতিবাদ করেছেন। শামীম ওসমানের পক্ষ নেননিÑএটাই তাঁর অপরাধ। একপর্যায়ে কাঁদো কাঁদো কণ্ঠে আইভী বলেন, তিনি নেত্রীর বিরুদ্ধে কখনই কোনো কথা বলেননি। তাঁর বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ মিথ্যা ও বানোয়াট।

প্রধানমন্ত্রীও তাঁকে সান্ত¡না দিয়ে বলেন, কে কী করেছে, সেটা তিনি জানেন। শুধু নেতাদের কথা নয়, তাঁর কাছে থাকা সুনির্দিষ্ট তথ্যের ওপর ভিত্তি করেই তিনি প্রার্থী নির্বাচন করেছেন।বৈঠক সূত্র জানায়, দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা এ পর্যায়ে শামীম ওসমানকে তিরস্কার করেন এবং আইভীর পক্ষাবলম্বন করে বক্তব্য দেন। তিনি বলেন, বিএনপি নির্বাচনে করছে। তাই নারায়ণগঞ্জ নির্বাচনে নিয়ে তিনি আর কোনো অভিযোগ শুনতে চান না। সবাইকে একযোগে কাজ করার নির্দেশ দেন এবং আইভীর পক্ষে কেউ কাজ করছে না, এ ধরনের খবর তাঁর কানে এলে তিনি ব্যবস্থা নেবেন।বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, নৌকার প্রার্থীকে বিজয়ী করতে দ্বিমতের কোনো অবকাশ নেই। দল করলে দলের নিয়ম-শৃঙ্খলা সবাইকে মানতে হবে।

পদত্যাগ করতে চেয়েছিলেন আনোয়ার : নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন না পাওয়ায় ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হন মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন। বক্তব্যের একপর্যায়ে তিনি দলীয় পদ থেকে পদত্যাগ করতে চান। তখন প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতি কিছুটা বিরক্ত হয়ে বলেন, তাঁকে তিনি অনেক পছন্দ করেন। জিজ্ঞাসা করেন, তাঁর বয়স কত হয়েছে। তখন তিনি বলেন, ৬২ বছর। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘চুল দেখে তো মনে হয় না।’ তিনি বলেন, ‘কলপ দিয়ে থাকি তো।এরপর প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত নির্বাচনে শামীমকে মনোনয়ন দিয়েছি, তুমি (আনোয়ার) আইভীর পক্ষে কাজ করেছ। এবার আইভীকে মনোনয়ন দিলাম। তুমি তাঁর পক্ষে না। যদি ইচ্ছা হয়, তাহলে পদত্যাগ করো। বিদায় দিয়ে দেব।বৈঠকে উপস্থিত দুজন নেতা বলেন, বৈঠকের শেষ পর্যায়ে সবাই মিলে যান এবং নারায়ণগঞ্জের নির্বাচনে এক হয়ে কাজ করতে প্রধানমন্ত্রীর কাছে অঙ্গীকার করেন। প্রধানমন্ত্রী, আইভী, শামীম ওসমান ও নারায়ণগঞ্জের নেতারা মিলে একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি তোলেন।জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করার সুযোগ কারও নেই। তাঁরা সবাই মিলে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে কী আলোচনা হয়েছে, জানতে চাইলে সেলিনা হায়াৎ আইভী আজ বুধবার বেলা সাড়ে তিনটার দিকে নারায়ণগঞ্জের সাংবাদিকদের জানান, প্রধানমন্ত্রী নৌকা প্রতীকের পক্ষে কাজ করার জন্য দলের সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন।গণভবনে আলোচনার বিষয়ে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করেও সাংসদ শামীম ওসমানকে পাওয়া যায়নি এদিকে, শেখ হাসিনার সঙ্গে বৈঠকে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে মেয়র প্রার্থী সেলিনা হায়াৎ আইভীর পক্ষে কাজ করার ‘প্রতিশ্র“তি দিয়েছেন’ এ কে এম শামীম ওসমান। ভোটের আগে কোন্দল মেটাতে দলের মধ্েয বিবদমান এই দুই নেতাসহ নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে মঙ্গলবার রাতে গণভবনে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠক শেষে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, আজকে আমাদের পার্টির মনোনীত প্রার্থী আইভী ও নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে বৈঠক হয়, শামীম ওসমানও তাতে ছিলেন।আমরা একমত হয়েছি যে, আমাদের দলীয় প্রার্থীকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য সবাই ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করে যাব। এ ব্যাপারে কোনো দ্বিমত নেই।

আগামী ২২ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করেছে বর্তমান মেয়র আইভীকে।নির্দলীয়ভাবে অনুষ্ঠিত গত নির্বাচনে শামীম ওসমানকে এক লাখের বেশি ভোটে হারিয়ে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের এবং দেশের প্রথম নারী মেয়র নির্বাচিত হন আইভী।নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মেয়র আইভী বরাবরই স্থানীয় রাজনীতিতে পরস্পরের প্রতিপক্ষ। দুই পরিবারের রাজনৈতিক টানাপড়েনের উত্তরাধিকার বহন করছেন তারা দুজন।আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা ওসমান পরিবারের বিপক্ষ শিবিরে থেকে নারায়ণগঞ্জ পৌরসভার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন আইভীর বাবা একই দলের নেতা আলী আহমদ চুনকা।আইভী ও শামীম প্রকাশ্েয সমাবেশে একে অন্েযর বিষোদগারের পাশাপাশি টিভি অনুষ্ঠানে তুমুল তর্কাতর্কিতেও একাধিকবার জড়ান। সেসব তর্কে ব্যক্তিগত বিষয়ও টেনে আনতে দেখা যায় তাদের।আইভী-শামীমের সম্পর্ক ভালো না হলেও ভোটে তার প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন ওবায়দুল কাদের।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ভালো (সম্পর্ক) ছিল না। আওয়ামী লীগ একটা বিশাল পরিবার। ভাইয়ে ভাইয়েও ঝগড়া থাকে।তবে এখানে মৌলিক বিষয় নির্বাচন, এখানে ভেদাভেদের সুযোগ নেই। নির্বাচনের বিষয়ে সবাই এক।

সভানেত্রী সবাইকে এক হয়ে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন জানিয়ে তিনি বলেন, দল করলে শৃঙ্খলা মানতে হবে। শৃঙ্খলার বাইরে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। যারা দলীয় শৃঙ্খলা মানবে না তাদের নিয়ে দল ভাববে।গতবার নির্দলীয়ভাবে হলেও স্থানীয় সরকার আইন সংশোধনের পর এবার দলীয় প্রতীকে ভোট হওয়ায় নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ থেকে তিনজনের নাম কেন্দ্রে প্রস্তাব করা হয়, তবে তার মধ্েয আইভীর নাম ছিল না। আইভীর অভিযোগ, শামীমের ইঙ্গিতে স্থানীয় নেতারা এই পদক্ষেপ নেন।তৃণমূল থেকে নাম আসা তিনজনের একজন সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মুজিবুর রহমানও মঙ্গলবার গণভবনের বৈঠকে ছিলেন।বৈঠকের আলোচনার বিষয়ে তিনি বলেন, দলীয় সভানেত্রী সবাইকে একসঙ্গে কাজ করার নির্দেশ দিয়েছেন।দলীয় নেত্রীর ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো কিছু করার নেই, বলেন তিনি।

আইভীর বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ করে আসছেন, বৈঠকে তা তোলা হয় বলে জানান নারায়ণগঞ্জে শামীম সমর্থক হিসেবে পরিচিত এই আওয়ামী লীগ নেতা। নেত্রী আইভীকে বলেছেন- ‘তুমি ক্ষমা চাও, ভোট চাও’। আমাদের বলেছেন- পাস করিয়ে নিয়ে আসেন, বাকিটা আমি দেখব’।ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, কে অপরের সঙ্গে মনোমালিন্য থাকতে পারে, তবে নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীকে সবাই মিলেই পাস করাতে হবে। এখানে বিভেদের কোনো সুযোগ নেই।সন্ধ্যায় গণভবনে ঢোকেন আইভী, শামীম ওসমানসহ নারায়ণগঞ্জের আরও তিন নেতা। রাত ১০টার পর তারা গণভবন থেকে বেরিয়ে যান। এ সময় সাংবাদিকরা কথা বলার জন্য এগিয়ে গেলেও এড়িয়ে যান দুজনই।বিএনপি নির্বাচনে আসায় চ্যালেঞ্জ মনে করছেন কি না- এ প্রশ্নের উত্তরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বলেন, চ্যালেঞ্জ জেনেই আমরা নির্বাচনে প্রার্থী দিয়েছি। সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করে এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করবে।বিএনপি গত নির্বাচন শেষ মুহূর্তে বর্জন করলেও এবার অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দলটি মেয়র পদে প্রার্থী করেছে জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন খানকে।